*আহত শতাধিক
*৫টি তদন্ত টিম গঠন
*৮ ঘন্টা পর ট্রেন চলাচল শুরু
ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার মন্দভাগ রেলওয়ে স্টেশনে মঙ্গলবার ভোর রাতে চট্টগাম থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী আন্তঃনগর ট্রেন তুর্ণা নিশিতা এবং সিলেট থেকে ছেড়ে আসা চট্টগ্রামগামী আন্তঃনগর উদয়ন এক্সপ্রেস ট্রেনের সংঘর্ষ হয়েছে। এতে শতাধিক নারী-পুরুষ আহত হয়েছে। প্রশাসনের হিসেব অনুযায়ী মারা গেছেন ১৬জন। তবে এ হতাহতের সংখ্যা আরো বেশী হতে পারে। হতাহত সবাই উদয়নের ট্রেনের যাত্রী। এ ঘটনায় মহামান্য রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও স্থানীয় সংসদ সদস্য আইনমন্ত্রী গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।
রেলওয়ে মন্ত্রনালয়ে দায়িত্ব নিয়োজিত মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন বেলা ১১টায় দুর্ঘটনস্থল পরিদর্শনকালে বলেন, প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে চালক সিগন্যাল অমান্য করায় অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনা ঘটে। এরপরও আমরা রেলমন্ত্রণালয়ে ২টি, রেলওয়ে বিভাগ ২টি ও জেলা প্রশাসক ১টিসহ মোট ৫টি তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। এ বিষয়ে দায়িদের বিরোদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। মন্ত্রী ঘটনাস্থল আসার পূর্বেই সকাল ১০টা ৫০ মিনিটে রেল যোগাযোগ স্বাভাবিক হয়।
জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, রেলওয়ে মহা-পরিচালক, উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। ঘটনার পর থেকেই ঢাকা-চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম-সিলেট, নোয়াখালী-ঢাকা, নোয়াখালী-সিলেট রেলপথে সবধরনের ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। রেলওয়ে ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুইটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আখাউড়া ও লাকসাম থেকে রিলিফ ট্রেন এসে উদ্ধার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া সেনাবাহীনি, বিজিবি, ফায়ারসার্ভিস, পুলিশ, জেনেটিক কম্পিউটার একাডেমি মুক্ত স্কাউট গ্রুপ, সিডিসি মুক্ত স্কাউট গ্রুপ, স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুব লীগ স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো উদ্ধার কাজে সহযোগীতা করছে।
রেল সচিব মোহাম্মদ মোফাজ্জল হোসেন পরিদর্শন করেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন রেলওয়ে পক্ষ থেকে ২টি ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১টি তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে। রেলের দু’টি কমিটির একটিতে প্রধান যান্ত্রীক প্রকৌশলী (পূর্বাঞ্চল) মিজানুর রহমানকে প্রধান করে ৪ সদস্যের একটি, চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা নাসির উদ্দিনকে প্রধান করে ৪ সদস্যের একটি ও জেলা প্রশাসশনের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মিতু মরিয়মকে প্রধান করে ৩ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে।
রেলওয়ে স্টেশন, প্রতক্ষদর্শী ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা আন্তঃগর ট্রেন ঢাকাগামী তুর্ণা নিশিতা মঙ্গলবার ভোর রাত ২টা ৪৮মিনিটে শশীদল রেলওয়ে স্টেশন অতিক্রম করে মন্দভাগ রেলওয়ে স্টেশনের দিকে রওয়ানা করে। মন্দভাগ রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার স্টশনে প্রবেশের আগেই আউটারে থামার জন্য লালবাতি জালিয়ে সংকেত দেয়। অপরদিকে সিলেট থেকে ছেড়ে আসা চট্টগ্রামগামী উদয়ন এক্সপ্রেস কসবা রেলওয়ে স্টেশন ছেড়ে মন্দভাগ রেলওয়ে স্টেশনে প্রবেশ পথে স্টেশন মাস্টার তাকে মেইন লাইন ছেড়ে দিয়ে ১ নম্বর লাইনে আসার সংকেত দেয়। ওই ট্রেনের চালক ১ নম্বর লাইনে প্রবেশ করার সময় ছয়টি বগি প্রধান লাইনে থাকতেই অপর দিক থেকে আসা তুর্ণা নিশিতা ট্রেনের চালক সিগনাল (সংকেত) অমান্য করে দ্রুত গতিতে ট্রেন চালায়। এ সময় উদয়ন ট্রেনের মাঝামাঝি তিনটি বগির সাথে তূর্ণা নিশিতার ইঞ্জিনের সংঘর্ষ হয়। এতে উদয়ন ট্রেনের তিনটি বগি দুমড়ে মুচড়ে যায়। উদয়ন ট্রেনের ১৬জন যাত্রী মারা যায় এবং শতাধিক নারী পুরুষ যাত্রী আহত হয়েছে। নিহতদের পরিচয় জানতে বায়েক শিক্ষা সদন উচ্চ বিদ্যালয়ে একটি অস্থায়ী তথ্য কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সেখানে সার্বক্ষনিক দায়িত্ব পালন করছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সার্বিক মো.সামছুজ্জামান, কসবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাসুদ উল আলম, সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো.জাহাঙ্গীর হোসেন ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা তাপস চক্রবর্তী।
অস্থায়ী তথ্যকেন্দ্র থেকে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. সামশুজ্জামান ১৫ জন নিহতের পরিচয় জানান। নিহতরা হলো; ১। মজিবুর রহমান (৫৫) পিতা আবদুল জলিল, পশ্চিম রাজারগাঁও, হাজিগঞ্জ, চাঁদপুর। ২। কাকলী (২০), স্বামী মঈন উদ্দিন, দক্ষিণ ঈশানপুর, হাইমচর, চাঁদপুর, ৩। ইয়াছিন আরাফাত (১২), বাহুলা, হবিগঞ্জ। ৪। মো. রিপন মিয়া (২৫) পিতা- আজমতউল্লাহ, সৈয়দাবাদ, হবিগঞ্জ। ৫। সুজন আহমেদ(২৪), পিতা মৃত আবদুল হাশিম, তীরগাঁও, চুনারুঘাট, হবিগঞ্জ। ৬। জাহেদা খাতুন (৪৮), স্বামী মুসলেম মিয়া, গাজীপুর, শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার। ৭। কুলসুম বেগম (৩০), স্বামী মজিবুর রহমান, পশ্চিমরাজারগাঁও, হাজিগঞ্জ, চাঁদপুর। ৮। আল আমীন (৩০), পিতা আইয়ুব হোসেন, মদনমূরক, বানিয়াচং, হবিগঞ্জ। ৯। মরিয়ম বেগম (৬), পিতা- জাহাঙ্গীর, ঈশানপুর, হাইমচর, চাঁদপুর। ১০। আলী মো. ইউসুফ (৩২) আনোয়ারপুর, হবিগঞ্জ। ১১। পিয়ারা বেগগম, স্বামী আবদুস সালাম, আহমাদাবাদ, চুনারুঘাট, হবিগঞ্জ। ১২। আদিবা (২), পিতা- সোহেল, বড়বাজার, বানিয়াচং, হবিগঞ্জ। ১৩। সোহামনি (৩), পিতা সোহেল রানা, বাহ্মণবাড়িয়া। ১৪। রবী হরিজন (২৩), পিতা শংকর হরিজন, মাইজদী, নোয়াখালী। ১৫। ফারজানা (১৫), পিতা বিল্লাল মিয়াজি, উত্তর বালিয়া, চাঁদপুর। একজনের পরিচয় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
মন্দভাগ রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার মো. জাকের হোসেন চৌধুরী বলেন, নিশিতা ট্রেনটি আউটারে মেইন লাইনে থামার সংকেত দেয়া হয়েছিল। উদয়ন ট্রেনটিকে মেইন লাইন থেকে ১ নং লাইনে আসার সংকেত দেয়া হয়েছিল। সেই হিসাবে উদয়ন ট্রেন ১ নম্বর লাইনে প্রবেশ করছিল। এ সময় নিশিতা ট্রেনের চালক সংকেত অমান্য করে উদয়ন ট্রেনের উপর উঠে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়।
কসবা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. কে.এম হুমায়ুন কবির বলেন, কসবা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে তিনজন মারা গেছে। ২৯জনকে চিতিৎসা দেয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে দুই-তিনজন ছাড়া বেশীর ভাগই গুরুতর আহত।
উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট রাশেদুল কাওসার ভুইয়া জীবন বলেন, দলীয় নেতা-কর্মীদের নিয়ে উদ্ধার কাজ করছি এবং উভয় ট্রেনের যাত্রীদের নাস্তা-পানি দেয়া হচ্ছে ও যাতায়াতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বায়েক শিক্ষা সদন উচ্চ বিদ্যালয়ে একটি অস্থায়ী তথ্য কেন্দ্র খোলা হয়েছে ও তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাসুদ উল আলম বলেন, ট্রেন দুর্ঘটনায় আহতদের চিকিৎসা সেবা দেয়া হচ্ছে এবং নিহত পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা করে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহযোগীতা প্রদান করা হচ্ছে