বগুড়ার ধুনটে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেওয়ার নামে শতাধিক মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে দায়েরকৃত তিনটি মামলার গ্রেফতারী পরোয়ানামূলে ধুনট উপজেলা স্বেচ্ছাসেবকলীগের সভাপতি সুলতান মাহমুদকে (৩৬) গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। বুধবার দুপুর ২টায় ধুনট সদরের চরধুনট এলাকা থেকে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছে। গ্রেফতারকৃত সুলতান মাহমুদ ধুনট সদরপাড়া গ্রামের মৃত আজিজার রহমানের ছেলে।
অনুসন্ধানে জানাগেছে, সুলতান মাহমুদ ২০১৫ সালে ধুনট উপজেলা স্বেচ্ছাসেবকলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পদ নিয়ে রাজনীতিতে প্রবেশ করে। পরবর্তীতে ২০১৭ সালে ধুনট উপজেলা স্বেচ্ছাসেবকলীগের সভাপতি পদে নির্বাচিত হন। এরপর থেকেই দখলবাজি, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, তদবির, নিয়োগ বাজিণ্য সহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়েন সুলতান মাহমুদ। তবে তিনি সব থেকে বেশি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন নিয়োগ বানিজ্যের নামে। মন্ত্রী, এমপি, প্রশাসনিক ও বিভিন্ন অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের নাম ব্যবহার করে পুলিশ কনস্টেবল, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ, স্বাস্থ্য বিভাগ সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেওয়ার নামে প্রতারনার জাল ফেলে বগুড়া, কাজিপুর, ধুনট সহ বিভিন্ন এলাকার দুই শতাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে তিনি কয়েক কোটি টাকা হতিয়ে নিয়েছেন। তার প্রতারনার জালে রয়েছেন রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ, আইনজীবি, শিক্ষক সহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ। তবে এসব টাকা হাতিয়ে নেওয়ার সময় স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতা সুলতান মাহমুদ নির্ধারিত টাকার পরিমান লিখে রূপালী ব্যাংক ধুনট শাখার সঞ্চয়ী হিসাব নং-১৩৬ এর একটি করে চেক দিয়েছেন চাকরি প্রার্থীদের। তবে কোন কারণে চাকরি দিতে ব্যর্থ হলে এক মাসের মধ্যে এককালীন টাকা রূপালী ব্যাংক থেকে তুলে দেওয়ার বিশ্বাস স্থাপন করেন। কিন্তু সুলতান মাহমুদের ব্যাংক এ্যাকাউন্টে কোন টাকা থাকায় হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়েছে এসব ভুক্তভোগিরা।
প্রতারনার শিকার বগুড়া জেলা স্বেচ্ছাসেবকলীগের সহ-সভাপতি কোয়েল ইসলাম জানান, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম সাহেবের নাতনী জামাই পরিচয় দিয়ে সুলতান মাহমুদ আমার মেয়ের জামাইকে এ্যসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানীতে চাকরি দেওয়ার কথা বলে গত তিন বছর আগে আমার থেকে নগদ ৫ লাখ ৪০ হাজার টাকা নেয়। প্রমান হিসেবে তার ধুনট রূপালী ব্যাংক শাখার সঞ্চয়ী হিসাব নং-১৩৬ একটি চেক দেয়। কিন্তু চাকরি দিতে না পারায় টাকা ফেরত চাইলে সে দীর্ঘদিন যাবত বিভিন্ন তালবাহানা করে আসছে।
একইভাবে ধুনট উপজেলার পারনাটাবাড়ি গ্রামের দরিদ্র কৃষক আবদুল মোমিন মুকুলের ছেলে নাসিম উদ্দিনকে রূপালী ব্যাংকে চাকরি দেওয়ার কথা বলে ২০১৮ সালের ৩০ জুলাই ও ২০১৯ সালের ২৫ মে দুই দফা নগদ ৭ লাখ ৯০ হাজার টাকা নেয় সুলতান মাহমুদ। জমি বিক্রি করে সুলতানকে টাকা দিয়েছিলেন নাসিম উদ্দিন। বিশ্বাস স্থাপনে তাকেও ধুনট রূপালী ব্যাংক শাখার সঞ্চয়ী হিসাব নং-১৩৬ একটি চেক দেওয়া হয়। কিন্তু দীর্ঘদিনেও চাকরি না পেয়ে ভুক্তভোগি নাসিম উদ্দিন বাদী হয়ে বগুড়ার আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করলে বিচারক অভিযোগপত্রটি আমলে নিয়ে ধুনট থানার ওসিকে নির্দেশনা প্রদান করেন। গত ২৮ জুন ধুনট থানায় মামলাটি রেকর্ডভুক্ত করা হয়। মামলা নং-২০। মামলাটি বগুড়া জেলা সিআইডি পুলিশ তদন্ত করছেন। গত ৮ সেপ্টেম্বর সিআইডি বগুড়া জেলার সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার আবু বক্কর সিদ্দিক ও উপ-পুলিশ পরিদর্শক এন্তেজারুল হকের স্বাক্ষরিত একপত্রে রূপালী ব্যাংক ধুনট শাখাকে এ বিষয়ে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল কিনা এসংক্রান্ত একটি প্রত্যয়নপত্র দাখিল করতে বলা হয়।
এদিকে প্রতারনার শিকার শুধু কোয়েল ইসলাম ও নাসিম উদ্দিনই নয় তাদের মতো বগুড়ার এ্যাড. জাবেদ কাউসারের কাছ থেকেও ৬ লাখ, মোস্তাফিজার রহমানের কাছ থেকে ১০ লাখ, আবদুস সাত্তারের কাছ থেকে ৩ লাখ সহ প্রায় শতাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতা সুলতান মাহমুদ।
তবে এ বিষয়ে উপজেলা স্বেচ্ছাসেবকলীগের সভাপতি সুলতান মাহমুদ বলেন, চাকরি দেওয়ার নামে আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছি। বিষয়টি আমার পরিবারিক এবং কিছু ব্যবসায়ী লেনদেনের কারণে চেক দিয়েছি। এ বিষয়ে তিন আর কথা বলতে রাজি নন।
এবিষয়ে রূপালী ব্যাংক ধুনট শাখা ব্যবস্থাপক শাহানুল হাসান বলেন, এপর্যন্ত সুলতান মাহমুদের স্বাক্ষরিত অর্ধ কোটি টাকার প্রায় ১৫টি ডিজঅনার চেক জমা হয়েছে। এ ছাড়া আরো অনেক ব্যক্তি চেক নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু তার হিসাব নম্বরে কোন টাকা থাকায় কেউ টাকা তুলতে পারেননি। তাই চেক জালিয়াতির বিষয়টি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবেন বলে জানান তিনি।
এদিকে উপজেলা স্বেচ্ছাসেবকলীগের সভাপতি সুলতান মাহমুদ চেক জালিয়াতি করে দুই শতাধিক মানুষের কাছ কোটি টাকা হাতিয়ে উধাও হওয়ার একটি সংবাদ মঙ্গলবার রাতে শীর্ষ অনলাইন পত্রিকা ও বুধবার জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এর পরপরই নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। বুধবার দুপুরে অভিযান চালিয়ে চরধুনট এলাকা থেকে সুলতানকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
ধুনট থানার কর্মকর্তা ইনচার্জ (ওসি) ইসমাইল হোসেন জানান, সুলতান মাহমুদের বিরুদ্ধে তিনটি মামলার গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি ছিল। বুধবার দুপুরে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে সুলতান মাহমুদকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পরবর্তীতে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে জানা যাবে সে প্রতারনা করে কত জনের কাছ থেকে কত টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন এবং টাকাগুলো কোথায় পাচার করেছে। এসব বিষয়ে আরো তদন্ত করা হবে বলে জানিয়েছেন ওসি ধুনট।