ছোটো বেলায় পরীক্ষার প্রস্তুতিতে ভয় পেলে বাড়িতে বাবা-মা, পরীক্ষার হলে শিক্ষকরা বলতেন, ‘যা পারো বানায়ে-বানায়ে মনের মাধুরী দিয়ে লিখে এসো। পরীক্ষার খাতা খালি রাখবা না।’ আমাদের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আদর্শবান কর্মকর্তারাও মা-বাবা ও শৈশবের শিক্ষাগুরুর উপদেশের কথা ভুলেননি। তারা মনের মাধুরী মিশিয়ে তৈরি করেছেন রাজাকারদের তালিকা! কিন্তু তারা ভুলে গেছেন, মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গর্ব, অহংকার! স্বাধীনতা, মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধটা তামাশা ছিলো না! তালিকা করার মুরোদ না থাকলে, না করেন। যা বুঝবো না, পারবো না, তা করবো না! এটাতো শিশুদের ক্লাসের পরীক্ষা দেয়া নয়! একটি তালিকা প্রকাশের পূর্বে যাচাই-বাছাই, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা প্রয়োজন নয় কী? মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করা হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধকেই বিতর্কিত করা, মানহানি ও ভুয়া সনদ দিয়ে সচিবদের চাকরির বয়স বাড়ানোর জন্য নয়। কাজ না থাকলে সরকারকে জানান। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ছাড়াও ইতোপূর্বে দেশ চলেছে। বিজয় দিবসের প্রাক্কালে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান? কি দেখার ছিল, আজ আমরা কি দেখছি! ইতোপূর্বে রাজাকারদেরও মুক্তিযুদ্ধের সনদ ও রাষ্ট্রীয় সুবিধা দেয়ার খবর রয়েছে। এতেও মন্ত্রণালয়ের সাধ মিটেনি। এবার খোদ মুক্তিযোদ্ধাদেরও রাজাকার বানিয়ে ছাড়লো!
মুক্তিযোদ্ধাদের সরকারি চাকরির মেয়াদ দুই বছর বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়ায় ইতোপূর্বে সচিব পর্যায়ের অন্তত পাঁচজন কর্মকর্তা দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছিলেন। তখনই বোঝা উচিত ছিল, মুক্তিযুদ্ধের এতো বছর পর সব বিষয়ে সঠিক তথ্যপ্রাপ্তি কতো কঠিন। চেতনার ফ্রাঞ্চাইজির রমরমা বেচা-বিক্রি হয়েছে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট দিয়ে। হাজার নয়, লক্ষ্য কোটি টাকার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ বেচা-কেনার সার্টিফিকেট বাণিজ্য সামলে এ মন্ত্রণালয়ের আবার রাজাকারদের সঠিক তালিকা প্রকাশের সময় কখন?
তালিকায় এমন কিছু নাম যুক্ত হয়েছে, যারা একাত্তরে ছিলেন সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা কিংবা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। এসেছে শহীদ পরিবারের সদস্যদের নামও। আবার কোনো কোনো এলাকার চিহ্নিত রাজাকার বা মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া মানুষটির নাম এই তালিকায় আসেনি। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, আংশিক যে তালিকাটি প্রকাশ করা হয়েছে, সেটা কি নির্ভুলভাবে প্রকাশ করা সম্ভব ছিল না? নাকি ইচ্ছা করেই কেউ ভেতর থেকে সাবোটাজ করেছে? সরকারের এ রকম একটি ভালো উদ্যোগ এভাবে বিতর্কিত করা হলো কেন? মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি বন্ধুদের ক্রেস্টের স্বর্ণের জালিয়াতির কী বিচার হয়েছিল? সেটার বিচার হয়নি বলেইতো ষড়যন্ত্রকারীরা আবারো মুক্তিযুদ্ধ ও সরকারের ইমেজ নিয়ে ছিনিমিনি খেলার সাহস ও সুযোগ নিয়েছে। এ তালিকা প্রকাশ করা থেকেই বোঝা যায় দেশের মন্ত্রণালয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ কাজ কতো হেলাফেলায় করে থাকে। পরবর্তীতে পার পাওয়ার সুযোগ না পেলে, দায় চাপিয়ে দেয় অন্যের ঘারে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পেনড্রাইভে যে তালিকা পাঠানো হয়েছে, সেটাই আমরা প্রকাশ করেছি। এ ক্ষেত্রে আমাদের কী দায় থাকতে পারে। আমরা তো রাজাকারের তালিকাই চেয়েছিলাম।’
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী দায়ি নন। কারণ, পাকিস্তানিরা এ তালিকা করে গেছে! পাকিস্তানের করা রাজাকারের তালিকা আমরা মেনে নেবো কেন? পাকিস্তানীদের তৈরি করা রাজাকারদের তালিকা প্রকাশ ও তা এখন পর্যন্ত সরকারি প্রজ্ঞাপন জারিসমেত প্রত্যাহার না করে সংশ্লিষ্টরা জাতির কাছে ধৃষ্টতার পরিচয় দিয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় গ্রাম, পাড়া, মহল্লা ছাড়াও বাজার থেকে শহর পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক ও বিচক্ষণ মুক্তিযোদ্ধারা ‘গোয়েন্দাগীরি’ করার জন্য দেশপ্রেমিক কতিপয় ‘জানবাজ’ যুবকদের রাজাকারদের দলে নাম লিখিয়ে ও ঘোষণা দিয়ে পাকিস্তানী সৈন্যদের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতেন। তারা পাকিস্তানী হানাদারদের আগামী দিনের পরিকল্পনা সম্পর্কে অবগত হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জানিয়ে দিতেন। এছাড়া দেশপ্রেমিক সেসব যুবকরা রাজাকারদের অভিযান, নির্যাতন ও গতিবিধি সম্পর্কে মুক্তিযোদ্ধাদের খবর দিতেন। দেশ রক্ষায় যে ছেলেটি রাজাকারের দলে নাম লেখালো, যুক্তিযোদ্ধাদের স্বপক্ষে ‘গুপ্তচর’ হিসেবে কাজ করলো, এক সময় হয়তো পাক সেনার কাছে তার গুপ্তচরবৃত্তি প্রকাশ পাওয়ায় তাকে জীবনও দিতে হয়েছে। এই ছেলেটির নামতো পাকিস্তানের দলিল-দস্তাবেজে রাজাকার হিসেবেই থাকবে। তা ছাড়া সব মুক্তিযোদ্ধাদেরও জানা থাকার কথা নয়, এ ছেলেটি আমাদের দলেরই লোক। তাহলে এখন সে রাজাকার হয়ে গেলো? যাচাই-বাছাই না করে পাকিস্তানীদের প্রণীত দলিল সরাসরি প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় বড় কাজের একখান কাজ করে ফেলেছেন!
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সাংবিধানিক বিধান হচ্ছে মন্ত্রণালয়ের সকল সিদ্ধান্তের জন্যে মন্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে দায়ী থাকবেন। কিন্তু মন্ত্রীরা সে দায়ভারকে উপেক্ষা করতে একজন অপরজনকে দোষারোপ করে যাচ্ছেন। এটা কোনো কাঁচা তরকারির বাজারের লিস্ট নয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দিয়েছে বলেই না দেখে-শুনে প্রকাশ করা গেলে, এ কাজের জন্য কেরানি হলেই যষেষ্ট। মন্ত্রী-আমলার কী দরকার? যে তালিকা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় কিংবা আওয়ামী লীগ করেনি, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানিরা রাজাকারদের ভাতা দেয়ার জন্য প্রতিটি থানায় যে তালিকা করেছিল, সেটার উপর নির্ভর করে রাজাকারদের তালিকা প্রকাশ করাটা একটা প্রহসন নয় কী? এতোবড় গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় একবার ভাল করে দেখারও কি সময় হলো না? মুক্তিযোদ্ধাকে রাজাকার বানানো কি মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের কাজ? ইতোপূর্বে নানা ঘটনায় প্রমাণ হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট আজ নিতান্ত হাস্যকর! এখন রাজাকার সার্টিফিকেটও অর্থহীন হয়ে গেলো। পুরো ব্যাপারটা কিন্তু এই মন্ত্রী মহোদয়ের সময়েই ঘটেছে। রাজাকারের তালিকায় জায়গা পাবার জন্যে একজন মুক্তিযোদ্ধা অস্ত্র হাতে দেশ স্বাধীন করতে যাননি। সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করে তাদের জন্য প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধা বংশপরম্পরায় চালু রাখতে চাইছে। বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক মহল, নাগরিক সমাজ ও সংসদে আলোচনা হওয়া জরুরি। আর্থিক ও বৈষয়িক সুযোগ-সুবিধা বংশপরম্পরায় দেয়ার একতরফা সিদ্ধান্ত নিলে তা দীর্ঘমেয়াদে রক্ষা করা সম্ভব হবে কিনা তা আবারো ভাবা জরুরি।
মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসের প্রয়োজনে মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারদের তালিকার একটা ঐতিহাসিক মূল্য থাকলেও এ যাবৎ কোনো সরকারই এ তালিকা প্রকাশের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি। কিন্তু কথিত তালিকা নিয়ে যে বিভ্রান্তি ও বিতর্ক তৈরি হয়েছে তাতে তালিকার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।
মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদরা যেমন জনগণের কাছে উচ্চ মর্যাদায় আসীন, তেমনি রাজাকার ও স্বাধীনতাবিরোধীরা সমাজে ও ইতিহাসে ধিকৃত। একজন মুক্তিযোদ্ধার নামও রাজাকারের তালিকায় প্রকাশ করা সুস্পষ্ট ইতিহাস বিকৃতি। সেখানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতাদের নামও রয়েছে মন্ত্রণালয়ের এই রাজাকারের তালিকায়! আবার বিভিন্ন অঞ্চলের স্থানীয় ও জাতীয়ভাবেও রাজাকার হিসেবে পরিচিত শান্তি কমিটির নেতা বা কুখ্যাত অনেক রাজাকারের নামও নেই এই তালিকায়! এমন একটা স্পর্শকাতর ও সংবেদনশীল বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় কীভাবে এতটা দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিতে পারে তা সত্যিই বিস্ময়কর। তালিকাটি আরো অনেক আগেই হওয়া উচিত ছিল। স্বাধীনতার পর থেকে প্রতিটি সরকারই মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়ন করেছে। কিন্তু কোনোবারেই কোনো তালিকাই বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকতে পারেনি। নিঃসন্দেহে কাজটি চ্যালেঞ্জিং এবং জটিলও বটে।
ইতোমধ্যে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী মোজাম্মেল হক বলেন, রাজাকারের তালিকা নিয়ে অভিযোগ ওঠায় সেই তালিকা স্থগিত করা হয়েছে। যাচাই-বাছাই করে নতুন তালিকা করা হবে। গত বুধবার মানিকগঞ্জে এক সমাবেশে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী রাজাকারের তালিকায় ত্রুটির কথা স্বীকার করে দুঃখপ্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, ‘ওরা (বিএনপি-জামায়াত সরকার) ৩০ বছর ক্ষমতায় ছিল। ক্ষমতায় থাকার সময় হয়তোবা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে রাখা কাগজপত্র কারসাজি করে রাজাকারদের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধাদের নাম লিখে রেখেছে। এটা আমাদের কল্পনার বাইরে ছিল। সে কারণে ভুলটা হয়ে গেছে। আমি দুঃখ প্রকাশ করছি।’
তালিকাতে ভুল থাকার কারণ হিসেবে মন্ত্রী মহোদয়ের উক্তিটা একেবারে ‘সোনা’ দিয়ে বাঁধিয়ে রাখার মত। বাংলাদেশের সবদলের রাজনৈতিক নেতারাই যেনো জাতীর সাথে তামাশা করতে করতে অভ্যস্থ হয়ে গেছেন। আসলে তারা কী পুরো জাতীকেও বোকা মনে করেন? নিজের অপারগতাতো স্বীকার করবেই না, বরং সবসময় অন্য দলের ওপর চাপিয়ে পার পেতে চান। এই মুহূর্তে ‘যতো দোষ নন্দ ঘোষ’ অন্যদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চেতনাবাজরা উঠে পরেই লেগে যাবে। যদিও বিএনপি নামক এক ‘জরাগ্রস্ত’ দলের সেই ক্ষমতা আছে বলে বিশ্বাস হয় না। সরকারি দলের মন্ত্রীরা মাঝে মাঝেই ‘মৃত প্রায়’ বিএনপি দলটিকে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে কৌতুকপূর্ণ মন্তব্য করে অনেকটা কোরামিন ইনজেকশন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখেন, বিষয়টি অনেকেই বোঝেন কিন্তু ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে ফেঁসে যাবেন বিধায় ভয়ে কিছুই বলেন না।
রাজাকার এবং মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা আমলাদের দিয়ে হবে না। যা হবে শুধু রাষ্ট্রের শত কোটি টাকার অর্থের শ্রাদ্ধ। এ বিষয়টি সংশ্লিষ্টরা যত তাড়াতাড়ি বুঝতে পারবেন ততোই মঙ্গল। নইলে আবারও তালগোল লেগে যাবে। রাজাকার এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নির্ভুল তালিকা তৈরি করতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধের গবেষক, বরেণ্য মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে একটি জাতীয় কমিটি গঠন কতে হবে। এই কমিটি জেলা, উপজেলা এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে অনুরূপ কমিটি গঠন করে সুনির্দিষ্ট এবং গবেষণামূলক পদ্ধতি অনুসুরণ করে কাজ করবে। এতে হয়তো সময় লাগবে। কিন্তু আমরা আশা করি ফল ভালো আসবে।