বর্ষা মৌসুমের শেষে জেলার বেশকিছু এলাকায় আকস্মিক নদী ভাঙন শুরু হয়েছে। অব্যাহত নদী ভাঙনে আতঙ্ক বিরাজ করছে ভাঙন কবলিত এলাকার মানুষের মাঝে। ইতোমধ্যে রাক্ষুসী নদী গ্রাস করে নিয়েছে উজিরপুর উপজেলার বড়াকোঠা ইউনিয়নের লস্করপুরে একটি বাজারের সাতটি ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান। এছাড়া বরিশাল সদর, বাকেরগঞ্জ, গৌরনদী, হিজলা, মুলাদী ও মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার বেশকিছু এলাকায় নদী ভাঙন শুরু হয়েছে।
এরমধ্যে কালাবদর ও তেঁতুলিয়া নদীর তীরে অবস্থিত মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার শ্রীপুর ইউনিয়ন সবচেয়ে বেশি ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে। অব্যাহত ভাঙনে আতঙ্কে রয়েছেন ওই ইউনিয়নের ২০ হাজার মানুষ। নদী বেষ্টিত ওই ইউনিয়নের মানুষকে গত কয়েক বছর ধরে নদী ভাঙনের সাথে লড়াই করে বেঁচে থাকতে হচ্ছে। অনেকেই ভিটে-মাটি হারিয়ে ইতোমধ্যে নিজ জন্মস্থান ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন।
নদী ভাঙনের হাত থেকে বাঁচতে সম্প্রতি শ্রীপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী লোকমান হোসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে খোলা চিঠি লিখেছেন। এর আগে ২০১৮ সালে বাহেরচর শ্রীপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী নুসরাত জাহানও শিক্ষামন্ত্রীর কাছে নদী ভাঙনরোধ ও বিদ্যালয় ভবনকে রক্ষার দাবি জানিয়ে চিঠি লিখেছে।
নদী ভাঙনরোধের দাবিতে ওই ইউনিয়নের বাসিন্দারা প্রায়ই মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছেন। জনপ্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সেখানে গিয়ে স্থানীয়দের আশ্বস্ত করলেও বাস্তবে নদী ভাঙন যেন পিছু ছাড়ছে না ইউনিয়নবাসীকে।
শ্রীপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী লোকমান হোসেন জানান, নদী ভাঙনের ফলে ইতোমধ্যে প্রায় পাঁচশ’ ঘরবাড়ি, শ্রীপুর বাজার, ইউনিয়ন ভূমি অফিস, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, দু’টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি মহিলা মাদ্রাসা, একটি কওমি মাদ্রাসা, একটি দাখিল মাদ্রাসা, হাজার হাজার হেক্টর কৃষি জমিসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বিলীন হয়ে গেছে।
তিনি আরও জানান, প্রায় তিন হাজার মানুষ নদী ভাঙনের কারণে গৃহহীন হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। গত তিন বছর ধরেই ভাঙছে শ্রীপুর সংলগ্ন তেঁতুলিয়া নদী। এ নদীর ভাঙন বর্তমানে পূর্বের থেকে আরও ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। জরুরি ভিত্তিতে এ ভাঙন প্রতিরোধ করতে না পারলে পুরো ইউনিয়ন নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
শ্রীপুর ইউনিয়নকে চলমান নদী ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার কথা জানিয়েছেন উপজেলার নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান একেএম মাহফুজুল আলম লিটন। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোঃ সফিউদ্দিন জানান, ওই ইউনিয়নকে নদী ভাঙন থেকে রক্ষায় জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে প্রকল্প গ্রহণ করে তা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। প্রকল্প অনুমোদন হলেই কাজ শুরু করা হবে।
সূত্রমতে, গত ২৮ অক্টোবর বিকেলে আকস্মিক সন্ধ্যা নদীর ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে উজিরপুর উপজেলার বড়াকোঠা ইউনিয়নের লস্করপুর বাজারের সাতটি দোকান, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) পল্টুনসহ আবাদি জমি।
স্থানীয়রা জানান, কিছু বুঝে উঠার আগেই লস্করপুর বাজারের সাতটি ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান ও বিআইডব্লিউটিএ’র পল্টুনসহ আবাদি জমি মুহুর্তের মধ্যে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এর আগে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে লস্করপুর গ্রামের অসংখ্য বসতবাড়ি ও ফসলি জমি। সন্ধ্যা নদীর ভাঙনে আশোয়ার সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় কাম সাইক্লোন শেল্টার, কমলাপুর, শিকারপুর বন্দর, দাসেরহাট, হানুয়া, চথলবাড়ি, মালিকান্দা, মীরেরহাটসহ দু’শতাধিক পরিবারের বাড়ি-ঘর, পানের বরজ নদীগর্ভে বিলিন হয়ে গেছে।
থমকে আছে ২০৯ কোটি টাকার প্রকল্প ॥ মাঝ পথে এসে থেমে গেছে বরিশাল সদর উপজেলার চরবাড়িয়া ইউনিয়ন নদী ভাঙনের হাত থেকে রক্ষায় সরকারের নেয়া ২০৯ কোটি টাকার প্রকল্প। ফলে ওই এলাকায় কীর্তনখোলা নদীর ভাঙনের তীব্রতা ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়েছে। গত মঙ্গলবার সকাল থেকে হঠাৎ করে ওই এলাকায় নতুন করে শুনু হয়েছে নদী ভাঙন। বুধবার সকাল পর্যন্ত ভাঙনের তীব্রতায় কয়েক লাখ টাকার গাছ-পালাসহ নদী গর্ভে বিলিন হয়ে গেছে প্রায় তিনশ’ মিটার জমি। এখনো ভাঙন আতঙ্কে রয়েছে নয়টি বসতঘরসহ একটি মাধ্যমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়। যা রয়েছে নদী ভাঙনের স্থান থেকে এক থেকে দুইশ’ মিটারের মধ্যে। তবে হঠাৎ করে নদী ভাঙনের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকেই দায়ি করেছে ভাঙন কবলিত এলাকার মানুষ। অনিময় এবং অবহেলার কারনেই নতুন করে ভাঙন শুরু হয়েছে বলে দাবি করেছেন এলাকাবাসি।
স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ইউনিয়নবাসির দাবির প্রেক্ষিতে ভাঙনের হাত থেকে চরবাড়িয়া ইউনিয়নকে রক্ষার জন্য প্রকল্প গ্রহন করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এমনকি বরিশাল সদর আসনের এমপি কর্ণেল (অব.) জাহিদ ফারুক শামীম পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বগ্রহনের পর ২০৯ কোটি টাকার প্রকল্পের অগ্রগতি হয়। সর্বশেষ গত ফেব্রুয়ারী মাসে চরবাড়িয়ায় কীর্তনখোলা নদীর তীরবর্তী প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ভাঙন প্রতিরোধে নেয়া জিও ব্যাগ, ব্লক এবং ড্রেজিং প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু করা হয়। কিন্তু ওই প্রকল্পের পুরো কাজ বাস্তবায়নের আগেই মাঝ পথে থেমে যায়। চরবাড়িয়ার নদী ভাঙন এলাকার বাসিন্দারা জানান, প্রায় দুই মাস ধরে ভাঙন প্রতিরোধে নেয়া প্রকল্পের কাজ বন্ধ রয়েছে। ফলে পূর্ণরায় নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে।
বরিশাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবস্টেশন ইঞ্জিনিয়ার জাবেদ ইকবাল বলেন, ভাঙনের খবর পেয়ে আমি নিজেই ওই এলাকা পরিদর্শন করেছি। আগামী ২ নভেম্বর থেকে ওই এলাকায় ভাঙন প্রতিরোধে নেয়া প্রকল্পের কাজ পুনরায় শুরু করা হবে। যেসব পয়েন্টে নতুন করে ভাঙন শুরু হয়েছে সেখান থেকেই আগে কাজ শুরু করা হবে।
তিনি আরও বলেন, খুলনা শিপিয়ার্ডের সাথে চুক্তি সাপেক্ষে প্রকল্পের আওতায় ৪ লাখ ৭৫ হাজার জিও ব্যাগ এবং সাড়ে ১২ লাখ ব্লক ফালানো হবে। সেই সাথে ভাঙন এলাকায় নদীর অপর তীরে ড্রেজিং কার্যক্রম রয়েছে এই প্রকল্পে। কিন্তু কাজ শুরুর পরে এরইমধ্যে ২ লাখ ৩৫ হাজার জিও ব্যাগ নদীতে ফেলা হয়েছে। কিন্তু জিও ব্যাগে আমাদের ডিজাইন অনুযায়ী বালু না দেয়ায় পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রীর নির্দেশে প্রকল্পের কাজ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ওইসময় ডিজাইন অনুযায়ী বালু না পাওয়ায় এই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। এখন ডিজাইন অনুযায়ী বালু পাওয়া গেছে কিন্তু শ্রমিক না পাওয়ায় কাজ শুরুতে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার বিকেলে বরিশাল সদর উপজেলার লাহারহাট গ্রামের চলমান নদীভাঙন কবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তারা।