শুক্রবার মধ্য রাত থেকে শনিবার বিকেল পর্যন্ত দেশের মহাসড়কগুলো মানুষখেকো হয়ে উঠেছিল। একই দিনে দেশের বিভিন্ন সড়কে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৪২ জন। আহত হয়েছেন প্রায় এক’শজন। এর মধ্যে শুধু গাইবান্ধার পলাশবাড়িতেই নিহত হয়েছেন ১৮ জন। রংপুরে মারা গেছেন ৬ জন। একই দিন অন্য ১২টি জেলায় ২২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এঘটনা নতুন কিছু নয়। প্রাণ হারানো মানুষগুলোর স্বজনদের কান্নার শব্দ দিন দিন ভারি হচ্ছে।কতস্বপ্ন অংকুরেই বিনষ্ট হচ্ছে তার কোন ইয়েত্তা নেই। চালকের অসতর্কতা,যাত্রীবাহী বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষ, বাসচাপায়, প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে দুই বাসের ধাক্কা, খাদে পড়ে যাওয়া, সিএনজিচালিত অটোরিকশা চাপা পড়া বা উল্টে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে মানুষ প্রাণ হারচ্ছে। যতই দিন যাচ্ছে দেশের মহাসড়ক ও সড়কগুলো মানুষ খেকো হয়ে উঠছে। এ যেন রক্তের হলি খেলা। মানুষের স্বপ্ন ভঙ্গের প্রতিযোগিতায় নেমেছে সড়কগুলো। সড়ক পথের এই পরিস্থিতি থেকে উত্তোরনের এক মাত্র পথ সরকারকে প্রথমে বিশ্বাস করতে হবে রেলপথ সংস্কারের মাধ্যমে মহাসড়কের মৃত্যুর হার কমাতে পারে রেলপথ।
একটু পিছন ফিরে তাকাই ১৯৭২ সাল। মুক্তি যুদ্ধ শেষ হয়েছে। সদ্য বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। সারা দেশে সড়ক পথে যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। উত্তরাঞ্চলের অবস্থা খুবই নাজুক। সে সময় ট্রেনই ছিল মানুষের একমাত্র ভরসা। সে সময় রংপুর থেকে ঢাকা যেত সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন বিআরটিসির বাস। ঢাকা যেতে ভাড়া ছিল ২০ থেকে ২৫ টাকা। রংপুর ফায়ার সার্ভিস স্টেশন প্রাঙ্গন থেকে প্রতিদিন বিআরটিসির লাল রংয়ের বাস ছেড়ে যেত ঢাকা উদ্দেশ্যে। লাল রংয়ের এই বিআরটিসির বাস ও বাসের যাত্রী দেখার জন্য প্রতিদিন মানুষ ভীড় জমাতো ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের সামনে। গ্রাম থেকে অনেকে পয়সা খরচ করে বিআরটিসির লাল বাস দেখতে শহরে আসতো। এ ভাবেই এ অঞ্চলের মানুষের বাস যোগে ঢাকা যাওয়ার পরিচয়। তখন বাঘাবাড়ি, নয়ার হাট, তরার ঘাট, আরিচা, নগরবাড়ি ও মিরপুর ফেরি যোগে যানবাহন পারাপার হতো। সময় লাগতো ৮ থেকে ১০ ঘন্টা। মানুষ ট্রেনের এক ঘেয়েমি কাটাতে বাসে যাতায়াতকে স্বাচ্ছন্দ বোধ করতে থাকায় একসময় ট্রেনের প্রতি আগ্রহ কমে যেতে শুরু করে। এক পর্যায়ে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় বাস চলাচল শুরু হয়। ট্রেনের নানা অব্যস্থাপনায় কারণে ধীরে ধীরে ট্রেন ছেড়ে মানুষ বাসে চড়লো। সেই সাথে ব্যক্তি মালিকানায় প্রতিযোগিতামূলকভাবে দুর পাল¬ার বাস চলাচল করতে থাকে। এসময় জনগনের চাহিদা মিটাতে নাইট কোচের যাত্রা শুরু হয়। পর্যায়ক্রমে মিরপুর,বাঘাবাড়ি, তরার ঘাট,নয়ার হাট ব্রীজ হলো,ফেরি পারাপারে মানুষের কষ্ট কিছুটা লাঘব হলো। এরপর যমুনা নদীর বুক চিড়ে সেতু নির্মাণ হলো বঙ্গবন্ধু সেতু। উত্তরাঞ্চলসহ সারা দেশের মানুষ আশায় বুক বাঁধলো যোগাযোগের ক্ষেত্রে যুগান্তকারি এই পরিবর্তন হওয়ায়। বিভিন্ন জেলার সাথে সেতুর সংযোগ রক্ষায় মহাসড়ক তৈরী হয়। প্রথম প্রথম ৫ থেকে ৭ ঘন্টার মধ্যে ঢাকা থেকে উত্তরাঞ্চলের যে কোন প্রান্তে যাওয়া যেত। কিন্ত এই সুখ বেশিদিন থাকলোনা। মাত্র এক দশকে পাল্টে গেল চিত্র। মহাসড়ক যানজটের কারণে যোগাযোগের অনুপোযুক্ত হয়ে উঠলো। মহাসড়কগুলো মানুষ খেকো হয়ে উঠলো। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যাচ্ছে। এ যেন মহাসড়কের নিত্য নৈমিত্তক ঘটনা। এ থেকে পরিত্রানের কোন উপায় খুঁেজ পাওয়া যাচ্ছেনা। উত্তরাঞ্চল থেকে এখন কোন মানুষ যদি ঢাকা যায় তাকে বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে আসতে হয়। সুস্থ্য শরীরে ফিরতে পারবে কিনা এনিয়ে সবসময় থাকতে হয় চরম আতংকে। ঈদ পরবে এ অবস্থা আরো ভয়াবহ হয়ে পড়ে। ঢাকা থেকে গন্তব্যে পৌছতে ৬ ঘন্টার পথ পাড়ি দিতে ২৫ থেকে ৩০ ঘন্টা পর্যন্ত সময় লাগছে। কষ্ট ও সময়কে পাত্তা না দিয়ে মানুষ নাড়ির টানে ঘরে ফিরে আপনজনদের সাথে আনন্দটুকু ভাগাভাগি করে নিতে। রেল পথের অবস্থা আরো নাজুক। কটার ট্রেন কটায় আসে তা বলা মুসকিল। রেলের আয় কমে যাওয়ায় অজুহাতে একের পর এক ট্রেন বন্ধ করে দেয়ায় জনগনও আর এখন ট্রেনের প্রতি আস্থা রাখতে পারছেনা। মহাসড়কের যানজট কমাতে রেল পথের উন্নয়নের বিকল্প নেই। তাই আমি মনে করি সড়ক পথে ভায়াবহ এই পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেতে সরকারকে প্রথমে বিশ্বাস করতে হবে রেল পথ সংস্কারের মাধ্যমে রেল সেবাকে পুনরায় জনগণের দোড় গোড়ায় পৌছে দেয়া সম্ভব। এ লক্ষে সরকারকে মহা পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
সম্প্রতি পত্রিকায় প্রকাশিত একটি খবরে বলা হয়েছে বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে প্রতি ঘন্টায় ৯শ থেকে এক হাজার যানবাহন চলাচল করছে। এ থেকে একটি চিত্র স্পষ্ট হয়েছে এক দশকে যানবাহনের সংখ্যা বেড়েছে কতটা অস্বাভাবিক হারে। এতে বঙ্গবন্ধু সেতুতে যে ভাবে চাপ বাড়ছে তাতে এই সেতুর আযুস্কাল নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। সড়ক পথের উন্নয়নের পাশাপাশি রেলকে আধুনিকায়ন করা এখন সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে। রেলকে যদি ঢেলে সাজানো সম্ভব হয় তাহলে এক দিকে যেমন যানজট কমবে অপরদিকে মহাসড়কের মানুষ খেকোর দুর্নাম কিছুটা হলেও ঘুচবে। তবে এজন্য রেলওয়ের সেবার মানোন্নয়নের মাধ্যমে যাত্রীদের এবং রেলযোগে পণ্য পরিবহনকারীদের আস্থা বৃদ্ধি করতে হবে রেল বিভাগকে। তবে এই আস্থা অর্জনের ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে আছে দীর্ঘ দিন থেকে রেলপথ সংস্কার না হওয়া, বেদখল হয়ে যাওয়া জমি উদ্ধারে কার্যকর কোন ব্যবস্থা গ্রহণ না করা, রাজস্ব ফাঁকি, অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংসহ বিভিন্ন কারণ। জানা গেছে, প্রায় ৮০ বছরের বেশি সময় ধরে পশ্চিমাঞ্চলের রেলওয়ের বড় ধরণের কেন সংস্কার হয়নি। ফলে পার্বতিপুর থেকে কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, দিনাজপুর পঞ্চগড়সহ বেশকটি রেলপথের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। দীর্ঘদিন কোন কাজ না হওয়ায় এসব রেল পথে প্রায়ই ট্রেনচ্যুতির ঘটনা ঘটছে। এই রেল পথগুলো সংস্কার করে পুনরায় রেল চলাচল চালু করতে পারলে সড়ক পথের যানজট অনেকটা হৃাস পাওয়ার পাশাপাশি রেলেরও একটি আয়ের পথ বের হতো। অভিজ্ঞ মহলের ধারনা মহাসড়ককে চারলেনে উন্নতি করতে যে পরিমান টাকার প্রযোজন তার চেয়ে অনেক কম খরচে রেলকে ঢেলে সাজানো সম্ভব।
জানা গেছে, বর্তমানে সারা বাংলাদেশের ৪৪টি জেলায় ৪৪১টি রেলস্টেশনসহ রেলপথ রয়েছে প্রায় ২ হাজার ৮শ ৩৫ কিলোমিটার। বৈধ অনুমোদন, রেল বিভাগের জনবল সঙ্কট আর নীতিমালার অভাবের কারণে রেল মাথা চাড়া দিয়ে দাড়াতে পারছেনা। ১৯২৭ সালে স্থাপিত বাংলাদেশ রেলওয়ের লালমনিরহাট বিভাগের পাবর্তীপুর সেকশন । স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকহানাদার বাহিনী এই রেলপথের তিস্তা সেতুসহ বেশকটি স্থানে রেল সেতু ও লাইনের ব্যাপক ক্ষতি করে। রংপুর ,দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও কুড়িগ্রাম লালমনিরহাট ও পঞ্চগড় জেলার মানুষের যাতয়াতের প্রধান মাধ্যম রেলপথ হওয়ায় দেশ স্বাধীনের পর রেল সেতু গুলো পূনগর্ঠন করা হলেও রেল লাইনের তেমন কোন সংস্কার করা হয়নি। মাঝে মধ্যে লাইনে কিছু পাথর ফেলা হয়েছে মাত্র। সূত্র মতে গত কয়েক বছরে পশ্চিমাঞ্চলীয় রেল পথে প্রায় শতাধিকবার ট্রেন লাইনচ্যুত হয়েছে । মিটারগেজ রেলপথের শতকরা ৫০ থেকে ৬০ ভাগ রেল লাইন ক্ষয় হয়ে গেছে। যেখানে মাত্র ৫ ভাগ লাইন ক্ষয় হলেই ট্রেন দুর্ঘটনা অনিবার্য হয়ে পড়ে। অধিকাংশ মুল্যবান কাঠের ¯ি-পার গুলো নষ্ট অথবা চুরি হয়ে গেছে। দেখা গেছে কোন কোন স্থানে রেল লাইন হয়ে পড়েছে ¯ি¬পার শূন্য। রেল লাইনে প্রয়োজনীয় নাটবোল্ট না থাকায় ট্রেন চলাচলের সময় রেল লাইনের ¯ি¬পার গুলো ওঠানামা করে। প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার কারণে যাত্রীর সংখ্যা কমে গেছে। অপরদিকে রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চল পাকশী ও লালমনিরহাটের অধিনে ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা কর্মচারীদের অবৈধ পন্থায় লীজ প্রদান করায় সরকারের কোটি কোটি টাকার রাজস্ব ঘাটতি হচেছ। প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে ভূ-সম্পত্তি বিভাগের কতিপয় কর্মকর্তা যোগসাজসে বাংলাদেশ রেলওয়ে বাণিজ্যিক ভুমিগুলো কৃষি শ্রেণী দেখিয়ে লীজ প্রদান করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি চক্র। লীজ গ্রহিতারা কৃষি শ্রেণী হিসেবে লীজ গ্রহণ করে কাঁচাপাঁকা ঘরবাড়ি নির্মাণ করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ আবাসিক প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করছে। বিষয়গুলো ওপরওয়ালারা দেখেও না দেখার ভান করছে। ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তার অফিস সূত্রে জানা গেছে কৃষি শ্রেণী জমির খাজনা কম। অপরদিকে বাণিজ্যিক সম্পত্তির বাৎসরিক খাজনা বেশি। রেলওয়ে এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তারা লীজ গ্রহিতার নিকট অবৈধভাবে বাণিজ্যিক সম্পত্তি কৃষি শ্রেণী দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। বাংলাদেশ রেলওয়ের জমি সংক্রান্ত অডিট প্রতিবেদন অনুযায়ী রেলওয়ের মালিকানাধি মোট জমির পরিমান ৬১ হাজার ৭৬৬ একর ১৬ শতক। এর মধ্যে পশ্চিমাঞ্চলে ৩৭ হাজার ৭০৫ একর এবং র্পুবাঞ্চলে ২৪ হাজার ৬১ একর ১৬ শতক। সূত্রমতে রেলের কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য পশ্চিমাঞ্চলে ২১ হাজার ৬৮১ একর এবং পূবাঞ্চলে ১৪ হাজার ৯৯২ একর জমি ব্যবহার হচ্ছে। বাদবাকি জমি হয় বৈধ ভাবে লীজ দেয়া হয়েছে অথবা প্রভাবশালীদের কাছে অবৈধ দখলে রয়েছে। সূত্র মতে ১৫ হাজার একরের বেশি জমি অবৈধ দখলে রয়েছে। এই অবৈধ দখলের বেশিভাগই পশ্চিমাঞ্চলে। রাজনৈতিক প্রভাব,সংশি¬ষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসিনতা, সুষ্ঠনীতিমালার অভাবের করণে রেলওয়ের কোটি কোটি টাকা মূল্যের সম্পত্তি উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছেনা। রেলের হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ উদ্ধার করেই রেলের আমুল পরিবর্তন আনা সম্ভব বলে মনে করেন অভিজ্ঞ মহল। রেলের সম্পদ দিয়েই রেলের আমূল পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব এ কথা সর্ব প্রথম সরকার ও সংশি¬ষ্ট বিভাগকে বিশ্বাস করতে হবে। তাই সরকারের আস্থা রাখা উচিত মহাসড়কের যানজট ও অনাকাংখিত মৃত্যু কমিয়ে আনতে পারে বাংলাদেশ রেলওয়ে।
(লেখক কবি ও সাংবাদিক)