১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে রওশন আরা বাচ্চু সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের ছাত্রী ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের সংগঠিত করা ছাড়াও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হলের ছাত্রীদের ভাষা আন্দোলনের পক্ষে সুসংগঠিত করেন। একুশে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারী প্রথম ছাত্রীদলের অন্যতম সদস্য ছিলেন রওশন আরা বাচ্চু। অথচ তাঁর মৃত্যুর পর আমাদের তথাকথিত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব গোলাম কুদ্দুছ শেষ শ্রদ্ধার আয়োজনটি করলেন না। বরেণ্য ছড়াকার টিমুনী খান রিনোর প্রচেষ্টায় বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি হাবিবুল্লাহ সিরাজী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যাালয়ের উপ-উপাচার্য ড. মুহাম্মদ সামাদ শেষ শ্রদ্ধা জানালেও শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানানোা হয়নি ভাষাসৈনিক রওশন আরা বাচ্চুকে। যিনি নিজের জীবনময় অনবদ্য ছিলেন দেশ ও মানুষের জন্য। বাংলা ভাষায় আজ যাদের কারণে কথা বলছি সেই সৈনিকদের অন্যতম রওশন আরা বাচ্চু একবার বলেছিলেন- আমাদের সময় সাধারণত সিনয়র-জুনিয়র একটি বিষয় ছিল। যে কোনো কাজে আমাদের সিনয়রা আগে থাকতেন, আমরা পেছনে। কিন্তু সেদিন সিনিয়র জুনিয়র মানার সুযোগ ছিল না। এতো লোক সমাগম হয়ে গিয়েছিলো যে আময়া নিজেরাই হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু এক পর্যায়ে হঠাত বিতর্ক লেগে গিয়েছিল যে, ১৪৪ ধারা ভাঙা হবে নাকি হবে না। কারণ পুলিশ ব্যারিকেড দিয়েছিলো। ব্যারিকেডের সামনে পুলিশ হাটু ভেঙে বন্দুক তাক করে বসে ছিলেন। আমাদের শিক্ষকরা নেমে আসলেন আর ছাত্রদের কাছে অনুরোধ করে বললেন আজকে সরকার একটি কঠিন পদক্ষেপ নিয়েছে, আজকে আন্দোলন বন্ধ করে দাও। তখন সকল ছাত্রছাত্রী বিনয়ের সাথে সেটি উপেক্ষা করলেন। শহীদ খান নামে এক ছেলে মধুর ক্যান্টিন থেকে একটা বেঞ্চ টেনে দাঁড়িয়ে গেলো। তখন তাকে নামিয়ে আব্দুল মতিনকে দাড় করানো হলো। তখন তিনি গণতান্ত্রিক উপায়ে জিজ্ঞেস করলেন আপনারা কি চান? ৪৪ ধারা ভাঙবেন কি ভাঙবেন না? তখন দুই হাত মুষ্ঠী করে উপরের দিকে তুলে সবাই বললো- আমরা ১৪৪ ধারা ভাঙবোই ভাঙবোই। তখন গিয়ে ঠিক হলো আমরা ১০ জন ১০ জন করে বের হবো। প্রতি দলের সাথে আমরা তখন বেরিয়ে গেলাম। আমাদের সবারই মাথায় ছিলো যে কোনো সময় গুলিও চলতে পারে। তবুও থেমে থাকিনি।
আমরা যখন একদম ব্যারিকেডের সামনে চলে আসলাম তখন কেউ কেউ ব্যারিকেডের উপর দিয়ে পার হয়ে গেলো আবার কেউ কেউ নিচ দিয়ে চলে গেলো। সেটা দেখে আমার মনে তখন দৃঢ় প্রত্যয় হলো যে আমি ব্যারিকেডের উপর দিয়েও যাবো না আর নিচ দিয়েও যাবো না। আমি এই ব্যারিকেড ভেঙেই যাবো। তখন আমি গিয়ে ব্যারিকেড নাড়া দিচ্ছি, তখন আমার দেখাদেখি সবাই সেটা নাড়া দিতে থাকলো। তখন লাঠিচার্জ হলো, আমার পিঠেও তখন লাঠিচার্জ হচ্ছিলো। আমাদের মুখে তখন একটাই বাক্য ছিল, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। পরের দিন ২২ শে ফেব্রুয়ারি আমাদের শোক মিছিল হলো। তরুণ প্রজন্মকে বলবো ভাষা আন্দোলন থেকে আজকের যে বাংলাদেশ যা মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হয়েছে। সেই ইতিহাস জানুক তারা। আর ভাষার লড়াই আমাদের চিরকালের। নতুন প্রজন্ম যেভাবে কথা বলছে সেটাতো আমাদের ভাষা না। তাদের কাছে আমার আবেদন যে তারা সঠিক বাংলা বলুক।
ভাষাসৈনিক রওশন আরা বাচ্চুর সেই ইচ্ছেকে কাজে লাগাতে তারুণ্যের চেষ্টায় আমি-আমরা এগিয়ে চলতে চলতে যখন দেখলাম- ভাষাসৈনিক ন রওশন আরা বাচ্চুর শেষযাত্রায় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতির অবহেলা-এড়িয়ে চলা, তখন বলতে বাধ্য হলাম- এই দেশ শুধুমাত্র দালাল-চামচাদের। যেকারণে প্রকৃত দেশপ্রেমিকের জন্য শহীদ মিনার নেই, নেই যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের ব্যবস্থা। এই পরিস্থিতিতে তারুণ্যের রাজনীতিক হিসেবে ক্ষমা চাইছি, শিক্ষা-সাহিত্য-সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কর্মী হিসেবে বিনয়ের সাথে ক্ষমতা চাইছি। ভাষাসৈনিক রওশন আরা বাচ্চু ভাষা আন্দোলনের সময় ১৯৪৯ সালে বরিশাল বিএম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৫২ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হয়েও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভাষা আন্দোলনের পক্ষে সংগঠিত করার জন্য কাজ করেছেন। ফেব্রুয়ারির উত্তাল আন্দোলনে তিনি ছিলেন সক্রিয়। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হলে তিনি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে অংশ নিয়েছেন, বক্তব্য রেখেছেন।
সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারি হরতাল আহ্বান করায় সরকার বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে এবং পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে। এ সময় যে সব ছাত্রছাত্রী ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করাই আন্দোলনের জন্য প্রয়োজন মনে করেন, রওশন আরা বাচ্চু তাদের মধ্যে একজন। ২১ ফেব্রুয়ারিতে তিনি ইডেন কলেজ ও বাংলাবাজার বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের একত্রিত করে আমতলার সমাবেশস্থলে নিয়ে আসেন। তারা ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগানে মুখরিত করেছিলেন চারদিকে।
ইতিহাস বলে- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবেশস্থলটির বাইরে পুলিশ লাঠি দিয়ে ব্যারিকেড দিয়েছিল। শাফিয়া খাতুন লাঠির ওপরে দিয়ে লাফিয়ে এবং হালিমা খাতুন নিচ দিয়ে বের হয়ে গেলেও রওশন আরা বাচ্চু তা করেননি। তার ভাষায়, ‘আমি দেখলাম, দুটি দলের কেউ কেউ পুলিশের কর্ডন লাঠির উপর দিয়ে এবং কেউ কেউ লাঠির নিচ দিয়ে যাচ্ছিল। আমি তা দেখে থর থর করে কাঁপছি। আমার মধ্যে জেদ চেপে বসল। মনে মনে স্থির করলাম, আমিতো মাথা নত করে যাব না এবং লাঠির উপর দিয়েও যাব না। যেতে হলে ব্যারিকেড ভেঙে তবেই যাব এবং তৃতীয় দলের সঙ্গে বেরিয়ে আমিই প্রথম ব্যারিকেড ভেঙেছিলাম।’ এদিকে পুলিশ ব্যারিকেড ভাঙার দৃশ্য দেখামাত্রই লাঠিপেটা শুরু করে দেয়। লাঠির আঘাতে তিনি আহত হন। সেদিন বিকেলে পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের সদস্য আনোয়ারা খাতুন বক্তব্য রাখতে গিয়ে যে দুজন আহত ছাত্রীর পরিচয় তুলে ধরেন তাদের মধ্যে একজন ছিলেন বেগম রওশন আরা বাচ্চু। এরই মধ্যে বর্তমান কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পার্শ্ববর্তী এলাকা পুলিশের মুহুর্মুহু গুলির শব্দে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। তখন রওশন আরা বাচ্চু পাশে স্তূপীকৃত ভাঙা রিকশার নিচে গিয়ে আশ্রয় নেন। সময় বুঝে পরে এসএম হলের প্রভোস্ট ড. গনির পাশ্ববর্তী বাড়িটিতে আশ্রয় নেওয়ার জন্য রওনা হন। সে বাড়িটির কাঁটাতারের সঙ্গে শাড়ির আঁচল আটকে যায় তার। এ সময় কেউ একজন তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন। অবশেষে তিনি কাঁটাতারের বেড়া পার হয়ে ড. গনির বাসায় আশ্রয় নিতে সক্ষম হন। বিশ্বাবিদ্যালয়ের প্রক্টরের অনুমতি ছাড়া ছেলেদের সঙ্গে কথা বললে সে সময় ১০ টাকা জরিমানা করা হতো মেয়েদের। আন্দোলনে গেলে পড়াশোনা বন্ধ করে দেওয়ার পারিবারিক হুমকিও ছিলো। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে অনুষ্ঠিত অন্যান্য সভা ও সমাবেশে তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছেন। কোন ভয়ভীতি তাকে ভাষাচেতনার আদর্শ থেকে এতটুকুও বিচ্যুত করতে পারেনি।
১৯৩২ সালের ১৭ ডিসেম্বর সিলেটের মৌলভীবাজার জেলায় কুলাউড়ার উছলাপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন রওশন আরা বাচ্চু। তার বাবা এম আফরেফ আলী, মা মনিরুন্নেসা খাতুন। ১৯৪৭ সালে রওশন আরা বাচ্চু শিলং লেডি কিন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক, ১৯৪৯ সালে বরিশাল বিএম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট, ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে স্নাতক সম্মান পাশ করেন। ১৯৬৫ সালে বিএড এবং ১৯৭৪ সালে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। রওশন আরা বাচ্চু ‘গণতান্ত্রিক প্রোগ্রেসিভ প্রন্ট’-এ যোগ দিয়ে ছাত্ররাজনীতি শুরু করেন। পরবর্তীকালে ঢাকার আনন্দময়ী গার্লস স্কুল, নজরুল একাডেমী, কাকলী হাইস্কুলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেন। তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হল এবং উইমেন্স স্টুডেন্টস রেসিডেন্সের সদস্য নির্বাচিত হন।
তিনি নিরন্তর যোদ্ধা ছিলেন, আর তাই পায়শই বলতেন- মেহেদী, ভাষার বিকৃতি সহ্য হয় না। যে ভাষার জন্য এত ত্যাগ স্বীকার করলাম, সে ভাষাই আজ বিকৃত হয়ে যাচ্ছে। অশুদ্ধ উচ্চারণ, ভুল বানান, বাংলা-ইংরেজি মিলিয়ে এখন বাংলা বলা হচ্ছে। এতে ভাষা-সংস্কৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ প্রজন্মের কাছে আমার চাওয়া, যে ভাষার জন্য সালাম-রফিক রক্ত দিয়েছে, আমরা জীবন বাজি রেখেছি, সে ভাষাকে তোমরা অন্তত শুদ্ধভাবে ব্যবহার করো। বিকৃত করে মধুর বাংলা ভাষা ধ্বংস করো না। ভাষাসংগ্রামের ইতিহাস বিকৃত হয়েছে। ইতিহাসে নারীর ভূমিকা সেভাবে উঠে আসেনি। অথচ ভাষাসংগ্রামে নারীদেরও অগ্রণী ভূমিকা ছিল। ইতিহাস সংশোধন হওয়া প্রয়োজন।
আমরাও বলতে চাই- সাহস-সত্য-সুন্দরের ইতিহাস বিকৃত করা বন্ধ হোক। আলোর পথে চলুক বাংলাদেশ-ভালোর পথে চলুক বাংলাদেশ।
যে আলোর পথের রওশন আরা বাচ্চু মনে করেন- ভাষা আন্দোলনে আমার জড়িত হওয়ার পেছনের কারণ বলতে আমি ছোট্ট একটি ঘটনা বলতে চাই। আমাদের এলাকায় মেয়েদের পড়াশোনার প্রচলন ছিলো না। তাই আমাকে শিলং পাঠানো হলো। সেখানে আমি পড়াশোনা করছিলাম। তখন একসময় শিলং টাউনহলে গান্ধীজি এসেছিলেন, তার বক্তব্য শুনেছি। নেতাজি সুভাষ বোসের বক্তব্য শুনেছি। তাদের যে নীতি, তাদের যে সংগ্রাম সেগুলো আমাকে উদ্ভুদ্ধ করেছিল। দেশ যখন বিভক্ত হলো তখন দেখলাম আমরা আমাদের যে অধিকার রয়েছে তা পাচ্ছি না তখন সেই যে চেতনা সেই যে সংগ্রামী মনোভাব সেখান থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন আমি ভাষা আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলাম। সুফিয়া, হালিমা খাতুন, শরিফা খাতুনসহ আরো অনেক মেয়েরাই ছিলো তখন।
আমাদের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেদের সাথে কথা বললে ১০ টাকা ফাইন করা হতো, হল থেকে বের করে দিতো, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে দিত। জরিমানা, হল থেকে বের করে দেয়া, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে দেয়া, পরে পরিবারের সম্মুখে সমস্যায় পড়া এই সবকিছুর ভয় মাথায় নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েছিলো মেয়েরা। নাজিমুদ্দীনের ঘোষণা শুনে আমরা ছাত্র-ছাত্রীরা যখন ঠিক করলাম আন্দোলন করার। তার আগে ৪ ফেব্রুয়ারি আমরা যে ধর্মঘট করেছিলাম, সেখানেই ঠিক করেছিলাম সমস্ত বাংলাদেশে এটি ছড়িয়ে দিবো। প্রত্যন্ত গ্রামে শিক্ষার্থীদেরও জড়ো করবো। সেটা দেখেই সরকার ২০ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা জারি করলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা বললো- আমরা যেভাবেই হোক ১৪৪ ধারা ভাঙবো। আর সেটিই ছিলো ২১ শে ফেব্রুয়ারির কর্মসূচি।
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারীর রওশন আরা বাচ্চু চলে গেলেন নিরব বেদনা আর চাপা কষ্ট নিয়ে। তবু বলবো- বাংলা ভাষার জন্য নিবেদিত ছিলেন তিনি সবসময়...
রওশন আরা বাচ্চু ২০১৯ সালের ৩ ডিসেম্বর সকাল সোয়া ১০টার সময় ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। জীবনের প্রতিটি দিন নিরন্তর ভাষা- দেশ- মানুষের ভালোবাসা নিয়ে এগিয়ে চলা লোভ মোহহীন নিরলস ভাষাসনিকের জন্য প্রার্থণা। যেখানে থাকুন ভালো থাকুন...
মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি