পুরনো জাহাজ ভেঙে যে লোহা পাওয়া যায় সেগুলো বাংলাদেশের বিভিন্ন স্টিল মিলে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। চট্টগ্রামের সীতাকু-ে অন্তত ৬০টি জাহাজ কাটা প্রতিষ্ঠান বা শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড সচল আছে। যদিও কাগজে-কলমে আছে দেড় শতাধিক আর এ সব কারাখানায় বছরে আড়াইশ’ থেকে তিনশ’ ‘স্ক্র্যাপ’ জাহাজ কাটা হয়। এই শিল্পে কাজ করেন প্রায় ২৫ থেকে ৩০ হাজার শ্রমিক। অভিযোগ আছে, এখানে রাতে শিশু শ্রমিকদেরও কাজ করানো হয়। জাহাজ ভাঙা শিল্পের শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ, নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সেবার উন্নতি হয়েছে দাবি করা হলেও, বাস্তব অবস্থা ভিন্ন।
সূত্রমতে গত দশ বছরে জাহাজভাঙার কাজ করতে গিয়ে আড়াইশরও বেশি শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন হাজারেরও বেশি। এরমধ্যে সর্বশেষ চলতি মাসের ৬ তারিখ রাতে সীতাকু-ের জাহাজভাঙা প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সময় লোহার পাত মাথায় পড়ে এক শ্রমিকের মৃত্যু হয়। মধ্যরাতে ওই ইয়ার্ডটিতে শ্রমিকরা জাহাজ কাটছিল। সেসময় লোহার একটি পাত মাথায় পড়লে তিনি গুরুতর আহত হন। পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে তার মৃত্যু হয়।
এর আগে গত মাসের শেষ দিনে সীতাকু-ে সোনাইছড়ি উপকূলীয় এলাকায় জিরি সুবেদার নামে একটি শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে পুরাতন জাহাজে দুর্ঘটনায় অন্তত দুজন শ্রমিক নিহত ও আরও ৫ জন আহত হন। জানা গেছে, ইয়ার্ডে কয়েকজন শ্রমিক একটি পুরাতন জাহাজের ঝুলন্ত সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠছিল। এ সময় কোপ্পা (লোহার বড় আংটা) ছিঁড়ে নিচে পড়ে ১২ থেকে ১৫ জন শ্রমিক আহত হন। ঘটনাস্থলেই দুজন শ্রমিক নিহত হন।
সূত্র বলছে, জাহাজভাঙা শিল্পে আদালতের নির্দেশ মোতাবেক কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও মৃত্যুঝুঁকি জাহাজ ভাঙা শিল্পের শ্রমিকদের নিত্যসঙ্গী। দুর্ঘটনায় আহত বা নিহতের ঘটনাও ঘটে প্রায়ই। তবে পরিচয়পত্র কিংবা নিয়োগপত্র না থাকায় শ্রমিকরা একদিকে যেমন কর্মকালীন বিভিন্ন সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকেন, অন্যদিকে দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে নিহতের পরিবার সম্মুখীন হয় মৃত্যু-পরবর্তী ক্ষতিপূরণপ্রাপ্তির জটিলতায়। শেষ পর্যন্ত অনেক শ্রমিক বঞ্চিত হন কর্মকালীন মৃত্যু বা দুর্ঘটনার কারণে শারীরিক ক্ষতির কারণে প্রাপ্য ক্ষতিপূরণ থেকে।
জানা গেছে, ১৯৬০ সালে বঙ্গোপসাগর উপকূলের সীতাকুন্ডে এমডি আলপাইন নামে বিকল হওয়া একটি জাহাজ কাটার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে ‘জাহাজ ভাঙা’ শিল্পের গোড়াপত্তন হয়। অর্ধশত বছর পেরিয়ে সীতাকুন্ড উপকূলে এখন বছরে জাহাজ ভাঙা হয় ৮০ থেকে ১০০টি। দেশে ইস্পাতের চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশের যোগান আসে জাহাজ ভাঙা শিল্প থেকে। দিনে দিনে বেড়েছে এই শিল্পের পরিধি। ব্যবসার আকার ১০ হাজার কোটি টাকারও উপরে।
জানা যায়, সীতাকুন্ড উপকূলজুড়ে গড়ে উঠেছে শতাধিক শিপ উয়ার্ড। এসব শিপ ইয়ার্ড চরম ঝুঁকিতে। নীতিমালার তোয়াক্কা না করায় এসব ইয়ার্ডে একের পর এক ঘটছে মৃত্যুর ঘটনা। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। সরকার এটিকে শিল্প ঘোষণা করার পরও এসব ইয়ার্ডে গড়ে তোলা হয়নি কোনোরকম নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ফলে চরম ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন এখানকার শ্রমিকরা। দীর্ঘদিন ধরে এসব শিপ ইয়ার্ডে দুর্ঘটনায় শত শত শ্রমিক মারা যাওয়ায় সরকার এই শিল্পকে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি নীতিমালার আওতায় নিয়ে আসে।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বাংলাদেশ অক্যুপেশনাল সেইফটি, হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট ফাউন্ডেশন (ওশি) শিপ ইয়ার্ডে দুর্ঘটনার বিষয়ে বিগত সময়ের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে রয়েছে, জাহাজ থেকে পড়ে যাওয়া, লোহার পাতের ধাক্কা বা নিচে চাপা পড়া, অগ্নিকান্ড, এস্কেভেটরের আঘাত ও বিষাক্ত গ্যাসে আটকা পড়া। প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়, অধিকাংশ ইয়ার্ডের মালিক তাদের শ্রমিকদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণ, হেলমেট, সেইফটি জ্যাকেট ও বুট ইত্যাদি সরবরাহ করেন না। অন্যদিকে যেসব ইয়ার্ডে ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণ সরবরাহ করা হয় সেখানকার শ্রমিকরাও এসব ব্যবহারে উদাসীন থাকেন। এনজিও সংস্থা ওশির তথ্য অনুযায়ী, শিপ ইয়ার্ডে দুর্ঘটনায় ২০১৭ সালে ১৫ শ্রমিক নিহত ও আহত হয় ২২ জন। ২০১৬ সালে নিহত ২৩, আহত ৩১। ২০১৫ সালে নিহত ১৪, আহত ২৭। ২০১৪ সালে নিহত ১৫, আহত ৩৪। ২০১৩ সালে নিহত ২৬, আহত ৪০ জন শ্রমিক। চলতি বছর এ পর্যন্ত ১৫ জনের বেশি শ্রমিক নিহত হয়েছেন।
সূত্রমতে, বিশ্বের বৃহত্তম এই জাহাজভাঙা শিল্প এলাকায় ১৮৬টি শিপ ইয়ার্ডের পরিবেশ ছাড়পত্র রয়েছে। তবে বর্তমানে চালু রয়েছে ৬০ থেকে ৮০টি শিপ ইয়ার্ড। সীতাকুন্ডের মাদাম বিবির হাট, কুমিরা, ভাটিয়ারি, সোনাইছড়ি, জাহানাবাদ, কদমরসূল, বাঁশবাড়িয়া উপকূলজুড়ে এগুলোর অবস্থান। এসব ইয়ার্ডে সরাসরি কাজ করছে ২২ হাজার শ্রমিক, পরোক্ষভাবে যুক্ত আছে আরো ১০ হাজার। উন্মুক্ত সৈকতে ঝুঁকিপূর্ণ বিচিং পদ্ধতিতে জাহাজ কাটতে গিয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনার কবলে পড়ছেন অতি দরিদ্র এসব শ্রমিক। কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ বিচিং পদ্ধতিতে জাহাজভাঙার কাজ বিশ্বের প্রায় সব দেশেই নিষিদ্ধ। তাছাড়া ইয়ার্ডগুলোতে ক্ষতিকর অ্যাসবেসটসের সংস্পর্শে শ্রমিকরা ক্যান্সারের ঝুঁকিতে পড়ছেন। ২০১৫ সালের বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালায় মালিক-শ্রমিক প্রতিনিধির সমন্বয়ে সেইফটি কমিটি গঠনের বাধ্যবাধকতা থাকলেও জাহাজভাঙা ইয়ার্ডে এই বিধি এখনো পুরোপুরি মেনে চলা হচ্ছে না।
হাইকোর্টে দেয়া একটি বেসরকারি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী সীতাকুন্ডের জাহাজভাঙা ইয়ার্ডে গত ১০ বছরে দুর্ঘটনায় অন্তত ২৫০ জন শ্রমিক মারা গেছেন। এই সময়ে এক হাজারেরও বেশি শ্রমিক আহত হয়েছেন। এ সময় এক আদেশে আদালত শিপইয়ার্ডে শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও অব্যাহত পরিবেশদূষণ নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে বিধিমালা তৈরির নির্দেশ দেন।
শ্রমিকদের নিরাপত্তাহীনতার পাশাপাশি শিপইয়ার্ডগুলো পরিবেশকেও অনিরাপদ করে তুলেছে বলে দীর্ঘদিনের অভিযোগ পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর। স্ক্র্যাপ জাহাজে তেজস্ক্রিয় বর্জ্য, অ্যাসবেস্টস, গ্লাসহোল, লুব্রিকেন্ট ওয়েলসহ নানা ধরনের মারাত্মক ক্ষতিকর বর্জ্য থাকে। এসব বর্জ্য পরিবেশসম্মত উপায়ে অপসারণের বিধান থাকলেও শিপইয়ার্ডগুলো সেই বিধান মানছে না বলে অভিযোগ পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিপ ইয়ার্ড শ্রমিকদের কোনো ধরনের উন্নতি হয়নি। তারা আগের মতই রয়ে গেছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা কাজ করে। শ্রমিকরা প্রতিনিয়তই মারা যাচ্ছে। তাদের জীবনের কোনো গ্যারান্টি নেই। সুরক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই। হতাহত শ্রমিকরা বিধি মোতাবেক ক্ষতিপূরণও পায় না। মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে শিপ ইয়ার্ডে শ্রমিকরা কাজ করছেন। তাদের তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয় না। নীতিমালাও মানছে না। এছাড়া শ্রমিকদের মৃত্যুর তথ্যও গোপন করছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। জাহাজ কাটার সময় লোহার পাত এবং শেকল পড়ে, বয়লার বিস্ফোরণে মৃত্যু হলেও সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। নিরাপত্তা সরঞ্জাম না দেওয়া এবং এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় প্রতিবছর একাধিক শ্রমিকের মৃত্যুর পাশাপাশি হাত-পা হারিয়ে পঙ্গু হয়েছেন অনেকে। হতাহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ এবং চিকিৎসার বিষয়েও উদাসীন মালিকপক্ষ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অধিক মুনাফা করতেই ইয়ার্ড মালিকরা নিরাপত্তা সরঞ্জাম এবং দক্ষ শ্রমিক দিয়ে কাজ করান না। শ্রমিক হতাহতের ঘটনায় জাহাজ আমদানিকারক ও ইয়ার্ড মালিকদের নামে মামলা না হওয়ায় তারা আরও বেশি উদাসীন। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিলেই ইয়ার্ডে দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব।