মহান মুক্তিযুদ্ধে বরিশাল বিভাগ ছিল ৯নং সেক্টরে। এ সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন মেজর এমএ জলিল। নদীবেষ্টিত বরিশাল বিভাগের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস এ অঞ্চলের মানুষের বীরত্বের মহিমায় ভাস্বর। কিন্তু এই ইতিহাসের প্রতিটি পাতা রঞ্জিত পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হাজারও মানুষের রক্তে, তাদের স্বজনদের চোখের জলে।
মুক্তিযুদ্ধে বরিশাল জেলা ॥ দীর্ঘ সংগ্রামের অবসান ঘটিয়ে ১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর বরিশাল হানাদারদের কবল থেকে মুক্ত হয়। ৭ ডিসেম্বর সীমান্তে মিত্র বাহিনী আক্রমণ শুরু করার পর সন্ধ্যা থেকেই পাক সেনারা বরিশাল ত্যাগের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। বরিশাল শহরমুখী সড়ক পথগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায় নৌযানে করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীসহ তাদের দালাল ও রাজাকাররা বরিশাল ত্যাগ করতে থাকে। পাক বাহিনীর শহর ত্যাগের খবরে আট মাস অবরুদ্ধ থাকা মুক্তিকামী মানুষ বিজয়ের আনন্দে শ্লোগান দিয়ে দলে দলে রাস্তায় নেমে আসে। নগরীর ওয়াপদা কলোনীতে পাকিস্তান সৈনদের স্থায়ী ঘাঁটিতে লুকিয়ে থাকা পাক সেনা ও তাদের দোসররা মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম সংগঠক তৎকালীন জাতীয় পরিষদের সদস্য নুরুল ইসলাম মঞ্জুর, লে. মাহফুজ আলম বেগ ও মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সুলতান মাস্টারের কাছে আত্মসমর্পণ করে।
জেলার সর্বশেষ পাকহানাদার মুক্ত হয় গৌরনদী। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশের বিজয় ঘোষিত হলেও বরিশালের গৌরনদী পাকহানাদার মুক্ত হয়েছিলো ২২ ডিসেম্বর। বাংলাদেশের মধ্যে সর্বশেষ বিজয় পতাকা উড়েছিলো গৌরনদী। টানা ২৮দিন মুজিব বাহিনীর কমান্ডার বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে (বর্তমান সংসদ সদস্য ও বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি) আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর নেতৃত্বে তার চাচাত ভাই রকিব সেরনিয়াবাত, কসবার ফজলুর রহমান হাওলাদার, বিল্বগ্রামের মেজর শাহ আলম তালুকদারসহ মুজিব বাহিনীর সদস্যরা পশ্চিম দিক থেকে ও পূর্বদিক থেকে মুক্তিযোদ্ধা নিজাম বাহিনীর সদস্যরা গৌরনদী কলেজের পাক সেনাদের স্থায়ী ক্যাম্পে যৌথ আক্রমণ চালায়। দীর্ঘদিন যুদ্ধের পর পাক সেনারা পরাস্ত হয়ে ১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর মিত্র বাহিনীর মেজর ডিসি দাসের মাধ্যমে গৌরনদী কলেজ ক্যাম্পে অবস্থানরত শতাধিক পাক সেনা স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। হানাদার বাহিনী অত্র এলাকায় নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে পাঁচ সহস্রাধিক নিরীহ জনসাধারণকে হত্যা ও তিন শতাধিক মা-বোনের ইজ্জত হরণ করেছিলো।
যুদ্ধের প্রস্তুতি পর্ব ॥ বরিশালের মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করতে প্রথম বৈঠক বসে নুরুল ইসলাম মঞ্জুরের বাড়িতে। সেখানে সংক্ষিপ্ত বৈঠক করেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক আইয়ুবুর রহমান সিএসপি, পুলিশ সুপার ফখরুদ্দিন আহমেদ, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক কাজী আজিজুল ইসলাম। সরকারী কর্মকর্তাদের সহায়তায় ২৫ মার্চ শেষরাতে পুলিশ বাহিনীর অস্ত্রাগার থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের রাইফেল সরবরাহ করা হয়। বরিশাল শত্রু কবলিত হওয়ার আগেই স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম সচিবালয় গড়ে তোলা হয় নগরীর পেশকার বাড়ী সংলগ্ন সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সবাইকে নিয়ে এ সচিবালয় গঠিত হয়েছিলো। এখান থেকেই বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ও অর্থ সরবরাহ করা হতো। মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে এ সচিবালায় থেকে ভারতে প্রশিক্ষনের জন্য পাঠানো হতো। ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ ও প্রশাসন পরিচালনার জন্য শক্তিশালী সংগ্রাম পরিষদ গঠণ করে দায়িত্ব বন্টন করা হয়। এরমধ্যে বেসামরিক বিভাগে নুরুল ইসলাম মঞ্জুর, প্রতিরক্ষা বিভাগে মেজর এমএ জলিলসহ বিভিন্ন বিভাগের দায়িত্ব পান তৎকালীন আবদুল মালেক খান, মহিউদ্দিন আহমেদ, অ্যাডভোকেট আমিনুল হক চৌধুরী, আমির হোসেন আমু, শামসুল হক, অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, অ্যাডভোকেট হাসান ইমাম চৌধুরী, অ্যাডভোকেট সরদার জালাল উদ্দিন, ডাঃ হুরমত আলী, অ্যাডভোকেট হেমায়েত উদ্দিন আহমেদ, মাকসুদ আলী বাদল, এমএ বারেক ও লুৎফর রহমান।
মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করেন ক্যাপ্টেন নুরুল হুদা হিরু, লে. মেহেদী, আলী ইমাম, লে. নাসির, লে. অধ্যাপক সামসুদ্দিন খান, মাহফুজ আলম বেগসহ কয়েকজন। নৌপথে পাক সেনাদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য জুনাহার নদীতে মুক্তিবাহিনীর একটি শক্তিশালী ঘাঁটি স্থাপন করে তা পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয় ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হককে। আক্কাস হোসেনের নেতৃত্বে শিল্পীরা দেশাত্মবোধক গান ও সংগীত পরিবেশন করে যুদ্ধে মুক্তিকামীদের প্রেরণা যুগিয়েছেন। সংগ্রাম পরিষদের অনুমোদিত বাংলাদেশ নামের একটি অর্ধসাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশনার দায়িত্ব পালন করেন এসএম ইকবাল, মিন্টু বসু ও হেলাল উদ্দিন।
গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা হেমায়েত উদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত হয় হেমায়েত বাহিনী। তিনি সর্বপ্রথম গৌরনদী ও আগৈলঝাড়ায় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। তার নেতৃত্বে আগৈলঝাড়ার শিকির বাজার, রামশীল ও পয়সারহাটে পাক সেনাদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখে যুদ্ধ হয়। পরবর্তীতে গৌরনদীর হোসনাবাদ গ্রামের নিজাম উদ্দিন আকনের নেতৃত্বে ৬০ থেকে ৭০ জন মুক্তিবাহিনীর একটি দল ভারত থেকে প্রশিক্ষণ শেষে গৌরনদী ও আগৈলঝাড়ায় আসেন। নিজাম উদ্দিন কৃতিত্বের সাথে স্বাধীনতা যুদ্ধে ৯নং সেক্টরের গ্রুপ কমান্ডার হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করেছেন।
পাক বাহিনীর আক্রমণ ॥ ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল পাক বাহিনী জঙ্গি বিমান নিয়ে আকাশ পথে বরিশালে প্রথম হামলা চালায়। জল, স্থল ও আকাশ পথে ২৭ এপ্রিল দ্বিতীয় দফায় বরিশাল শহরের বেলসপার্কে (বঙ্গবন্ধু উদ্যান) প্রশিক্ষণরত মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ্য করে গুলি চালায়। বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণে আতঙ্কে শহর ছেড়ে পালায় অসংখ্য মানুষ। লোকজন গ্রামে আশ্রয় নিয়ে মাটি খুঁড়ে বাংকার তৈরি করে বসবাস করতেন। ২৫ এপ্রিল মাহফুজ আলম বেগের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের ৩৫ জনের একটি দল বানারীপাড়া থানায় আক্রমণ চালিয়ে লুট করে নেয় সব অস্ত্র। কিছুদিন পরেই বাউকাঠী এলাকায় দুইজন নারীযোদ্ধাসহ মুক্তিযোদ্ধাদের ৩৭ জনের একটি দল পাক সেনাদের একটি লঞ্চে গুলিবর্ষণ করে। নিহত হয় আটজন পাক সেনা।
বর্বরতা ॥ ঝুনাহার নদী দিয়ে পাক বাহিনী নৌপথে বরিশালে প্রবেশের পর থেকেই তারা শুরু করে নিরীহ মানুষের ওপর নির্যাতন, খুন, ধর্ষণ, লুটপাট। মে মাসের প্রথম দিকে পাকবাহিনী গৌরনদী কলেজে স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে। ক্যাম্পে ছিল আড়াই শতাধিক সৈন্য ও ৫০ জনের মতো রাজাকার, আলবদর। বাটাজোর, ভুরঘাটা, মাহিলাড়া, আশোকাঠী, কসবাসহ প্রতিটি ব্রীজে পাক মিলিটারীদের বাংকার ছিলো। উত্তরে ভুরঘাটা, দক্ষিণে উজিরপুরের শিকারপুর, পশ্চিমে আগৈলঝাড়ার পয়সারহাট, পূর্বে মুলাদী পর্যন্ত গৌরনদী কলেজ ক্যাম্পের পাকসেনাদের নিয়ন্ত্রণে ছিলো। এদের দোসররা ছিলো এলাকার রাজাকার, আলবদর ও পিচ কমিটির সদস্য। পাক বাহিনী বিভিন্নস্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধাসহ নিরীহ লোকজনদের ধরে নিয়ে গৌরনদী কলেজের স্থায়ী ক্যাম্পে হাত-পা, চোখ বেঁধে তাদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালাতো। পাক বাহিনীর অমানুষিক নির্যাতনে বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে পালিয়ে আসা সিপাহী আনোয়ারসহ অনেক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ঝালকাঠীর ফিরোজ কবিরকে গুলি করে হত্যা করে পাক বাহিনী।
সম্মুখ যুদ্ধ ॥ ১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল পাক হানাদাররা ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক দিয়ে এ জনপদে সড়কপথে প্রবেশের মাধ্যমে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। তাদের প্রবেশের খবর শুনে স্বেচ্ছাসেবক দলের কর্মীরা গৌরনদীর সাউদের খালপাড় নামকস্থানে তাদের প্রতিহত করার জন্য অবস্থান নেয়। হানাদাররা সেখানে পৌঁছলে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে পরে। পাক সেনাদের সাথে সেইদিন সম্মুখ যুদ্ধে প্রথম শহীদ হন গৌরনদীর নাঠৈ গ্রামের সৈয়দ হাসেম আলী, চাঁদশীর পরিমল মন্ডল, গৈলার আলাউদ্দিন ওরফে আলা বক্স ও বাটাজোরের মোক্তার হোসেন। মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে ওইদিন আটজন পাক সেনা নিহত হয়। এটাই ছিল বরিশালে স্থলপথে প্রথম সম্মুখ যুদ্ধ এবং এরাই প্রথম শহীদ।
এছাড়া গৌরনদী, আগৈলঝাড়া, পয়সারহাট, কোটালীপাড়ায় সম্মুখ যুুদ্ধে অর্ধশত মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন। মে মাসের শুরুতে গৌরনদী থেকে পাকবাহিনীর একটি দল বরিশাল শহরে ঢুকতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে মারা যায়। ৩ মে মেদাকুলে পাক সেনাদের ঘাঁটি থেকে চারজন সৈন্য পূর্ব নবগ্রামে ঢুকে সিদ্ধেশ্বর সরকারের বাড়িতে লুটপাট চালায়। গ্রামবাসী ওইদিন ধারালো অস্ত্র নিয়ে ওই চার সৈন্যকে খতম করে। ১৪ জুন রাতে হরিণাহাটি নামকস্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে পিছু হটে পাক বাহিনী। কোটালীপাড়া থানায় আশ্রয় নিয়ে তারা রাজাকার-আলবদর ও পুলিশের সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর পাল্টা গুলিবর্ষণ করে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে একপর্যায়ে পালানোর চেষ্টা করে তারা। খালের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পরে দুইশতাধিক পাক সেনা, রাজাকার-আলবদর ও পুলিশ। পরেরদিন খালে ভাসমান অবস্থায় তাদের ৫০জনের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিলো। মুক্তিযোদ্ধারা বন্দী করেছিলেন শত্রুপক্ষের ১৮ জনকে। পরেরদিন পাক সেনারা লঞ্চ নিয়ে পয়সারহাটে পৌঁছালে মুক্তিযোদ্ধারা লঞ্চে গুলি চালায়। এতে পাকবাহিনীর ছয়জন সৈন্য নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হয়।
গৌরনদী, উজিরপুর, কোটালীপাড়া ও গোপালগঞ্জ থেকে চারটি স্পিডবোটযোগে পাকসেনারা প্রতিশোধ নিতে আগৈলঝাড়ার কোদালধোয়া গ্রামের দিকে অগ্রসর হয়। কিন্তু পয়সারহাট থেকে আট মাইল দূরত্বে সংঘঠিত যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা তাদেরকে পরাস্ত করে। ওই যুদ্ধে নয়জন পাকসেনা মারা যায়।
৩৭টি গণকবরে হাজারো মানুষ ॥ বরিশালের ৩৭টি গণকবর স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকবাহিনীর বর্বরতার স্বাক্ষী হয়ে আছে। নগরীর পানি উন্নয়ন বোর্ড সংলগ্ন কীর্তনখোলা তীরের বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয় অন্তত দেড় হাজার লোককে। নগরী সংলগ্ন তালতলী বধ্যভূমিতে অর্ধশত মানুষকে হত্যা করা হয়। চরকাউয়া মোসলেম মিয়ার বাড়ি সংলগ্ন খালের পাড় এলাকায় অর্ধশত ব্যক্তিকে হত্যা করে লাশ মাটিচাঁপা দেয়া হয়েছে। গৌরনদীর বাটাজোরের মরার ভিটার গণকবরে দুইশত ব্যক্তিকে, গৌরনদী কলেজ সংলগ্ন ঘাট ও গয়নাঘাটা পুল এলাকার দুইটি গণকবরে চারশত ব্যক্তিকে, আগৈলঝাড়ার কাঠিরা ব্যাপ্টিস্ট চার্চ সংলগ্ন বধ্যভূমিতে অর্ধশতাধিক, রাংতা বিল ও রাজিহার বধ্যভূমিতে পাঁচ শতাধিক, কেতনার বিল বধ্যভূমিতে সহ¯্রাধিক ব্যক্তিকে হত্যা করে লাশ মাটিচাঁপা দেয়া হয়। বাকেরগঞ্জের কলসকাঠীর গণকবরে রয়েছে চার শতাধিক ব্যক্তির লাশ। বেবাজ বধ্যভূমিতে গণহত্যার শিকার হয়েছিলো দুই শতাধিক ব্যক্তি। বানারীপাড়ার দক্ষিণ গাভা নরেরকাঠী বধ্যভূমিতে শতাধিক ও বাবুগঞ্জের ক্যাডেট কলেজ বধ্যভূমিতে গণহত্যার শিকার হয় অর্ধশতাধিক নিরীহ মানুষ। উজিরপুর বড়াকোঠা দরগাবাড়ি বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয় শতাধিক ব্যক্তিকে। স্বরূপকাঠি কুড়িয়ানা খালের বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয় প্রায় এক হাজার ব্যক্তিকে। কুড়িয়ানা জয়দেব হালদারের বাড়ির বধ্যভূমিতে পাঁচ শতাধিক ও পূর্বজলাবাড়ী খালপাড় বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয় দুই শতাধিক মানুষকে।
কেমন আছেন মুক্তিযোদ্ধারা ॥ জীবনের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে যুদ্ধাহত জাতীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক ও গৌরনদী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সৈয়দ মনিরুল ইসলাম বুলেট ছিন্টু আক্ষেপ করে বলেন, যারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে সরাসরি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে যুদ্ধ করেছেন তাদের অনেকের নাম এখনও তালিকায় নেই। অথচ স্বাধীনতা বিরোধীদের অনেকেই মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম লিখিয়ে সরকারী সুবিধা ভোগ করছেন। দিয়াশুর গ্রামের তালেব আলী হাওলাদারের পুত্র এইচএম আলাউদ্দিন ও এইচএম মহিউদ্দিন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বীরত্বের ভূমিকা পালন করেছিলেন। এজন্য স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকসেনারা তালেব আলী হাওলাদার ও তার স্ত্রী আছিরোন নেছাকে ধরে নিয়ে সরকারী গৌরনদী কলেজের পাক সেনাদের ক্যাম্পে দীর্ঘ সাত মাস আটক করে রেখে অমানুষিক নির্যাতন করেছিলো। যুদ্ধচলাকালীন সময় পাক সেনাদের হাতে গুরুতর জখম হয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা এইচএম মহিউদ্দিন। দেশ স্বাধীনের পর ছিনতাইকারীদের কবলে পরে মুক্তিযুদ্ধের সকল কাগজপত্র খোঁয়া যায় মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিনের। যে কারণে একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হয়ে আজও তার নাম তালিকাভূক্ত হয়নি। মহিউদ্দিনের একপুত্র ও দুই কন্যা উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও বাবার মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেটের অভাবে তারা সরকারী চাকরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধের নিরব স্বাক্ষী বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার কাঠিরা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা শতিশ চন্দ্র রায় আক্ষেপ করে বলেন, মোর বাবা শ্যাম কান্ত রায়সহ ৪৫ জনকে ১৯৭১ সালের ২০মে কাঠিরা গ্রামে বসে ফায়ার স্কট দিয়ে হত্যা করে পাক সেনারা। বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে মুই ভারতে যাইয়া ট্রেনিং লইয়া দ্যাশে আইয়া মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়া যুদ্ধ কইরা দেশ স্বাধীন করছি। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরেও মোর ভ্যাগে জোটেনি শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের স্বীকৃতি। এমনকি মোর নিজের নামও মুক্তিযোদ্ধার তালিকাভূক্ত করা হয়নি। তিনি জানান, মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম অর্ন্তভূক্তির জন্য একাধিকবার জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেও তিনি কোন সুফল পাননি।
উজিরপুর উপজেলার হস্তিশুন্ড গ্রামের সামচুল হক হাওলাদারের পুত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা গিয়াস উদ্দিন বলেন, দেশ মাতৃকার টানে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ৩০ জনের একটি দল তৎকালীন বিমান বাহিনীর কর্মকর্তা ও মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক একই গ্রামের নুরুল হক হাওলাদারের নেতৃত্বে প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য ভারতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছিলাম। ১৯৭১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সকাল আটটার দিকে আমরা যশোরের কালীগঞ্জের বয়রা এলাকার বর্ডারের কাছাকাছি পৌঁছলে পাক সেনারা আমাদের লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ করে। ওইসময় আমাদের দলের নেতৃত্ব দেয়া নুরুল হক হাওলাদারের কাছে শুধু একটি রাইফেল ছিলো। আমাদের জীবন বাঁচাতে নিরাপদে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে ওইসময় তিনি (নুরুল হক) পাক সেনাদের ওপর পাল্টা গুলি চালায়। একপর্যায়ে পাকিদের ছোঁড়া বুলেটের আঘাতে আমাদের দলের নেতা নুরুল হক হাওলাদার শহীদ হন। স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর আজও তার (নুরুল হক হাওলাদার) নাম শহীদ মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অর্ন্তভূক্ত হয়নি।
নিজের জীবন বাঁজি রেখে রণাঙ্গনে বীরত্বের ভূমিকা পালন করেও তালিকাভূক্ত হতে না পারার কষ্ট নিয়ে জীবন যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ২০১১ সালে মৃত্যুবরণ করেছেন গৌরনদী উপজেলার জঙ্গলপট্টি গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুস ছত্তার হাওলাদার ও ২০১৯ সালে মৃত্যুবরণ করেন গৌরনদীর আধুনা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আকবর মোল্লা। স্থানীয় বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের রোষানলে টানা সাতবছর ভাতা বন্ধ থাকায় নানারোগে আক্রান্ত হয়ে অর্থাভাবে বিনাচিকিৎসায় শষ্যাশয়ী রয়েছেন গৌরনদী উপজেলার সরিকল ইউনিয়নের সাকোকাঠী গ্রামের মৃত গঞ্জর আলী খানের পুত্র যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল খান। এ যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার একমাত্র পুত্র জামাল খান দিনমজুরের কাজ করে কোন একমতে সাত সদস্যর পরিবারের ভরন পোষন করছেন। যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল খান আক্ষেপ করে বলেন, বেঁচে থাকতে যদি অর্থাভাবে বিনাচিকিৎসায় ধুকে ধুকে মরতে হয়, তাহলে মৃত্যুর পরে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিয়ে কি হবে। তাই পরিবারের সকলের কাছে বলেছি, মৃত্যুর পর আমাকে যেন রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয়া না হয়।