সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকার পরেও আইন অমান্য করে প্রশাসনের নাকের ডগায় লালমনিরহাটে চলছে রমরমা কোচিং-প্রাইভেট বাণিজ্য। পুরানো কৌশল পরিবর্তন করে শিক্ষকরা নতুনভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের এই শিক্ষা বাণিজ্য।
লালমনিরহাট জেলা শহরের খোর্দ্দসাপটান (অভিযান পাড়ায়) অবস্থিত এভারগ্রীন কোচিং সেন্টারে গেলে দেখা যায় বেশ খোলামেলা ভাবেই কোচিং পরিচালিত হচ্ছে। যেখানে বিভিন্ন ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীরা ক্লাস করছে। শিক্ষকদের জন্য সরকার কোচিং বাণিজ্য নিষিদ্ধ করলেও, লালমনিরহাটে বিভিন্ন স্কুল ও কলেজের শিক্ষকগন সুকৌশলে পরিকল্পনা করে চালিয়ে যাচ্ছে তাদের এই কোচিং বাণিজ্য। আর স্কুল ও কলেজের শিক্ষক দ্বারা পরিচালিত এভারগ্রীন নামের কোচিং-টি পরিচালনা করছেন আদিতমারী কান্তেশ^র বর্মন স্কুল এ- কলেজের ভূগোল (প্রভাষক) মোঃ সামছুল হক।
বুধবার (১৩ নভেম্বর) বিকেলের দিকে এভারগ্রীন কোচিং সেন্টারে শিক্ষকদের সাথে কথা বলতে গেলে সেখানকার শিক্ষকগন সাংবাদিকদের সাথে খারাপ ব্যবহার করেন।
সরকারি বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও এমপিওভুক্ত বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা বাসা ভাড়া নিয়ে নামে-বেনামে চালাচ্ছেন এই কোচিং বাণিজ্য। কোন কোন শিক্ষক নিজের বাড়িতে ৩০/৩৫ জোড়া বেঞ্চ তৈরী করে ৫০ থেকে ৬০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে প্রাইভেট পড়াচ্ছেন। একদিন পর পর এক একটি ব্যাচ পড়ানো হয়। এভাবে ৭/৮টি ব্যাচ পড়ানো হচ্ছে। ফলে ওই সব স্কুলের শিক্ষকরা বিভিন্ন অজুহাতে অনুপস্থিত থেকেও দেদারসে চালাচ্ছে কোচিং প্রাইভেট বাণিজ্য।
কেউ কেউ ক্ষমতাসীন দলের নেতা সেজে কোচিং সেন্টার চালাচ্ছে এবং বীরদাপটে বলছেন সারাদেশে অভিযান চললেও আমাদের কোচিং সেন্টারে কেউ অভিযান চালাতে পারবেন না, সব ম্যানেজ করা আছে। প্রশাসনের নাকের ডগায় এসব অবৈধ কার্যক্রম চলায় দরিদ্র শিক্ষার্থী, অভিাবক ও সচেতন মহলের প্রতিনিধিরা হতাশা জানিয়েছেন। আর এসব কোচিং সেন্টারে সকাল সাড়ে ৭টা থেকে দুপুর ও বিকেলে এমনকি সন্ধ্যা পর্যন্ত চলছে শিক্ষকদের প্রাইভেট পাঠদান।
সরেজমিনে দেখা গেছে, জেলা শহরেই রয়েছে প্রায় অর্ধশতাধিক কোচিং সেন্টার। অবৈধ কোচিং চালানোর বিরুদ্ধে দেশে আইন থাকলেও এর বাস্তব প্রয়োগ না থাকায় দিনে দিনে কোচিং, প্রাইভেট সেন্টার ব্যাঙের ছাতার মত গড়ে উঠেছে। ফজলল করিম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে সামেনে কোয়ান্টাম কোচিং সেন্টার, টিএন্ডটির সামনে ভারটেক্স কোচিং সেন্টার, গিয়াস উদ্দিন স্কুলের সামনে আইডিয়াল কোচিং সেন্টার, এনএসআই অফিসের ভবনের সামনে লাইসিয়াম কোচিং সেন্টার, এ্যাপোলো ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পাশে অংকুশ কোচিং সেন্টার, নয়ারহাটে রেনেসাঁ কোচিং সেন্টার, মিশনমোড় এলাকার সাইফুর’স কোচিং সেন্টার, সাপ্টিবাড়ি উচ্চবিদ্যালয়ের সামনে সেল্ফ কোচিং সেন্টার।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন অভিভাবক বলেন, ‘স্কুল, কলেজ ও মাদরাসাগুলোতে ঠিকভাবে ক্লাস হয় না। বছরের শুরুতে বিনামূল্যে বই সরকার দিলেও সময়মত ক্লাস নিচ্ছে না শিক্ষকরা। কলেজগুলোতে শিক্ষকদের কথিত অফডের কারণে সপ্তাহের ৩/৪ দিন পালা করে শিক্ষকগণ কলেজে আসেন না। কলেজে ৯টায় ক্লাস শুরু করে দুপুরের আগে তালা ঝুলিয়ে দেন’।
কোচিংয়ে পড়ানোর বিষয়ে একাধিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের কাছে জানতে চাওয়া হলে তারা বিষয়টি স্বীকার করেন। তবে অনেকেই বলেন, ‘আমাদের এলাকায় এমন কোন প্রতিষ্ঠান নেই যার ২/৪ জন্য শিক্ষক প্রাইভেট কোচিং বাণিজ্যের সাথে যুক্ত নেই। যার প্রমান পাবেন জেলা শহরের এভারগ্রীন কোচিং সেন্টারে গেলে। ১৪ বছর ধরে জেলা শহরের এভারগ্রীণ কোর্চিং সেন্টারসহ প্রায় সব কোচিং সেন্টারই বিভিন্ন স্কুল কলেজের শিক্ষকরাই চালিয়ে যাচ্ছে। সেখানেই রয়েছে এমপিওভুক্ত বিভিন্ন স্কুল কলেজের ৬/৭ জন শিক্ষক। আর তারাই পরিকল্পনা করে চালিয়ে যাচ্ছে কোচিং বাণিজ্য। কিন্তু আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারিনা। কারণ তারা দলীয় ছত্রছায়ায় অনেক প্রভাবশালী। কিছুকিছু শিক্ষক তাদের বাসা বাড়িতে প্রকাশ্যে প্রাইভেট পড়িয়ে থাকেন।’
জেলা শহরের এভারগ্রীন কোচিং সেন্টারে যেসব এমপিওভুক্ত স্কুল ও কলেজের শিক্ষক রয়েছেন তাদের মধ্যে আদিতমারী কান্তেশ^র স্কুল এ- কলেজের আই.সি.টি প্রভাষক মোঃ ওয়াজেদুল ইসলাম ফাতেমি, কালেক্টরেট কলেজিয়েট স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোঃ রশিদুল ইসলাম, বেগম কামরুন্নেছা ডিগ্রী কলেজের সহ-অধ্যাপক মোঃ জিকিরুল ইসলাম ফাতেমি, বেগম কামরুনেছা ডিগ্রী কলেজের জীববিজ্ঞানের (সহ-অধ্যাপক) যিনি প্রাইভেট স¤্রাট নামে পরিচিত মোঃ জিয়াউর রহমান, বালা পুকুর উচ্চবিদ্যালয়ের (সহ-শিক্ষক) পদার্থ অবিনাস চন্দ্র রায়, নেছারিয়া কামিল মাদ্রাসার (সহ-শিক্ষক) রসায়ন মোঃ লাবলু মিয়া। এছাড়াও ওই কোচিং সেন্টারে খন্ড কালিন শিক্ষক যারা ক্লাস পেমেন্ট সিষ্টেমে ক্লাস নেন। এসব শিক্ষকের বিরুদ্ধে তাদের নিজ-নিজ স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীদের কোচিং করার জন্য বাধ্য করানো এবং শিক্ষার্থীদের দিয়ে লিপলেট বিতারনের অভিযোগও রয়েছে। এসব শিক্ষকরা লালমানরহাট জেলা শহর এবং শহরের বাইরে কোচিং বাণিজ্য করে অনেকেই হয়েছেন প্রচুর সম্পদের মালিক।
এ বিষয়ে প্রতিমাসের আইনশৃংঙ্খলা সভায় জেলা প্রশাসকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আলোচনাও হয়। তবে এত কিছুর পরেও চলছে কোচিং সেন্টার।
অভিভাবকরা বলেন, বছরের পর বছর ধরে একই প্রতিষ্ঠানে থাকার ফলে শিক্ষকরা প্রাইভেট পড়ানোর নামে কোচিং সেন্টার গড়ে তুলেছেন এবং এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছেন যাতে ছাত্র-ছাত্রীরা প্রাইভেট পড়তে বাধ্য হয়। জেলা শহরের প্রায় অর্ধশত শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোচিং বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের অভিযোগ রয়েছে। অপরদিকে শিক্ষকদের বদলি না করার পেছনে রাজনৈতিক চাপ, তদবির ও অনৈতিক আর্থিক লেনদেনও এজন্য দায়ী বলে জানান তিনি।
সাইফুর’স কোচিং সেন্টারের লালমনিরহাট শাখার পরিচালক হেলাল মিয়া জানান, আমরা অ্যাকাডেমিক কোন কোর্স চালাই না। আর এখানে সরকারী কোন স্কুল কলেজের শিক্ষক জড়িত নেই। এখানে যারা ক্লাস নেন তারা সবাই সাইফুর’স এর বেতন ভুক্ত শিক্ষক। যারা ঢাকা এবং রংপুর থেকে এসে লালমনিরহাট শাখায় ক্লাস নেন।
সম্প্রতি বাংলাদেশে সরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য অবৈধ বলে রায় দিয়েছে হাইকোর্ট। সেই সঙ্গে শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য বন্ধের নীতিমালা-২০১২কে বৈধ বলে রায় এসেছে। এই নীতিমালার বাইরে গিয়ে সরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের কেউ শিক্ষার্থীদের পড়াতে পারবেন না।
কোচিং বাণিজ্য বন্ধের নীতিমালাসহ শিক্ষকদের করা কয়েকটি রিটের ওপর শুনানি শেষে এই রায় দিয়েছেন হাইকোর্টের বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের সমন্বয়ে গঠিত দ্বৈত বেঞ্চ। দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী খুরশীদ আলম বলছেন, অ্যামিকাস কিউরিসহ সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলে হাইকোর্ট সরকারি স্কুলে কোচিং বাণিজ্য 'অবৈধ' বলে রায় দিয়েছেন।