বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার অন্তর্গত টেকনাফ উপজেলার একটি ইউনিয়ন সেন্টমার্টিন। এটি একটি বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ এবং এটি বাংলাদেশের সর্ব-দক্ষিণের ইউনিয়ন। দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিনে রয়েছে সাগরের স্বচ্ছ নীল পানির বুকে জেগে থাকা আরণ্যক সৌন্দর্যম-িত প্রবাল-শৈবাল আর সামুদ্রিক নানা প্রজাতির জলজ প্রাণী। সাগরে স্বচ্ছ নীল জলরাশি আর প্রকৃতির মিতালি দেখতে প্রতিদিন ছুটে যান দেশ-বিদেশের হাজারো পর্যটক। কিন্তু দর্শনার্থীদের অবাধ যাত্রা, মানুষের চাপ, নির্বিচারে শিকার ইত্যাদি কারণে হুমকির মুখে সেন্টমার্টিনের জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ। সেই সঙ্গে বিপন্ন পুরো সেন্ট মার্টিন।
সরকার ১৯৯৯ সালে দ্বীপটিকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করে। অর্থাৎ, এ দ্বীপের পানি, মাটি, বায়ু বা প্রাণীর ক্ষতি করে, এমন কোনো কাজ এখানে করা যাবে না। কিন্তু এ দ্বীপে পর্যটন বা লোকবসতির বিস্তার সে কথা মাথায় রাখছে না। সেন্ট মার্টিনকে বাঁচানোর জন্য পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় গত বছরের ডিসেম্বরে একটি আন্তমন্ত্রণালয় সভা করেছিল। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, গত মার্চ থেকে পর্যটক কম যাবে। এবং কেউ রাতে থাকবে না। ক্রমে বছরের নির্দিষ্ট সময়ে পর্যটকের সংখ্যা বেঁধে দেওয়া হবে। তবে সিদ্ধান্তটি বস্তবায়ন হয়নি। দ্বীপজুড়ে দিনে-রাতে মানুষের বিচরণ চোখে পড়ে।
একটি আন্তর্জাতিক সাময়িকীর ২০১৬ সালের জানুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত গবেষণাপত্র বলছে, সেন্ট মার্টিনে ১৯৮০ সালে ১৪১ প্রজাতির প্রবাল ছিল। দ্বীপসংলগ্ন প্রবালের ওপর পরিবেশের প্রভাব নিয়ে বাংলাদেশের চারজন গবেষকের করা ওই গবেষণা বলছে, ২০১৬ সালে তা ৪১টিতে নেমে এসেছে। সুরক্ষার উদ্যোগ না নিলে ২০৪৫ সালের মধ্যে দ্বীপটি প্রবালশূন্যও হয়ে যেতে পারে। ঝুঁকির মূল কারণ হচ্ছে প্রবাল সংগ্রহ এবং অতিরিক্ত মাছ ধরা। এ ছাড়া সামনে প্রবাল আহরণ থেকেও ঝুঁকি আসতে পারে।
এর আগে গত অক্টোবরে ‘ট্রাভেলার্স অফ বাংলাদেশ’ নামের ফেসবুক ভিত্তিক একটি গ্রুপ সেন্টমার্টিন দ্বীপে একটি পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালিয়ে সেখান থেকে ৫৫৫ কেজি প্লাস্টিক বর্জ্য উদ্ধার করে। পরে গ্রুপের পক্ষ থেকে সেন্টমার্টিন রক্ষায় জনস্বার্থে একটি রিট দায়ের করা হয়। রিটে সেন্টমার্টিন দ্বীপের পরিচ্ছন্ন ও দূষণমুক্ত পরিবেশ রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সংশ্লিষ্টেদের ব্যর্থতা তুলে ধরা হয়। পরে সেই রিটের প্রেক্ষিতে সেন্টমার্টিন দ্বীপের পরিবেশ রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। পর্যটন সচিব, বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন সচিব ও স্বরাষ্ট্র সচিবকে চার সপ্তাহের মধ্যে এ রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
সেন্টমার্টিন শুধু বাংলাদেশের নয়, এটি বিশ্বের প্রবাল দ্বীপগুলোর মধ্যে অন্যতম। আরও ২০ বছর আগে সরকার কর্তৃক দ্বীপটিকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা দেওয়া হলেও এটি রক্ষায় এখন পর্যন্ত কার্যকর পদক্ষেপ না থাকাটা হতাশাব্যাঞ্জক। এছাড়া দ্বীপটিতে দর্শনার্থীর সংখ্যা কমানোর উদ্যোগে ব্যর্থতাও গ্রহণযোগ্য নয়। সেন্টমার্টিন রক্ষায় শেষ পর্যন্ত উচ্চ আদালতকে হস্তক্ষেপ করতে হলো। আমরা আশা করি কর্তৃপক্ষ যথাযথভাবে রিটের জবাব দেবে এবং দ্বীপটি রক্ষায় উদ্যোগ নেবে। আর এটি শুধু আদালতের নির্দেশ পালনের উদ্দেশ্যে নয়, দেশের গুরুত্বপূর্ণ একটি এলাকাকে বিপন্ন হওয়ার হাত থেকে রক্ষার জন্য সরকারকে আন্তরিক হতে হবে।