কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় চলনবিলের চৌগ্রামের রাজা রমণীকান্ত রায় এর মাটি দিয়ে তৈরি শতবর্ষী স্কুল ঐতিহ্য হারাচ্ছে। ঘরের দরজা ভেঙে পড়ায় স্কুলের ভেতরে রাত-দিন নেশাখোর ও বখাটেদের উৎপাত বেড়েছে। একদিকে অযত্ম-অবহেলায় শতবর্ষী ঘরগুলো নষ্ট হচ্ছে অন্যদিকে ভেঙে পড়েছে শিক্ষা ব্যবস্থা। দ্রুত চলনবিলের এই ঐতিহ্যবাহী শতবর্ষী মাটির স্কুলটিকে সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
সূত্রে জানা যায়, উপজেলার চৌগ্রাম জমিদার বাড়ি সংলগ্ন একশ’ দশ বছর আগে ততকালীন রাজা রমণীকান্ত রায় মাটি দিয়ে একটি স্কুল ঘর তৈরি করে দিয়েছিলেন। টিনের চালার এই স্কুল ঘরের বৈশিষ্ট্য কোন জানালা নেই। ঘরের দু’পাড়েই রয়েছে দরজা ও বারান্দা। মোট ৪৮ টি দরজা রয়েছে মাটির তৈরী শতবর্ষী এই স্কুল ঘরে। এখন সেই রাজাও নেই, নেই জমিদারী প্রথা। তবে ওই স্কুল ঘরটি এখনও পাঁজর সোজা করে দাঁড়িয়ে থেকে প্রাচীন স্থাপত্যের নিদর্শন জানান দিয়ে যাচ্ছে। নিভৃত পল্লী এলাকার শতবর্ষী এই চৌগ্রাম হাইস্কুলের ইতিহাস যেমন সমৃদ্ধ তেমনি বৃহৎ শিক্ষিত জনগোষ্ঠির কিয়দংশ তৈরীর কাজে প্রশংসনীয় ভুমিকা রয়েছে। বাংলাদেশের অনেক প্রথিতযশা গুনী ব্যক্তিত্ব গ্রাম ভিত্তিক এই স্কুল থেকে শিক্ষাজীবন শুরু করেন। যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রুপকার সর্বজন শ্রদ্ধেয় মাদার বখশ। আণবিক শক্তি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান হানিফ তালুকদার, রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী রহমতুল্লাহ, রাজশাহী জেলা বোর্ডের সাবেক সচিব আবদুল জব্বার, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ফয়েজ উদ্দিন আহমেদ, বিমান বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন মীর গোলাম সবুর সহ দেশের বিভিন্ন বিভাগ ও দপ্তরের অন্তত শতাধিক গুণীব্যক্তি এই স্কুলের ছাত্র ছিলেন।
জনশ্রুতি আছে. চৌগ্রাম পরগনার প্রথম রাজা ছিলেন রাজা রসিক রায়। দ্বিতীয় রাজা তার পুত্র কৃষ্ণকান্ত রায়, তৃতীয় রাজা পুত্র রুদ্র কান্ত, চতুর্থ রাজা তার দত্তক পুত্র রোহিনী রায় বাহাদুর এবং পঞ্চম রাজা দত্তক পুত্র রমণীকান্ত রায় বাহাদুর। রাজা রোহিনী কান্ত পর্যন্ত সবাই ছিলেন অত্যাচারী। প্রজাদের মঙ্গলের জন্য কোন কাজ তারা করতেন না। রাজা রমণী কান্ত হিন্দু-মুসলিম প্রজাদের ছেলে মেয়েদের জন্য নির্মাণ করেন এই চৌগ্রাম স্কুল। ১৯০৩ থেকে ১৯১০ সালের মধ্যে এই স্কুলটি নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে ১৯১৩ সালে স্কুলটি তৎকালীন কলিকাতা বোর্ডের কাছে থেকে স্বীকৃতি পায় স্কুলটি। যা এখন চৌগ্রাম উচ্চবিদ্যালয় এ- কলেজ নামে পরিচিত। কিন্তু কালের বিবর্তনে ঐতিহ্য হারাতে বসেছে শতবর্ষী এই মাটির স্কুল ঘরটি। ইতোমধ্যে কয়েকটি দরজা ভেঙে পড়ায় স্কুল ছুটির পর ঘরে ও বারান্দায় বসে জুয়ারু ও নেশাখোরদের আড্ডা। ঘরের ভেতরে ও বারান্দায় পড়ে রয়েছে অসংখ্য সিগারেট-বিড়ি ও ময়লা-আবর্জনা। ভেঙে পড়েছে শিক্ষা ব্যবস্থা।
শুক্রবার দুপুর ১২ টায় সরোজমিনে গিয়ে দেখা যায়, স্কুলের ভেতরের বারান্দায় একদিকে বসেছে তাস খেলার আড্ডা অন্যদিকে নেশাখোদের অনাগোনা। ঘরের ভেতরে দুরগন্ধ ও অসংখ্য সিগারেট-বিড়ির মোতা পড়ে রয়েছে। সাংবাদিকদের দেখে জুয়ারু ও নেশাখোরদের দৌড়ঝাপ শুরু হয়।
চৌগ্রাম স্কুলের অফিস সহকারী রফিকুল ইসলাম বলেন, প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। আমরা এটা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি। কিন্তু গ্রামেরই ছেলে-পেলে তাই কিছু করা সম্ভব হচ্ছে না।
প্রতিষ্ঠানের কম্পিউটার প্রদর্শক আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, প্রতিষ্ঠানের অবস্থা বেশ লাজুক বলে তিনি মন্তব্য করেন।
স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক রফিকুল ইসলাম মির্জা বলেন, মাটির ঘরের কয়েকটি দরজা ভাঙা থাকায় ছুটির পর এলাকার কিছু খারাপ লোক স্কুলের ভেতরে এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে। তবে দরজাগুলো সংস্কার হয়ে গেলে এই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
প্রতিষ্ঠানের সভাপতি আলতাব হোসেন বলেন, এই শতবর্ষী মাটির স্কুল ঘর চলনবিলের ইতিহাস ও ঐতিহ্যর জানান দিচ্ছে। তাছাড়া মাটির তৈরি এই স্কুল ঘর ও চৌগ্রামের রসিক রায়ের রাজবাড়িতে প্রায়ই দেশী বিদেশী পর্যটকের সমাগমও ঘটে। তবে স্কুলে নেশাখোরদের উৎপাতের বিষয়ে তিনি বলেন, এগুলো প্রতিহত করতে তিনি ব্যাপক ভাবে ভুমিকা রেখে চলেছেন।
সিংড়া থানার ওসি নূর এ আলম বলেন, এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।