রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) শাখা ছাত্রলীগের গঠিত কমিটি এক বছরের জন্য হলেও পার হয়ে গেল আরো একটি বছর। মেয়াদ উত্তীর্ণ এই কমিটি গত ১১ ডিসেম্বর (মঙ্গলবার) পদার্পণ করেছে ৪র্থ বছরে। কিন্তু এই কমিটির নেতারা রাবি ক্যাম্পাসে সাংগঠনিক কার্যক্রমে সেভাবে কোন গতিশীলতা আনতে পারেনি। অভ্যন্তরীণ কোন্দল, আবাসিক হলে সিট বাণিজ্য আর আধিপত্য বিস্তার নিয়ে প্রায়ই নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন গ্রুপের সৃষ্টি হয়ে একে অপরের ওপর চড়াও হওয়ার ঘটনাও অনেকবার ঘটেছে। এছাড়াও বর্তমান কমিটির একাধিক সদস্যদের বিরুদ্ধে মাদক ও নারী কেলেঙ্কারীর ঘটনাসহ বিভিন্ন অপকর্মের ধারাবাহিক অভিযোগের ফলে এই রাবি শাখা ছাত্রলীগের সংগঠনটি ইমেজ সংকটে পড়ছে দাবি সংশ্লিষ্টদের। আর বর্তমান কমিটির নেতারা হল কমিটিগুলো গঠন না করতে পারার ব্যর্থতা তো রয়েছেই। এছাড়াও একই সাথে সময় উপযোগি কমিটি গঠনের মধ্যদিয়ে নেতৃত্বে পরিবর্তন চাইলেও এর প্রতিফলন না ঘটায় নেতাকর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।
ছাত্রলীগ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালের ৮ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের ২৫ তম সম্মেলনের পর ১১ ডিসেম্বর গোলাম কিবরিয়াকে সভাপতি ও ফয়সাল আহমেদ রুনুকে সাধারণ সম্পাদক করে ১৩ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা দেয় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। এরপর আংশিক কমিটির প্রায় ছয় মাস পর ২০১৭ সালের ১৮ জুন ১৫১ সদস্য বিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটির অনুমোদন দেয় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। ইতিমধ্যেই কেন্দ্র ঘোষিত এ কমিটির মেয়াদ দুই বছর আগে শেষ হয়েছে। আর গত মঙ্গলবার মেয়াদ উত্তীর্ণ এ কমিটি চার বছরে পদার্পণ করেছে।
এদিকে সেসময় কমিটি ঘোষণার পরপরই হল কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়া থাকলেও ব্যর্থ হয়েছে বর্তমান কমিটি। তবে বিভিন্ন সময়ে হল কমিটি গঠনের জন্য উদ্যোগ দেখা গেলেও অজ্ঞাত কারণে আলোর মুখ দেখেনি। আর নতুন কমিটি না হওয়ার পাশাপাশি এ তিন বছরে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের কিছু কর্মকান্ডে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হওয়ায় ক্ষুব্ধ অনেকে। তাদের দাবি, দীর্ঘদিন ধরে নেতৃত্বে পরিবর্তন না আসায় নেতাকর্মীদের মধ্যে থাকা অসন্তোষের কারণেই বিভিন্ন সময় ঘটছে অনাকাঙ্খিত ঘটনা। আর নেতাকর্মীদের এমন অপকর্মে সংগঠনটি ইমেজ সংকটে পড়ছে।
সূত্র মতে, সর্বশেষ গত ১৬ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শামসুজ্জোহা হলের ২৫৪ নাম্বার রুমে ফাইন্যান্স বিভাগের শিক্ষার্থী সোহরাব মিয়াকে মারধর করে ছাত্রলীগ কর্মী রাকিবুল ইসলাম (আসিফ লাক) ও হুমায়ুন কবির নাহিদ। এর আগে ২০ সেপ্টেম্বর রাতে ফেসবুক মেসেঞ্জারে কথোপকথনকে কেন্দ্র করে শের-ই-বাংলা একে ফজলুল হক হলে ছাত্রলীগ দুইপক্ষ হয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এর আগে ১৪ সেপ্টেম্বর মাদার বখ্শ হলের গেস্ট রুমে বসাকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই পক্ষ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এতে ৭ ছাত্রলীগ নেতাকর্মী আহত হন। এর আগে ১১ সেপ্টেম্বর রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের বেদীতে মোটরসাইকেল চালিয়ে নতুন বিতর্কের জন্ম দেন শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানি রবি। তার আগে ৯ সেপ্টেম্বর শহীদ হবিবুর রহমান হলে এক সাংবাদিকের সিট দখল করে নেন ছাত্রলীগের আইন বিভাগের সাধারণ সম্পাদক মিনহাজুল ইসলাম।
গত ২০১৮ সালের ১ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্যিক সিনেমা প্রদর্শনীকে কেন্দ্র করে দৈনিক খোলা কাগজের রাবি প্রতিনিধি আলী ইউনুস হৃদয়কে মারপিট করে রাবি ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাবরুন জামিল সুষ্ময়। ওই বছরের ২ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে তরিকুল ইসলাম নামে এক আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীকে সড়কে ফেলে বেধড়ক মারপিট করেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। যে ঘটনায় তরিকুলের পা ভেঙ্গে যায় এবং মেরুদন্ডের হাড় ফেটে যায়।
শুধু তাই নয়, পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণার পর ২০১৭ সালের ১০ জুলাই ছাত্রলীগের প্রথম কর্মসূচির দিন তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক কানন, সহ-সভাপতি আহমেদ সজীব, সাংগঠনিক সম্পাদক হাসান লাবন ও আইন বিষয়ক সম্পাদক সাইফুল ইসলামসহ ১০-১২ জন নেতাকর্মী ডেইলি স্টারের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি আরাফাত রহমানকে বেধড়ক মারপিট করেন। একই বছরের ১৯ জুলাই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ডিগ্রি পরীক্ষায় প্রক্সি দিতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাব্বির আহমেদ বান্ধবীসহ গ্রেফতার হন। এরপর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি জালিয়াতির দায়ে ওই বছরের ১৭ ডিসেম্বর রাবি ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান সজল ও ছাত্রলীগ কর্মী মোস্তফা বিন ইসমাঈলকে আটক করে পুলিশ। নিজের প্রেমিকার সঙ্গে খারাপ আচরণ করায় ওই বছরের ১১ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নারী শিক্ষার্থীকে প্রকাশ্যে শ্লীলতাহানির হুমকি দেন রাবি ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সারোয়ার হোসেন।
এ বিষয়ে জানতে বুধবার (১১ ডিসেম্বর) দুপুরে রাবি ছাত্রলীগের সভাপতি গোলাম কিবরিয়ার মুঠোফোনের মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।
তবে অতীতের যেকোন কমিটির তুলনায় এই কমিটি সুশৃঙ্খলভাবে দায়িত্ব পালন করেছে এমন দাবি করে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ রুনু বলেন, আমরা সংগঠনের কার্যক্রমকে গতিশীল করার জন্য বিভিন্ন কর্মকান্ড গ্রহণ করছি। তারপরও বিচ্ছিন্নভাবে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে গেছে। তবে আমরা সেগুলোর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। এখন কেন্দ্রীয় কমিটির নির্দেশনা পেলেই নতুন কমিটি গঠনের ব্যাপারে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
রুনু বলেন, বর্তমান কমিটির গতিশীল কার্যক্রম দেখে ঈর্ষান্নিত হয়েছে পদবঞ্চিতরা। যে কারণেই গত তিন বছরে এই কমিটির কার্যক্রম নিয়ে তারা সমালোচনা করে যাচ্ছে। আমাদের গতিশীল কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায় গত ১ এপ্রিলেও জঙ্গিবাদ বিরোধী মানববন্ধন কর্মসূচীও পালন করেছি। এর আগে ২৮ মার্চ কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার সংস্কারের দাবিতে মানববন্ধন ও স্মারকলিপি প্রদান করা হয়েছে। এছাড়াও স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি, জাঁকজমকপূর্ণ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী, জাতীয় দিবস উদযাপন, ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের সহযোগীতা, শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন দাবি আদায়ে সংহতি প্রকাশসহ সরকারের বেশকিছু সাফল্যে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। তবে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু সেগুলো ঘটনা ঘটিয়েছেন ছাত্রলীগের ছত্রছায়ায় থাকা কিছু শিক্ষার্থীরা। যারা সবসময়ই বর্তমান কমিটিকে বিতর্কিত করতে মরিয়া ছিল এবং আছে।
নতুন কমিটি গঠনের বিষয়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যের মুঠোফোনে একাধিকবার কল ও ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও কোন সাড়া পাওয়া যায়নি।
পরে এ বিষয়ে রাজশাহী জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হাবিবুর রহমান হাবিব বুধবার (১১ ডিসেম্বর) দুপুরে বলেন, ‘নতুন কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে কিছুটা দেরী হয়েছে বা হচ্ছে এটা ঠিক, তবে আমার জানা মতে শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়-ই নয়, জেলাসহ দেশের মেয়াদ ঊর্ত্তীন্ন সকল কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া হয়তো শিঘ্রই শুরু হবে। আমরা শুধু কেন্দ্রীয় নির্দেশনার অপেক্ষায় রয়েছি।