বাহারি নকশা আর রংয়ের আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হয়েছে গোটা বরিশাল নগরী। যা দেখে যে কারোরই মনে হবে উৎসব চলছে। শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে মন্ডপগুলোর পাশাপাশি এর আশপাশের এলাকা ও সড়ক ঘিরে রং, বে-রংয়ের বাতি, তোরণ, নকশি দিয়ে সজ্জিত করা হয়েছে। যার আলোর ঝলকানিতে আলোকিত হয়ে যায় গোটা এলাকা। আলোকসজ্জার মধ্যদিয়ে উৎসবের আয়োজনকে আরও বর্ণিল করে তোলা হয়েছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতে না আসতেই বাহারি রংয়ের আলোকসজ্জা দেখার জন্য মন্ডপগুলোতে ভক্তদের পাশাপাশি সাধারণ নগরবাসীও ভিড় করছেন।
শুক্রবার শারদীয় দুর্গা উৎসবে ষষ্ঠীপূজার মধ্যদিয়ে মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে। ওইদিন সকাল থেকেই চন্ডিপাঠে মুখরিত ছিল বরিশালের মন্ডপ অঙ্গন। চন্দনের সুবাস স্নিগ্ধ করে তুলে পরিবেশ। মূলত সন্ধ্যায় ষষ্ঠী পূজার মধ্যদিয়ে সার্বজনীন শারদীয় দুর্গা উৎসব পুরোমাত্রায় শুরু হয়েছে। এর আগে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বেলতলায় বেল বরণ পূজার মধ্যদিয়ে আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছিল। সে হিসেবে আগামি ৮ অক্টোবর (মঙ্গলবার) হবে দশমী। আর দশমী পর্যন্ত এ উৎসবকে কেন্দ্র করে পূজা মন্ডপগুলোতে ঢাক-ঢোল আর উলুধ্বনিতে মুখরিত থাকবে। পূজামন্ডপের জন্য নগরীর সদর রোডের কাটপট্টি মোড় থেকে শুরু করে হাসপাতাল রোড, বিএম কলেজ এলাকা, নাজিরেরপুল, নতুন বাজার পোল, ভাটিখানা পুরান বাকলা, কালীবাড়ি রোড, কাটপট্টি, চকবাজার ও ফলপট্টি এলাকাজুড়ে বাহারি রংয়ের বাতিতে আলোকিত করা হয়েছে গোটা এলাকা।
নগরীর পূজামন্ডপসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সন্ধ্যার পরে ভক্তদের পাশাপাশি দর্শনার্থীদের ভিড় বাড়ে পূজামন্ডপগুলোতে। এসব মন্ডপগুলোতে ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে পূজা-আর্চনায় মগ্ন পূজারীরা। নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ডের মন্ডপে বাহারি রংয়ের নকশা করা হয়েছে। যারমধ্যে মন্ডপভেদে বাহারি আলোকসজ্জার পাশাপাশি গেট ও তোরণ নির্মাণে রয়েছে ভিন্নতা। প্রতিবছরের মত এবারও ধর্ম, বর্ণ মিলে পূজা উদ্যাপন করবেন এবং নির্বিঘেœই সম্পন্ন হবে বলে মনে করছেন দর্শনার্থী ও পূজারীরা। এবার দেবী দুর্গা ঘোড়ায় চেপে এসেছেন এবং যাবেনও ঘোড়ায় চেপে।
বরিশাল মহানগর পূজা উদ্যাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সুরঞ্জিৎ দত্ত লিটু জানান, দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে বরিশালে সাজসজ্জায় প্রতিবারের চেয়ে এবার অনেকটাই ভিন্নতা আনা হয়েছে। একইভাবে মন্ডবগুলোর গেট ও তোরনেও ব্যাপক ভিন্নতা আনা হয়েছে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উৎসব সার্বজনীন এবং আনন্দ, উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্যদিয়ে শেষ হবে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শারদীয় দুর্গা উৎসব উপলক্ষে জেলা ও নগরীর মন্দিরগুলোকে সাজানো হয়েছে নবরূপে। উৎসব নির্বিঘœ ও শান্তিপূর্ণ করতে নিñিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
বড় তোরণ ॥ অতীতের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে শারদীয় দুর্গা উৎসবে নগরীতে এবারও সব চেয়ে বড় তোরণ নির্মাণ করেছে শংকর মঠ পূজা উদযাপন কমিটি। এ ছাড়া বড় পূজা মন্ডপ নির্মাণ করেছে শ্রী শ্রী পাষনময়ী কালী মাতার মন্দির। পাশাপাশি নানা ধরনের সাজসজ্জায় সজ্জিত করা হয়েছে জগন্নাথ মন্দিরটিকে।
অপরদিকে নগরীর বাহিরে ১৬৯ বছরের ঐতিহ্য নিয়ে মাথা উঁচু করে গৌরনদী পৌর সদরের আশোকাঠী মহল্লার জমিদার মোহন লাল সাহার বাড়িতে এবারও মহাধুমধামের মধ্যদিয়ে ভারতীয় উপ-মহাদেশের সর্ববৃহৎ দুর্গা মন্দিরে উৎসব শুরু হয়েছে। হাজারো ভক্তের পদচারনায় মুখরিত হয়ে উঠেছে পুরো মন্দির প্রাঙ্গণ। এতদাঞ্চলের মধ্যে এ দুর্গা মন্দিরটি সর্ববৃহৎ হওয়ায় প্রতিবছরই ব্যক্তিগত উদ্যোগে মহাধুমধামের সাথে এখানে দুর্গা পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
জমিদার বাড়ির উত্তরসূরী প্রভাষক রাজা রাম সাহা জানান, ১৮৫০ সালে জমিদার প্রসন্ন কুমার সাহার বাবা খ্যাতিমান জমিদার মোহন লাল সাহার উদ্যোগে মন্দিরটি নির্মান করা হয়। কারুকার্জ খচিত ঐতিহাসিক এ মন্দিরের ছাঁদের ওপরের চারিপাশের সিংহ মূর্তিগুলো আজও যেন কালের স্বাক্ষী হয়ে রয়েছে। তিনি আরও জানান, তৎকালীন সময়ে ভারতীয় উপ-মহাদেশের মধ্যে সর্ববৃহৎ মন্দির হিসেবে এ মন্দিরটিতে ভক্ত দর্শনার্থীরা পূজা অর্চনা করতে ভীড় করতেন। ২০ ফুট উচ্চতার দুর্গা প্রতিমার এ মন্দিরটিতে এখনও পূর্বের ঐতিহ্য ধরে রাখা হয়েছে। ৩০ গজ দৈর্ঘ্য ও ২০ গজ প্রস্থ মন্দিরটিতে রয়েছে ৪৫টি স্তম্ভ। ১৯৭১ সালে পাক হানাদার ও তাদের স্থানীয় সহযোগী রাজাকাররা তাদের বাড়িতে হামলা চালিয়ে ব্যাপক লুটপাট করেছিলো। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিলো পাইক পেয়াদাদের ঘরবাড়ি। গুড়িয়ে দেয়া হয়েছিলো দূর্গা মন্দিরের অসংখ্য কারুকার্জ খচিত অলংকরণ।
সূত্রমতে, নগরীতে ৪১টি ও জেলার ১০ উপজেলায় ৬১৩টি মন্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আর গোটা বরিশাল বিভাগে এক হাজার ৬১৩টি মন্ডপে অনুষ্ঠিত হচ্ছে শারদীয় দুর্গোৎসব। এরমধ্যে আগৈলঝাড়া উপজেলায় সর্বাধিক ১৫৪টি মন্ডপে পূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। দুর্গাপূজাকে ঘিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতার বিষয়টি সবার মনজয় করেছে। প্রতিটি মন্ডপে নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য পুলিশ, আনসার ও ভিডিপি’র পাশাপাশি মন্ডবগুলোর নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবক টিম কাজ করছেন। জেলা প্রশাসক এসএম অজিয়র রহমানের পুরস্কার হিসেবে জেলা ও নগরীর প্রতিটি পূজা মন্ডবের প্রায় পাঁচ হাজার নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবকরা টিশার্ট গায়ে দিয়ে তাদের দায়িত্ব পালন করছেন। এ ছাড়া পোষাক পরিহিত এবং সাদা পোষাকে র্যাব ও ডিবি পুলিশসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা মন্ডবে মন্ডবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।