রামুর আঁধার মানিক গুহার গুপ্ত রহস্য উন্মোচনে খননকাজ শুরু হচ্ছে। আগামী অর্থবছরের শুষ্ক মৌসুমে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এই খননকাজ পরিচালনা করবে। বাংলাদেশের কোথাও পাহাড়ের ভিতরে মানবসৃষ্ট এ ধরনের গুহা নেই বলে জানিয়েছেন, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. হান্নান মিয়া। খননকাজ করেই রামুর আঁধার মানিক গুহার গুপ্ত রহস্য উন্মোচন করা হবে। স্থানীয়রা এ গুহাকে কানা রাজার সুড়ঙ্গ বলেও অবিহিত করেন। রামুর কানা রাজার সুড়ঙ্গ, রামকুট, উখিয়ারঘোনার পাহাড়ের জাদি, অফিসেরচর ডাকবাংলো সহ রামুর প্রত্ননিদর্শন সমৃদ্ধ স্থানকে প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করেছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। রামুতেই গড়ে তোলা হবে প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর। শনিবার রামুর ঐতিহাসিক আঁধার মানিক গুহা পরিদর্শন করেছেন, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. হান্নান মিয়া ও কক্সবাজার-৩ আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ্ব সাইমুম সরওয়ার কমল। এ সময় আঁধার মানিক গুহার খননকাজ পরিচালানা ও ওই স্থানকে প্রত্নপর্যটন এলাকায় পরিণত করার বিষয়ে স্থানীয় সাংসদ আলহাজ্ব সাইমুম সরওয়ার কমলের আলোচনা করেন, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. হান্নান মিয়া বলেন, রামুতে গড়ে তোলা হবে প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর। রামুতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশন। গত ১৬ নভেম্বর থেকে রামুতে প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ ও অনুসন্ধানে কাজ করছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। রামু সহ কক্সবাজার জেলার উখিয়া, মহেশখালী ও কক্সবাজার সদর উপজেলার প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ ও অনুসন্ধান কাজ চলছে। ইতিমধ্যে রামুর রামকুট এলাকায় প্রাচীন স্থাপনায় ব্যবহৃত ১৫০০ বছর পূর্বের ইট, উত্তর মিঠাছড়ি গ্রামে ১৩৫ বছর আগের একটি শিলালিপি ও ইট এবং উত্তর ফতেখাঁরকুল বণিকপাড়া এলাকা থেকে প্রাচীন একটি হাতির হাড়ের ফসিল সংগ্রহ করা হয়েছে। রামকুট এলাকা থেকে সংগৃহীত ইট কুমিল্লার লালমাই-ময়নামতি পাহাড়ে আবিস্কৃত প্রত্ন সম্পদ শালবন বিহারেও পাওয়া গিয়েছিল। সংগৃহিত এসব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রামুর প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হবে। রামুর ঐতিহাসিক আঁধার মানিক গুহায় প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ ও অনুসন্ধান কাজে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করার ঘোষনা দিয়েছেন, আলহাজ্ব সাইমুম সরওয়ার কমল এমপি। তিনি বলেন, রামুর আঁধার মানিক গুহায় সহজ যোগাযোগের জন্য সড়ক উন্নয়ন করা হবে। প্রাচীন ইতিহাস সমৃদ্ধ অঞ্চল রামু। যে ইতিহাস এখনো মানুষের অজানা থেকে গেছে।প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ ও অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসবে সেই সব ইতিহাস। প্রত্ননিদর্শন সমৃদ্ধ রামু হয়ে উঠবে প্রত্নপর্যটন শহর। এখানে আসবে দেশ-বিদেশের পর্যটক। শনিবাররামু উপজেলার কাউয়ারখোপ ইউনিয়নের উখিয়ারঘোনা এলাকায় ঐতিহাসিক আঁধার মানিক গুহা’র জরিপ ও অনুসন্ধান পর্যবেক্ষণে আরো উপস্থিত ছিলেন, প্রত্নততত্ব অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক ড. মো. আতাউর রহমান, রামু উপজেলা নির্বাহী অফিসার প্রণয় চাকমা, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. মেজবাহ উদ্দিন, কাউয়ারখোপ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোস্তাক আহমদ, কবি এম সুলতান আহমদ মনিরী, রামু প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি খালেদ শহীদ, রামু উপজেলা যুবলীগ সাধারণ সম্পাদক নীতিশ বড়ুয়া প্রমুখ। প্রত্নততত্ব অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক ড. মো. আতাউর রহমান বলেন, ইতিহাস-ঐতিহ্যে ভরপুর পর্যটন শহর কক্সবাজারের রামু উপজেলা হাজার বছরের ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ জনপদ। প্রাকৃতিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এবং রাজা-বাদশাদের আবাসস্থল হওয়ায় এ উপজেলার গুরুত্ব ও পরিচিতি দেশজুড়ে। রামুর অনেক এলাকার নামের সাথে মিশে আছে সমৃদ্ধ ইতিহাস। ঐতিহাসিক এসব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এখনো রামুতে দৃশ্যমান। কাঁনা রাজার সুড়ঙ্গ যার অন্যতম। ইতিহাস-ঐহিত্য জানতে হবে এবং ঐতিহাসিক নিদর্শন সংরক্ষণ করতে হবে। রামুর কাঁনা রাজার সুড়ঙ্গ যথাযথ সংরক্ষণের মাধ্যমে এর ইতিহাস তুলে ধরতে পারলে এখানে জ্ঞান পিপাসুদের পাশাপাশি পর্যটকদের আকর্ষণও বাড়বে। তিনি বলেন, রামুর দুর্গম পাহাড়ী এলাকার ‘আঁধার মানিক গুহা’ নিয়ে রয়েছে কিংবদন্তি ইতিকথা। এটি প্রায় সাড়ে তিন থেকে চার শত বছরের প্রাচীন নিদর্শন। আরাকান রাজা চিন পিয়ান বৃটিশদের কাছে রাজ্য হারিয়ে উদ্বাস্তু জীবনের শেষ সময়ে রামু উখিয়ার ঘোনার পাহাড়ে গুপ্ত গুহা খনন করে লুকিয়ে থাকতেন। ওই সময়ে আরাকান রাজা চিন পিয়ানকে গ্রেফতার করতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তৎকালীন ৫ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিলেন। কথিত আছে আরাকান রাজা চিন পিয়ান এর একটি চোখ অন্ধ ছিল। তাই স্থানীয়রা তাকে কানা রাজা বলেও সম্বোধন করতেন। সেই কারণে গুপ্ত গুহাটির নাম ‘কানা রাজার গুহা’ বা ‘কানা রাজার সুড়ঙ্গ’। অন্ধকার রাতে ওই গুহার ভিতর থেকে আলো দেখা যেতো, মানিকের মতো আলো জ্বলত বলেই এটি ‘আঁধার মানিক গুহা’ নামেও পরিচিতি পায়। রামুতে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খনন কাজ পরিচালিত হলে, প্রত্নপর্যটনের একটি শহর বেরিয়ে আসবে বলে জানান, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক ড. মো. আতাউর রহমান। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. হান্নান মিয়া গতকাল শনিবার রামুর আঁধার মানিক, রাজারকুলে রামকুট, কাউয়ারখোপের উখিয়ারঘোনায় পাহাড় চূড়ায় স্থাপিত বৌদ্ধ জাদি, ফতেখাঁরকুল ইউনিয়নরে হিরাম কক্স এর ডাকবাংলো পরিদর্শন করেন।প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. হান্নান মিয়া দুই দিনের সফরে শুক্রবার (৬ ডিসেম্বর) সকালে কক্সবাজার আসেন। কক্সবাজার জেলার সদর, রামু ও মহেশখালী উপজেলায় প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ ও অনুসন্ধান কাজের পরিদর্শন করেন। শুক্রবার সকালে মহেশখালী উপজেলার আদিনাথ মন্দির, পুরাতন জাদী, মহেশখালী সীমা বিহার পরিদর্শন করেন। এ সময় প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সাথে উপস্থিত ছিলেন, মহেশখালী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. জামিরুল ইসলাম। বিকাল ৪টায় কক্সবাজার সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে কক্সবাজারের সুশীল সমাজের সাথে অনুষ্ঠিত ‘ইতিহাস-ঐহিত্য রক্ষা’ বিষয়ক এক মতবিনিময় সভা প্রধান অতিথির বক্তৃতা করেন, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. হান্নান মিয়া। মতবিনিময় সভা শেষে ১৩৫ বছরের প্রাচীন কক্সবাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ ও চারশত বছরের চৌধূরী বাড়ি সাঁচী জামে মসজিদ পরিদর্শন করেন। পরিদর্শনকালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক ড. মো. আতাউর রহমান, প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ ও অনুসন্ধান টিমের ফিল্ড অফিসার মো. শাহীন আলম, ময়নামতি জাদুঘরের কাস্টোডিয়ান মো. হাফিজুর রহমান, গবেষণা সহকারি মো. ওমর ফারুক, সার্ভেয়ার চাইথোয়াই মারমা, পটারী রের্কডার ওমর ফারুক, লক্ষণ দাস উপস্থিত ছিলেন।