মৌলভীবাবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল, কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলার পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে সবুজ টিলার পরতে পরতে কমলার রাজত্ব। স্রেফ উদ্যোমতা আর কঠোর পরিশ্রমে চাষীরা যে কঠিন পাহাড়ের বুক থেকে সু-মিষ্ট রসের ফসল সফলভাবে চাষ করতে পারে তার প্রমাণ কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলার কমলা লেবুর বাগানগুলি। শীতের শুরুতে সকালে কাঁচা পাকা কমলা লেবুর গায়ে জমে থাকা শিশির বিন্দুর উপর রোদের কিরণ মনে হয় যেন কমলা নয় এক এক খন্ড হীরক বল তার আলোর বিকিরণ ঘটাচ্ছে। এমন নয়ন জোড়ানো দৃশ্য এখন এতদঞ্চলের কমলা বাগানে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রোগ-বালাই, বিভিন্ন পোকার আক্রমণ, বন্য প্রাণীর উৎপাত, চোরের উপদ্রব, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ এবং ভাল চারা ও কীটনাশকের অভাব, বাজারজাত করণে প্রশাসনিক হয়রানী ইত্যাদি কারণে একসময় কমলার চাষ ও উৎপাদন কমে যায় কমলা চাষে বিখ্যাত এ অঞ্চলটির। কিন্তু চাষীদের উৎসাহ ও উদ্যোগে, সরকারের সহযোগিতায় এ অঞ্চলে আবারো কমলার চাষ শুরু হয়। জেলার সবচেয়ে বেশী কমলা চাষ হচ্ছে জুড়ী উপজেলায়। উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখন কমলা চাষ হচ্ছে। জুড়ীর হায়াছড়া, শুকনাছড়া, লালছড়া, কচুরগুল, লাঠিটিলা, দিলকুশ গ্রামগুলোতে ব্যাপক আকারে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কমলা চাষ হচ্ছে। তাছাড়া জেলার কুলাউড়া ও বড়লেখা উপজেলার পাহাড়ি এলাকায় নতুন নতুন কমলালেবুর বাগান সৃষ্টি হচ্ছে, কিছুকিছু বাগানে এ বছর ভাল ফলন পাওয়া যাচ্ছে। তাছাড়া শ্রীমঙ্গল উপজেলার পাহাড়ি টিলাতে কমলা চাষ সম্প্রসারিত হচ্ছে। অতীতে চাষীদের উৎপাদিত কমলা বিক্রি করতে প্রশাসনের অনুমতি নিতে হতো। দেশীয় কমলাকে ভারতীয় আখ্যায়িত করে ভাগ বসাতো পুলিশ-বিজিবি। তাদেরকে খুশী করতে না পারলে অত্যাচারের পাশাপাশি জেল-জরিমানা বহন করতে হত। প্রশাসনের এ হয়রানীমূলক আচরণের কারণে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন কমলা চাষিরা। এ ধারাবাহিকতা চলতে থাকায় কমলাচাষে ধ্বস নামে। কমলার অতীত ঐতিহ্য রক্ষা ও দেশের চাহিদা পূরনে ২০০১ সালে বৃহত্তর সিলেট জেলায় কমলা ও আনারস উন্নয়নসহ সমন্বিত কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। মৌলভীবাজার কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তর এর মাধ্যমে হায়াছড়া ও কচুরগুল এলাকায় ৬৯ হেক্টর জমি নিয়ে এ প্রকল্পের যাত্রা শুরু হয়। এ পর্যন্ত জুড়ী উপজেলায় ৯০হেক্টর জমিতে প্রায় ৫৭৫টি কমলা বাগান সৃষ্টি হয়েছে। ২০০৫ সালে এ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলে চাষিদের চাহিদা ও দাবিতে প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি করে ২০০৮ সালের জুন পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। এরপর সেটি বন্ধ হয়ে যায়। প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত চাষিরা নতুন নতুন বাগান সৃষ্টি করছেন। সৃজনকৃত বাগানে ফলন আসতে ৭/৮ বছর সময় লাগে। হায়াছড়া, শুকনাছড়া, লালছড়া, কচুরগুল, লাঠিটিলা, দিলকুশ এলাকার চাষীরা জানান, নানা রোগ বালাই থাকা সত্ত্বেও অন্য দুই বছরের চাইতে এ বছর ফলন তুলনামূলক ভালো হয়েছে। দামও ভালো পাওয়া যাচ্ছে। প্রতি হালি বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৬০ টাকা পর্যন্ত। তবে এ ফলন পুরোনো গাছের, নতুন গাছের ফলন আসলে আরও ভালো হবে এমনই আশা চাষীদের। হায়াছড়া গ্রামের কমলাচাষি ইব্রাহিম আলী জানান, যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ গভীর নলকুপ স্থাপন, কীটনাশক ও কৃষি কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পেলে তাদের নানা সমস্যা উত্তরণের পথ সুগম হত। চাষীদের সুবিধার্থে পূর্বের সেই প্রকল্পটি চালু হলে এখানকার কমলা দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব হবে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে এবছর মৌলভীবাজার জেলার ৪টি উপজেলায় প্রায় সাড়ে ৩ হাজার বাগানে কমলা চাষ করা হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় চলতি মৌসমে এসব বাগান থেকে সাড়ে ৫ হাজার মে.টন কমলা বাজারজাত করা সম্ভব হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।