এ বছর স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদে জাতিসংঘের ২৫ তম জলবায়ু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। গত বছর এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল পোল্যান্ডের কাটোভিৎসে। গতবছরের সম্মেলনের শেষ দিনে শেষ পর্যন্ত প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের বিষয়ে ঐক্যমতে পৌছেছিল অংশগ্রহণকারী নেতারা। কনফারেন্স অফ দ্য পার্টি বা কপ নামে পরিচিত জাতিসংঘের এই বার্ষিক আয়োজনের জলবায়ু পরিবর্তন জনিত ভবিষ্যত ঝুঁকি দূরিকরণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে এ বছর জলবায়ু সম্মেলন থেকে বিশে^র প্রাপ্তি কতটুকু? কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে বিশ^ নেতারা ঐক্যমতে পৌছাতে ব্যর্থ হয়েছেন বলা যায়। ২ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়ে ১৩ ডিসেম্বর শেষ হওয়ার কথা থাকলেও কোনো সিদ্ধান্ত না আসায় সময়সীমা আরও বাড়ানো হয়। তবে শেষ পর্যন্ত সাফল্য খুব একটা আসেনি। অতিরিক্ত প্রায় ৩৬ ঘন্টার আলোচনায় কার্বন নিঃস্বরনে বিশ^ব্যপী প্রতিক্রিয়া বাড়ানো মূল প্রশ্নে একমত হয়েছেন বিশ^ প্রতিনিধিরা। কার্বন বাণিজ্য বন্ধের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে রয়েছে বিভাজন। অপেক্ষা আগামী বছরের। জলবায়ু নিয়ে আমাদের ভবিষ্যত আলো অন্ধকারেই রয়ে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর প্রতিটি দেশই কম বেশি ক্ষতিগ্রসথ হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ভেতর বাংলাদেশ রয়েছে চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে। গত বছরে যুক্তরাষ্ট্রের চতুর্থ ন্যাশনাল ক্লাইমেট অ্যাসেসমেন্ট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্র শত শত কোটি ডলার খরচ করলেও লাগামহীন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশটির মানুষের স্বাস্থ্য ও জীবনযাত্রা ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে হুমকির মুখে পড়বে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ঐতিহাসিক হারে কার্বন নিঃসরণ অব্যাহত থাকলে চলতি শতাব্দীর শেষ নাগাদ কয়েকটি অর্থনৈতিকখাতে বার্ষিক ক্ষতির পরিমাণ শত শত কোটি মার্কিন ডলারে পৌছাবে। এইক্ষতির পরিমাণ বহু রাজ্যের জিডিপির চেয়েও বেশি। ক্ষতির প্রকারে পার্থক্য থাকলেও বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলোও রয়েছে চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ দিক সম্প্রতি গবেষকরা জানিয়েছেন। তারা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সংশ্লিষ্ট এলাকার নারীদের গর্ভের সন্তান মারা যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। কারণ হিসেবে বলছেন, মাটিতে বাড়ছে লবণাক্ততার পরিমাণ। ফসল নষ্ট হচ্ছে, মরে যাচ্ছে মিঠা পানির মাছ, কমে যাচ্ছে বিশুদ্ধ খাবার পানি। সেই লবণাক্ত পানি পানের কারণেই বাড়ছে রোগ আর গর্ভের সন্তান মৃত্যুর ঝুঁকি। প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নে এই সম্মেলনে কতদূর অগ্রসর হতে পারবে তা নিয়েই থাকবে প্রধান আলোচনা।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট এখন পৃথিবীর জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। কার্বন নিঃস্বরণ কমানো ছাড়া বিকল্প পথ নেই। ফলে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি বাস্তবায়নে সারাবিশ^ একমত। তবে এই চুক্তি থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্তের যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপ বিশ^বাসীকে হতাশ করেছে। এই পদক্ষেপ এমন এক সময় নেয়া হলো যখন পৃথিবী মারাত্বক পরিণতির জন্য অপেক্ষা করছে এবং মানুষ যেকোনো উপায়ে এই হুমকি মোকাবেলা করার প্রস্তুতি নিতে চলেছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্রও জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের জন্য দায়ী। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা প্রশাসন ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রকে এই চুক্তির অন্তর্ভুক্ত করেছিল। এদিকে ঠিক একই সময়ে বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনে পৃথিবী অবর্ণনীয় দুর্দশার মুখোমুখি হতে যাচ্ছে। ৪০ বছরের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে বায়োসায়েন্স ম্যাগাজিনে প্রকাশিত একটি গবেষণার চিত্রে বিজ্ঞানীরা এমন তথ্য তুলে ধরেছেন। বিজ্ঞানীরা টেকসই ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে আমাদের জীবনযাপনের ধরনে পরিবর্তন আনতে পরামর্শ দিয়েছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব কমাতে তারা ছয়টি পদক্ষেপ নেয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন। জীবাশ্ন জ¦ালানি ব্যবহারের পরিবর্তে নবায়নযোগ্য কম কার্বন নিঃসরণের জ¦ালানি ব্যবহার বিশেষ করে মাংসের প্রতি আসক্তি কমিয়ে উদ্ভিজ খাদ্য গ্রহণ, কার্বনমুক্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার নিয়ন্ত্রণ করা। আমরা বাস্তবিকপক্ষে খুব দ্রুত গতিতে বিপদে পরতে যাচ্ছি। এর থেকে প্রতিরোধের উপায় জানা থাকলেও কাজটি একক নয় বরং সামগ্রিক। ফলে এটি দীর্ঘায়িত প্রক্রিয়া। গ্রেটা থুনব্যার্গ নামটি আজ সারাবিশে^ পরিচিত। জলবায়ু নিয়ে এই একটি মেয়ের বক্তব্য, বিশ^ নেতাদের প্রতি চাওয়া এবং সাহসী ভূমিকার জন্য সে সারাবিশে^ পরিচিত হয়েছে। কেবল গ্রেটা থুনব্যার্গ নয় বরং নতুন প্রজন্মে সবাই চায় একটি নিরাপদ বিশ^ গড়তে এবং নিরাপদ বিশ^ আমাদের ভবিষ্যতের জন্য রেখে যেতে। জাতিসংঘের জলবায়ু বিষয়ক সম্মেলনে সুইডেনের কিশোরী গ্রেটা থুনব্যার্গের ভাষন বিশ^ নেতাদের অন্তর নাড়িয়ে দিতে সক্ষম হলেও তাতে আদৌ অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে একথা নিশ্চিত করে বলা যায় না। যে প্রজন্ম আন্দোলন করে যাচ্ছে একটি সুন্দর পৃথিবীর জন্য। একটি দুষণমুক্ত নিরাপদ পৃথিবীর দাবি আজ সবার। বিশ^ নেতাদের কাছে এটাই চাওয়া। জলবায়ু নিয়ে বিভিন্ন সময়ে সম্মেলনের বহু সিদ্ধান্ত এসেছে। কিন্তু আমরা তার বাস্তবায়ন এবং প্রভাব দেখেছি খুবই কম। শিল্পের যাতাকলে পৃথিবীর অবস্থা আজ অত্যন্ত দুর্বিষহ। দেশগুলোর মধ্যে শিল্পোন্নত দেশ জার্মানি জলবায়ু সুরক্ষা তহবিলে বরাদ্দ দ্বিগুণ করার ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো উল্লেখযোগ্য কিছু দেশ এখানে অংশগ্রহণও করেনি। জলবায়ু পরিবর্তনের দায় কেউ এড়াতে পারে না। কিন্তু কেবল উন্নয়নের দোহাই দিয়ে পৃথিবীর অস্তিত্তকে হুমকির মুখে ফেলে তা থেকে পরিত্রাণের উপায় না খোঁজাটা বড় ধরনের বোকামি।
পরিবেশের বিরুপ অবস্থার সাথে লড়াই করার মত পর্যাপ্ত সামর্থ আমরা এখনো অর্জন করতে পারিনি। তবে পরিস্থিতি কিছুটা উন্নত করতে পেরেছি। সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় বুলবুল আমাদের দেশে আঘাত হানার পর আমরা দক্ষভাবে পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে পেরেছি। কিন্তু বুলবুলের চেয়েও অধিক শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়তো ভবিষ্যতে আঘাত হানতে পারে। আমাদের সেদিনের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। বিগত বছরগুলোতে আইলা বা সিডর বা নার্গিসের মত প্রলয়ংকরী প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতির দিকে তাকালে সহজেই আমরা তা অনুমান করতে পারি। বিভিন্ন সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিভিন্ন সময় প্রচুর মানুষ মারা গেছে। ১৯৭০ সালে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ১০ লাখ লোক মারা গিয়েছিল। আর পার্শ্ব ক্ষয়ক্ষতি তো ছিল আরও ভয়ংকর। ১৯৯১ সালের ঝড়ে প্রায় দেড় লাখ লোক নিহত হয়েছিল। তাছাড়া ১৯৮৮, ১৯৯৮ সালের বন্যাতেও যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আর কয়েক বছর ধরে সবচেয়ে বড় আতংকের নাম ভুমিকম্প। যা মোকাবেলা করার শক্তি আমাদের একেবারেই অপর্যাপ্ত। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে পৃথিবী প্রাণীকুলের বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে পরছে। টিকে থাকা রীতিমত হুমকিতে পরিণত হচ্ছে। জলবায়ু স্বাভাবিক মাত্রায় ফিরিয়ে আনতে ২৫ তম জলবায়ু সম্মেলন ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং বিশ^ তাকিয়ে ছিল। অগ্রগতি যা-ই হোক কিছুটা হয়েছে বলে আগামী বছরের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আগামী বছরের গ্লাসগোর জলবায়ু সম্মেলনের দিকে তাকিয়ে থাকবে বিশ^।
অলোক আচার্য, শিক্ষক ও কলামিষ্ট