পঞ্চগড়সহ দেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে যেখানে তামাকের চাষ হতো সেসব এলাকায় এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে বাণিজ্যিকভিত্তিতে চায়ের আবাদ বি¯ৃÍত হচ্ছে। চায়ের আবাদ বিস্তৃতির ফলে চা শিল্প বিকাশে নতুন সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে। নতুন নতুন এলাকায় গড়ে উঠছে চা বাগান। জানা গেছে, নব্বইয়ের দশকে বিশ্বে চা রফতানির তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল পঞ্চম। সবচেয়ে বেশি পরিমাণ চা রফতানি হয় সেই সময়। ১৯৮২ সালে চা রফতানি হয় ৩ কোটি ৪৪ লাখ কেজি। তবে পরবর্তীতে চা রফতানিতে ভাটা পড়ে। সবচেয়ে কম রফতানি হয় ২০১৬ সালে, ৪ লাখ ৭০ হাজার কেজি। অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়তে থাকায় রফতানিও কমে যায়। ২০১৬ সালে চা রফতানিতে বিশ্বে বাংলাদেশ ছিল ৭৭তম।
রফতানি কমলেও ২০১৮ সালে চা উৎপাদনে ঘুরে দাঁড়ায় বাংলাদেশ। চা চাষের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উৎপাদনের রেকর্ড হয়। সে সময় ৮ কোটি ২১ লাখ ৩০ হাজার কেজি চা উৎপাদিত হয়। এরমধ্যে ২৫ লাখ ৬০ হাজার কেজি রফতানি হয়। আন্তর্জাতিক সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, চা উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে নবম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিগত দিনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত অর্থবছরের (২০১৮-১৯) প্রথম ছয় মাসেই চা থেকে রফতানি আয় আসে ১০ লাখ ৭১ হাজার ডলার, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২০ লাখ ৭৭ হাজার মার্কিন ডলার। গত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪০ লাখ ৪৭ হাজার ডলার আয় এসেছে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে।
এদিকে, এবছরের চলতি মৌসুমে দেশের উত্তরাঞ্চলে চা উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবার বিপুল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এবার উৎপাদন ১ কোটি কেজি ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ চা বোর্ডের পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয় সুত্র জানায়, গত ক’বছর ধরেই পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও জেলায় প্রতি মৌসুমে পর্যায়ক্রমে চা উৎপাদন বেড়ে চলেছে। গত মৌসুমে (২০১৮) উত্তরাঞ্চলে চা উৎপাদন হয়েছিল ৮.৪ মিলিয়ন কেজি অর্থাৎ ৮৪ লাখ কেজি। চলতি মৌসুমে (২০১৯) উত্তরবঙ্গে চা উৎপাদনের টার্গেট ধরা হয়েছে ৯.৫ মিলিয়ন কেজি অর্থাৎ ৯৫ লাখ কেজি। তবে এবার চা উৎপাদন ১০ মিলিয়ন কেজি অর্থাৎ ১ কোটি কেজি ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সুত্র জানায়, গত চা উৎপাদন মৌসুমের তুলনায় এ বছর এখন পর্যন্ত ৩০ শতাংশ চা বেশি উৎপাদন হয়েছে। এই ধারাবাহিকতায় মৌসুম শেষে চা উৎপাদন ১ কোটি কেজি ছাড়িয়ে যাবে বলে চা উৎপাদক মহল আশা করছেন।
বাংলাদেশ চা বোর্ডের পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয়ের নর্দান বাংলাদেশ প্রকল্পের প্রজেক্ট ডিরেক্টর ড. শামীম আল মামুন জানান, ২০০০ সালে পঞ্চগড়ে সর্বপ্রথম চা চাষ শুরু হয়। পরবর্তীতে উত্তরাঞ্চলে চা চাষ সম্প্রসারণ, চায়ের উৎপাদন বৃদ্ধি ও চা চারা উত্তোলনসহ বিভিন্ন কর্মকান্ডের জন্য নর্দান বাংলাদেশ প্রকল্প কাজ শুরু করে। এতদঞ্চলের চা চাষীদের আর্থ সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে স্বল্প মূল্যে চারা বিতরণ, প্রশিক্ষণ, প্রণোদনা, চা চাষে উদ্ধুদ্ধ করা, প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান, কর্মশালা আয়োজন, চাষীদের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ও কীটনাশক যন্ত্রসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক সরঞ্জামাদি প্রদানের জন্য এই প্রকল্পকে ৪ কোটি ৯৭ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয় সরকার।
তিনি আরো জানান, স্বল্পমূল্যে উত্তরাঞ্চলে চা চাষীদের মাঝে ১০ লাখ চারা বিতরণ করা হবে। ইতোমধ্যে ৬ লাখ ৪৫ হাজার চারা বিতরণ করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে চারা বিতরণ চলছে। তিনি জানান, উত্তরাঞ্চলে নিবন্ধিত চা বাগানের সংখ্যা ৯টি, নিবন্ধিত চা কারখান ২৬টি। এরমধ্যে চালু হয়েছে ১৮ টি কারখানা। এ ছাড়া ক্ষুদ্রায়তন চা বাগানের সংখ্যা (২৫ একরের নিচে) প্রায় ৫ হাজার। বর্তমানে চা চাষ হচ্ছে ৭ হাজার ৬৪৫ একর জমিতে। প্রতি হেক্টরে চা উৎপাদন হচ্ছে ২৫০০ কেজি। এ ছাড়াও দিনাজপুর, লালমনিরহাট ও নীলফামারী জেলায় চা চাষ সম্প্রসারণ করা হচ্ছে।
শামীম আল মামুন বলেন, গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার চায়ের উৎপাদনে উত্তরবঙ্গে সর্বোচ্চ রেকর্ড করবে বলে আশা করা হচ্ছে এবং ৯৫ লাখ কেজি লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে চা উৎপাদন ১ কোটি কেজি ছাড়িয়ে যাবে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ এবং রফতানি বৃদ্ধির লক্ষ্য নিয়ে বাংলাদেশের চা শিল্পের উন্নয়নের জন্য কৌশলগত কর্মপরিকল্পনা ‘ভিশন ২০২৫’-এর বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। এর আওতায় ২০২৫ সালের মধ্যে বার্ষিক ১০ কোটি কেজি চা উৎপাদনের মাইলফলক অতিক্রমের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এ লক্ষ্য পূরণের জন্য বৃহদায়তনের বাগানের পাশাপাশি ক্ষুদ্রায়তনের জমিতে চায়ের আবাদ বৃদ্ধিতে মনোযোগ দেয়া হচ্ছে। দেশের সাতটি জেলায় প্রায় এক লাখ হেক্টর জমিতে চা আবাদের লক্ষ্য হাতে নেয়া হয়েছে। এখানকার আরও ৪ হাজার ৬৯৮ হেক্টর অনাবাদি জমিতে আরও ১ কোটি ২০ লাখ কেজি চা উৎপাদন করা সম্ভব।
সূত্র জানায়, চা উৎপাদন এবং রফতানি বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকারের ব্যাপক পরিকল্পনা রয়েছে। সরকারের রূপকল্প-২০২১ বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশ চা বোর্ড ৯৬ হাজার ৭৩৫ দশমিক ৭০ লাখ টাকা ব্যয় সাপেক্ষে ১২ বছর মেয়াদী একটি কৌশলগত উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। সরকারের নীতি এবং ভিশন-২০২১-কে সামনে রেখে পরিকল্পনাটি তিন পর্যায়ে ১০টি প্রকল্প প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। দেশের চা শিল্পের উৎপাদন বাড়াতে ‘উন্নয়নের পথ নক্শা বাংলাদেশ চা শিল্প’ নামে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে চা বোর্ড। ২০২৫ সালে দেশে চা উৎপাদন বেড়ে দাঁড়াবে ১৪০ মিলিয়ন কেজি। চা বোর্ডের তথ্যে জানা যায়, প্রকল্পটি মন্ত্রিসভায় অনুমোদন লাভ করেছে। প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে, বাগান সম্প্রসারণ, নতুন যন্ত্রপাতি ক্রয়, গভীর ও হস্তচালিত নলকূপ স্থাপন, বাগান এলাকায় কূপ খনন, চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে নানা পদক্ষেপ ও সড়ক উন্নয়ন ইত্যাদি। প্রকল্পের আওতায় উন্নত জাতের চা চারা রোপণ করা হবে। ১০ হাজার হেক্টরে চা বাগান সম্প্রসারণ করা হবে। ১৫ হাজার চা শ্রমিকের গৃহ নির্মাণ ও ১৫ হাজার টয়লেট নির্মাণ করা হবে। প্রকল্প এলাকায় ৪৭ কিলোমিটার রাস্তা উন্নয়ন, ৫০টি কালভার্ট ও ৪টি সেতু নির্মাণ করা হবে। নারীর ক্ষমতায়নের জন্য ‘মাদার ক্লাব’ করা হবে। চায়ের চাষযোগ্য জমির পরিমাণ বর্ধিত করারও প্রচেষ্টা চলছে। আশা করা হচ্ছে চা শিল্প উন্নয়ন মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে চা শিল্পে বিপ্লব ঘটবে। দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে প্রচুর চা রফতানি করা সম্ভব হবে।