বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪৮ বছর হতে চলেছে। এ দীর্ঘ সময়ে পেরিয়ে গেলেও এখনো হয়নি মুক্তিযোদ্ধার নির্ভুল তালিকা। যার দরুণ এখনো ‘মুক্তিযোদ্ধার তালিকা’ নিয়ে নানা মহলে চলছে তর্ক-বিতর্ক। অনেকে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযোদ্ধে অংশ গ্রহণ না করেও নামে আগে ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ খেতাব লাগিয়ে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ বনে গেছেন। ফলে সঠিক যোদ্ধা না হয়েও অনেকেই সরকারিসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন।
বড়ই লজ্জার বিষয় হচ্ছে যে, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা নিশ্চিত করা যায়নি স্বাধীনতার ৪৮ বছরেও। নির্ভুল ও সঠিক তথ্যভিত্তিক মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করতে পারেনি কোনো সরকার। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম সংখ্যা দেওয়া হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের। বিভিন্ন সরকার আমলে সঠিকভাবে তথ্য যাচাই-বাছাই না করেই ‘মুক্তিযোদ্ধা সনদ’ দেওয়া হয়েছে। এখনো অনেকে মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেওয়ার জন্য দৌড়ঝাঁপ করছেন, দেওয়াও হচ্ছে। এসব সনদ দেওয়ার ক্ষেত্রে মানা হচ্ছে না কোনোরকম নিয়মকানুন। সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে না। যে-যার প্রয়োজনে ও সুবিধা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধার গেজেট করাচ্ছেন। মন্ত্রণালয়ও একেক সময় একেক পরিপত্র ও প্রজ্ঞাপন জারি করছে।
বর্তমানে গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ২ লাখ ৩৫ হাজার। এর মধ্যে সরকারের কাছ থেকে প্রতি মাসে ভাতা পাচ্ছেন ১ লাখ ৮৫ হাজার মুক্তিযোদ্ধা। বাকি ৫০ হাজারের ভাতা বন্ধ রয়েছে। কিন্তু কেনো তাদের ভাতা বন্ধ তা পরিষ্কার করেনি সরকার। তাদের সনদও বাতিল করা হচ্ছে না। তবে তাদের অনেকের সন্তানরা ওই সনদ দেখিয়ে বাগিয়ে নিয়েছেন সরকারি চাকরি।
সংশ্লিষ্ট অনেকের মতে, ওই ৫০ হাজার প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নন। ভুল তথ্য-উপাত্ত দিয়ে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে তারা মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়েছেন। এদিকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ২৫৭ জনের সনদ বাতিল করেছে। এর মধ্যে বিভিন্ন বাহিনী ও সরকারি দফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীও রয়েছেন। আর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্তির বিষয়ে গত সেপ্টেম্বরে নতুন করে যুক্ত করা হয়েছে ‘প্রবাসে বিশ্বজনমত’ নামে আরেকটি শ্রেণি। ওই শ্রেণিতে একই মাসে একজনকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চিহ্নিত করে গেজেটও প্রকাশ করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও অন্য একাধিক সূত্র থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে যারা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন তাদের মতে, যে প্রক্রিয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করা হচ্ছে, তাতে কেয়ামত পর্যন্ত প্রকৃত তালিকা তৈরি করা সম্ভব হবে না। বরং অমুক্তিযোদ্ধারাই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছেন, সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছেন।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়সূত্রে জানা গেছে, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত করার জন্য এখন গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে লাল মুক্তিবার্তা, ভারতীয় তালিকা ও বিভিন্ন বাহিনীর গেজেটকে। আর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি ভাতা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি মানদ নির্ধারণ করে গত ২৪ এপ্রিল প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে। ওই প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতীয় তালিকা, ভারতীয় তালিকা (পদ্মা), ভারতীয় তালিকা (মেঘনা), ভারতীয় তালিকা (সেক্টর) ও ভারতীয় তালিকা (সেনা, নৌ, বিমান বাহিনী); লাল মুক্তিবার্তা, লাল মুক্তিবার্তা স্মরণীয় যারা বরণীয় যারা; বেসামরিক গেজেট, মুজিবনগর গেজেট, বিসিএস ধারণাগত জ্যেষ্ঠতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তা গেজেট, বিসিএস গেজেট, স্বাধীন বাংলা শব্দসৈনিক গেজেট, বীরাঙ্গনা গেজেট, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল গেজেট, ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন বিশেষ বাহিনী গেরিলা বাহিনী গেজেট ও বিশ্রামগঞ্জ হাসপাতালে নিয়োজিত অথবা দায়িত্ব পালনকারী মুক্তিযোদ্ধা গেজেট এবং সেনাবাহিনী-বিমানবাহিনী গেজেট, নৌবাহিনী গেজেট, নৌ-কমান্ডো গেজেট, বিজিবি গেজেট, পুলিশবাহিনী গেজেট ও আনসার বাহিনী গেজেটকে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের চিহ্নিত করতে যেখানে লাল মুক্তিবার্তা ও ভারতীয় তালিকা রয়েছে, সেখানে নতুন করে বিভিন্ন ভাগে শ্রেণিবিন্যাস করে মুক্তিযোদ্ধা শনাক্ত করা নিয়েও আছে নানাবিধ বিতর্ক।
দেশ স্বাধীনের পর ১৯৮২-৮৩ সাল পর্যন্ত দেশে কোনো মুক্তিযোদ্ধার তালিকা তৈরি করা হয়নি। ১৯৮২ সালে তৎকালীন সেনাপ্রধান এইচ এম এরশাদ ক্ষমতা দখলের পর সামরিক অধ্যাদেশ জারি করে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও চেয়ারম্যান হন। এরশাদ সংসদের দায়িত্ব নেওয়ার কিছুদিন পর প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করার উদ্যোগ নেন। এতে সারা দেশে ১ লাখ ৩-৪ হাজার মুক্তিযোদ্ধার তালিকা করা হয়। তবে এ তালিকা নিয়ে সব মহলে বিতর্ক তৈরি হয়। অভিযোগ উঠে, কোনোরকম যাচাই-বাছাই ও সঠিক প্রক্রিয়া অনুসরণ না করেই মুক্তিযোদ্ধাদের ওই তালিকা করা হয়। এরপর এ প্রক্রিয়া অনেকটা চাপা পড়ে যায়। এভাবে আরও বেশ কয়েক বছর কেটে যায়।
জানা গেছে, ১৯৭২-৭৩ সালের দিকে অনেক পরিবারের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমবারের মতো মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পরিবারকে ২ হাজার এবং আহতদের ৫০০ ও ১ হাজার টাকা করে এককালীন ভাতা দেন। যদিও স্বাধীনতার দুই বছরের মধ্যে জেনারেল এম এ জি ওসমানীর সীল ও স্বাক্ষরযুক্ত কিছু সার্টিফিকেট মুক্তিযোদ্ধা দাবিদার অনেককে দেওয়া হয়। পরে এ সার্টিফিকেট বাজারে বিক্রি হতে থাকে। এ সার্টিফিকেট নিয়েও তৈরি হয় নানাবিধ বিতর্ক। একইভাবে স্বাধীনতা-পরবর্তী তৎকালীন স্বরাষ্ট্র সচিব তসলিম আহমদের সীল ও স্বাক্ষরযুক্ত কিছু সার্টিফিকেট দেওয়া হয় মুজিববাহিনী হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ) সদস্যদের।
১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকট মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের তৎকালীন চেয়ারম্যান চেয়ারম্যান আবদুল আহাদ চৌধুরী মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাসংবলিত দাবি-দাওয়া উপস্থাপন করেন। প্রধানমন্ত্রী এতে আগ্রহ প্রকাশ করলে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল তিন দিনের মধ্যে একটি ফরম্যাট প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করে। এরপর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ১৯৯৮ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর মহাপরিচালক মমিন উল্লাহ পাটোয়ারী স্বাক্ষরিত একটি চিঠি ইস্যু করা হয়। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের কাছে পাঠানো ‘মুক্তিযোদ্ধা তালিকা চূড়ান্তকরণ’ বিষয়ক ওই চিঠিতে মুক্তিযোদ্ধা তালিকা কী পদ্ধতিতে হবে তার দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়।
প্রধানমন্ত্রীর দফতরের ওই চিঠি থেকে জানা যায়, এ ক্ষেত্রে চারটি বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়। প্রথমত, একটি কমিটি গঠনের কথা উল্লেখ করে বলা হয়, কমিটিতে থাকবেন, ১৯৭০ সালের জাতীয় পরিষদ এবং প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সংশ্লিষ্ট সদস্য, কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি, জেলা কমান্ডের প্রতিনিধি, সংশ্লিষ্ট থানা কমান্ডের সব কর্মকর্তা, যুদ্ধকালীন বিভিন্ন পর্যায়ের পাঁচজন কমান্ডার; সংশ্লিষ্ট থানার পাঁচজন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা এবং সংশ্লিষ্ট থানার অধীন প্রত্যেক ইউনিয়ন কমান্ডের কমান্ডার ও একজন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা।
দ্বিতীয়ত, যাচাই কার্যক্রম পদ্ধতি হবে- কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল কর্তৃক নির্ধারিত দিন, সময় ও স্থানে কমিটির সদস্যদের উপস্থিতিতে কেন্দ্র থেকে প্রেরিত খসড়া তালিকা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট থানার মুক্তিযোদ্ধাদের একটি একটি করে নাম ও বিবরণ ঘোষণার পর কমিটি হ্যাঁ-সূচক জবাব দিলে নামের ডান পাশে ‘টিক’ চিহ্ন দেবে; না-সূচক জবাব দিলে নামের পাশে ‘ক্রস’ চিহ্ন দেবে; ক্ষেত্রবিশেষ কমিটির সদস্যদের মত দ্বিধাবিভক্ত হলে ‘প্রশ্নবোধক’(?) চিহ্ন দেবে এবং সরেজমিন যাচাই করে সিদ্ধান্ত নেবে। তৃতীয়ত, আপিল বোর্ড গঠন করা হবে। মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী কোনো মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত না হতে পারলে বা ফরম পূরণ করেননি এমন অভিযোগ করলে কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল আপিল বোর্ড গঠন করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। চতুর্থত, থানা পর্যায়ে গঠিত কমিটি কর্তৃক তালিকা চূড়ান্তকরণ বিষয়ে একই পদ্ধতি অনুসরণার্থে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল একটি গাইডলাইন তৈরি করবে এবং কমিটিকে তা অনুসরণ করতে অনুরোধ করবে।
জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ওই চিঠির ফরম্যাট অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পক্ষ থেকে আবেদন আহ্বান করা হয় মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। ওই আহ্বানের পর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দাবিদার প্রায় ৫ লাখ আবেদন জমা পড়ে। এসব আবেদন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুযায়ী যাচাই-বাছাই করা হয়। দীর্ঘ যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল ১ লাখ ৫৬ হাজার মুক্তিযোদ্ধার তালিকা চূড়ান্ত করে ‘লাল বই’ বের করে। ওই তালিকা করার ক্ষেত্রে ভারতীয় তালিকাকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়। ভারতীয় তালিকায় ৫৫ থেকে ৫৬ হাজার মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। যারা একাত্তরে ভারতের বিভিন্ন ক্যাম্পে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এবং যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। তাদের নাম, ঠিকানা ভারতীয় বাহিনীর কাছে রয়েছে, যা ১৯৭৩ সালে ভারত সরকার ও সে দেশের সেনাবাহিনী বাংলাদেশ আর্মির কাছে হস্তান্তর করে। ওই তালিকা চট্টগ্রামে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল কোর (ইবিআরসি) সংরক্ষণ করে।
জানা গেছে, পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই-বাছাইয়ের পর ২৭৮ খ-ের লাল বই তৈরি করা হয়। তারপর একে সেনা, নৌ, বিমান, পুলিশ, বিজিবি, আনসার, সাধারণসহ পৃথক আটটি খ- করা হয়। তার পরও যদি মুক্তিযোদ্ধারা বাদ পড়েন ওই সংখ্যা ১৫ থেকে ২০ হাজারের বেশি হবে না। লাল বই তৈরির মধ্য দিয়ে ২০০১ সালের মধ্যেই মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত তালিকা করা হয়।
২০০১ সালের শেষ দিকে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার প্রথমবারের মতো মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করে। মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী পদে নিযুক্ত হন রেদওয়ান আহমদ। তার নেতৃত্বে শুরু হয় মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা। এসময় গেজেটভুক্ত করা হয় ৫০ হাজারের বেশি মুক্তিযোদ্ধাকে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়সূত্রে জানা গেছে, মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক আছে এবং চলছেও। অনেকেই বলছেন, এসব মুক্তিযোদ্ধার অনেকেই নিজেদের রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তালিকাভুক্ত হয়েছেন। ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছেন। আবার কারও কারও নাম বাদও পড়ছে। তবে এ সংখ্যা নগণ্য।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এস এম আরিফ-উর-রহমান গণমাধ্যমে জানান, যারা ভাতা পাচ্ছেন না তারা হয়তো ভাতার জন্য আবেদন করেননি। আবার মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সঠিক তথ্য না থাকার কারণে প্রায় সাড়ে ৩ হাজারের ভাতা বন্ধ রয়েছে। সচিবের মতে, মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। তিনি বলেন, আমাদের এখানে যে সংখ্যা আছে তা সঠিক। গেজেটে যখন নাম আছে, সেটাই আমাদের প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। তিনি আরও দাবি করেন, মুক্তিযোদ্ধার তালিকা চলমান। এটা বন্ধ হওয়ার সুযোগ নেই।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র জানিয়েছেন, দেশে মুক্তিযোদ্ধার প্রকৃৃত সংখ্যা সব মিলিয়ে ১ লাখ ৮০ থেকে ৮৫ হাজারের বেশি হবে না। লাল বইয়ে যাদের নাম আছে তারাই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা উল্লেখ করে ওই সূত্রগুলো বলছেন, বিভিন্ন কারণে বড়জোর ২৫ থেকে ৩০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে বাদ পড়তে পারেন। (তথ্যসূত্র : বা.প্রতি- ০১.১২.২০১৯)
মুক্তিযোদ্ধার প্রকৃত তালিকা পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৮৮ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত সময়ে পাঁচবার এ তালিকা সম্পূর্ণ করার চেষ্টা করা হয়। প্রকাশিত পরিসংখ্যানের বৈশিষ্ট্য প্রধানত দুই ধরনের প্রতীয়মান হয়। প্রথমত , রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সঙ্গে নতুন করে তালিকা প্রণয়ন। দ্বিতীয়, তালিকায় মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা বৃদ্ধি। ১৯৮৮ সালে প্রণীত হয় প্রথম তালিকা। এ তালিকায় ৬৯ হাজার ৮৩৩জন মুক্তিযোদ্ধার নাম উঠে আসে। ১৯৯৪ সালে দ্বিতীয়বার তালিকা প্রণীত হয়। এ তালিকায় ৮৬ হাজার মুক্তিযোদ্ধার নাম উল্লেখ করা হয়। তৃতীয় তালিকা হয় ১৯৯৯ সালে। এ তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৫৮ হাজার ৪৫২। চতুর্থ তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ ৯৮ হাজার ৮৮৯। পঞ্চম তালিকায় ২ লাখ ৩১ হাজার ৩৮৫জন মুক্তিযোদ্ধার নাম আসে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ২০০৯ সালে তালিকা সংশোধন শুরু করে ২০১২ সালে দুই লাখ ৯ হাজার জনের নাম দিয়ে একটি তালিকা প্রকাশ করে। এতেও বির্তক পিছু ছাড়েনি। ষষ্ঠ তালিকা সম্পন্ন করার এখনো কাজ চলছে। এ কাজ কবে শেষ হবে, বলা কঠিন। কারণ, এ বিষয়ে হাইকোর্টে একটি রিট হয়েছে। রিটের রায় ঘোষণার পরই জানা যাবে, পরবর্তী সরকারি পদক্ষেপ কী হবে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকার বিষয়ে। আমরা মনে করি, মুক্তিযোদ্ধার প্রকৃত তালিকা স্বাধীনতা ৪৮ বছরেও না করায় এ বিষয়টি এখন জাতীয় লজ্জায় পরিণত। এখন উত্তোরণই হবে সব পক্ষের মঙ্গলজনক সমাধান।
এম. কে. দোলন বিশ্বাস, দৈনিক সংবাদের সাবেক সহ-সম্পাদকীয়