গত সোমবার ৭ অক্টোবর ‘বিশ্ব শিশু দিবস ও শিশু অধিকার সপ্তাহ-২০১৯’ শুরু হয়েছে। এবার এর প্রতিপাদ্য হচ্ছে- ‘আজকের শিশু আনবে আলো, বিশ্বটাকে রাখবে ভালো।
আজ সেই শিশুদের আমরা কতটুকু অধিকার দিতে পারছি? আজ সেই শিশুরা বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত। আমরা জানি পৃথিবীর আলো দেখার আগেই মাতৃগর্ভে শিশুর একটা জীবন আছে। সেই জীবনের সুরক্ষার বিষয়টি শিশুর প্রথম অধিকার। কিন্তু আমাদের দেশের দারিদ্র্যের পাশাপাশি অশিক্ষা ও নানান কুসংস্কারের কারণে মাতৃগর্ভে ভ্রূণে স্থিত হওয়া অবস্থা থেকেই অধিকাংশ শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত হয়। প্রসূতি মায়ের জন্য যথাযথ খাদ্য, পুষ্টি, পরির্চযা ও চিকিত্সা সেবা এখন পর্যন্ত পুরোপুরি নিশ্চিত করতে পারিনি আমরা। মাতৃগর্ভে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে টিকে থেকে সৌভাগ্যক্রমে যেসব শিশু পৃথিবীর আলো দেখার সুযোগ পায় তাদের অনেকের জন্ম যেন আজন্ম পাপ। জন্মের পর থেকেই নানা প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে তাদের বেড়ে উঠতে হয়। মুকুলেই ঝরে পড়ে তারা, যখন অন্য শিশুরা স্কুলে জ্ঞান অন্বেষণে ব্যস্ত, তখন এরা নিজেদের খাদ্যের সন্ধানে লিপ্ত। দারিদ্র্যের তাড়নায় অভিভাবকরা সন্তানকে কাজে নিয়োগ দিতে বাধ্য হচ্ছেন। কিন্তু সেই কাজটি কঠিন না সহজ, কাজটি কতটা ঝুঁকিপূর্ণ তা যেন অভাব-অনটনের দারিদ্র্যের কালো ছায়ায় হারিয়ে যায়। এই কাজটি করলে কী ক্ষতি হতে পারে তা অভাব-অনটনের আড়ালেই রয়ে যায়।
আজ শিশুর অভিভাবক বা মনিবরা অনেকে শিশু অধিকার বা শিশুশ্রম আইন সম্বন্ধে জানেন না আবার জানলেও মানা হয় না। জাতিসংঘ এবং এর অঙ্গ সংগঠন ইউনিসেফ শিশু অধিকার, তাদের স্বাস্থ্য রক্ষার বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। জাতিসংঘের শিশু সনদ এখন আন্তর্জাতিক আইন। এতে বলা হয়েছে শিশু বেঁচে থাকা, শিশুর জন্মগত অধিকার, স্নেহ-ভালোবাসা ও সমবেদনা পাওয়ার অধিকার, পুষ্টি, খাদ্য ও চিকিত্সা পাওয়ার অধিকার, অবৈতনিক শিক্ষার সুযোগ, খেলাধুলা, আমোদ-প্রমোদের পূর্ণ সুযোগ পাওয়ার অধিকার। একটি নাম ও নাগরিকত্ব। পঙ্গু শিশুদের বিশেষ যত্ন ও সেবা শুশ্রূষা পাওয়ার অধিকার। দুর্যোগের সময় সবার আগে ত্রাণ পাওয়ার অধিকার। সমাজের কাজে লাগার উপযোগী হয়ে গড়ে ওঠার এবং ব্যক্তি সামর্থ্য অর্থাত্ সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পাওয়ার অধিকার। শান্তি ও বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের মনোভাব নিয়ে গড়ে ওঠার সুযোগ পাওয়ার অধিকার আছে শিশুর। এসব অধিকার ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ও ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে বিশ্বে সব শিশু ভোগের অধিকার থাকবে। প্রশ্ন জাগে, জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী আমরা কতটুকু দিয়েছি বা দিচ্ছি শিশুদের অধিকার? শিশুশ্রম বন্ধে সরকার আপসহীনভাবে কাজ করে যাচ্ছেন, তবুও বন্ধ হচ্ছে না, থামছে না শিশুশ্রম। সরকার সামর্থ্যবান মানুষদের বঞ্চিত শিশুদের পাশে দাঁড়াতে আহ্বান করলেও তার তেমন সাড়া মেলেনি। শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয় বিশ্বের অবহেলিত ও বঞ্চিত শিশুদের প্রতি নজর না দিলে ২০৩০ সালের মধ্যে ছয় কোটি ৯০ লাখ শিশুর মৃত্যুর আশঙ্কা রয়েছে। আবার এর বাইরে ১৬ কোটি ৭০ লাখ শিশু চরম দরিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করবে। সেইসঙ্গে বাল্যবিয়ের শিকার হবে ৭০ কোটি মেয়েশিশু।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএ) জরিপ মতে, দেশে মোট ৩৪ লাখ ৫০ হাজার শিশু কোনো না কোনো কাজে যুক্ত। প্রায় ১২ লাখ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত এবং ১৬ লাখের বেশি শিশু শ্রমের কোনো মজুরি পায় না। ২০১৫ সালে প্রকাশিত National Child Labour Survey Report অনুযায়ী দেশে সব মিলিয়ে ২৪ লাখ শিশুশ্রমে নিয়োজিত রইয়েছে গ্রামীণ অঞ্চলে। শহরে এর ৫ লাখ ৭০ হাজার এবং সিটি করপোরেশন এলাকায় রয়েছে ৪ লাখ ৩০ হাজার। এর মধ্যে ২১ লাখ ছেলে আর সাড়ে ১৩ লাখ মেয়ে শিশু। সরকারি হিসাবেও শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে শিশুশ্রমের প্রবণতা বেশি। কম মজুরি, মাত্রারিক্ত খাটুনি ও ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম নিয়ে উদ্বেগজন অবস্থায় আছে শিশুশ্রম পরিস্থিতি। ঝুঁকিপূর্ণ ৩৮টি কাজ দিন-রাত শিশুদের দিয়ে করানো হলেও শিশু শ্রম প্রতিরোধকারী আইন সেখানে কাজ করছে না। দরিদ্র, এতিম, অসহায় শিশুদের ব্যাপারে শুধু আমাদের দেশ থেকেই নয়,সারা বিশ্ব তথা সমাজ থেকে বিবেক, মূল্যবোধ, নীতি, মনুষ্যত্ব, মানবতা যেন আজ বিদায় নিতে চলেছে। সরকার যথেষ্ট পরিমাণ শিশুশ্রমিকদের জন্য বরাদ্দ না করলেও যেটুকু বরাদ্দ করেন তা শিশুশ্রমিকদের হাতে আর আসে না। এর বাস্তব প্রমাণ আমি নিজেই। র্দীঘ ১২ বছর শিশু শ্রমিক থেকে আজ তরুণ শ্রমিক আমি। আমি তো কোন সুযোগ সুবিধা পাইনি শিশুশ্রমিক বলে। শুধু আমি একা নই আমার মতো লাখো হাজার শিশু এ থেকে বঞ্চিত।
গুণীজনেরা বলেন, রাষ্ট্রে যদি শিশুদের ন্যায্য অধিকার রক্ষা করতে না পারে তাহলে তার প্রভাব ভবিষ্যত প্রজন্মের উপর পড়বে। কাজ করতে গিয়ে ৫৭ শতাংশ শিশু নির্যাতনের শিকার হয়। আবার মালিক পক্ষ, অদক্ষ শ্রমের দোহাই দিয়ে শিশুটিকে ন্যায্য পারিশ্রমিক দেয় না। অতএব, কেবল আইন প্রণয়ন করলেই চলবে না , আইনের প্রয়োগ করতে হবে। সুস্থ শিশু,সুস্থ সমাজ,ও জাতি বিনির্মাণে পরিপক্ক ও যোগ্যতম হওয়ার ক্ষেত্রে শিশুর বিকল্প নেই। তাই এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য রাষ্ট্রীয় র্পযায়ে এসব শিশুর আনন্দময় জন্য ভর্তুকি দিয়ে হলেও তাদের পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। জাতিগঠনে শিশুদের জন্য শ্রম বিমুখ কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। শিশুশ্রম রোধে সামাজিক আন্দোলন জোরদার করতে হবে বলে আমরা মনে করি ।