‘এইটা একটা বিশ্ববিদ্যালয়? আর আমিও একজন শিক্ষক? ছিঃ ছিঃ ছিঃ...’। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা সন্ত্রাসী কর্মকা- নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। সে বিশ্ববিদ্যালয় কেন বিশ্বের এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে নেই, তা নিয়ে আমাদের কতিপয় বুদ্ধিজীবীমহলের কতই না মায়াকান্না! ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হাতে নির্মমভাবে নিহত বুয়েট ছাত্র আবরারের কথা জাতি এখনও ভুলতে পারেনি। আবরারকে শিবির বলে পিটিয়ে মারা হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বহিরাগত বলে পিটিয়েছে ভিপি নুর ও তার সঙ্গীদের। বহিরাগত থাকলেই হামলা করা, ছাদ থেকে ফেলে দেয়া বৈধ? আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া দেশের প্রচলিত আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো নয় কী? তাহলে ছাত্রলীগ কেন বহিরাগতদের নিয়ে ডাকসুতে মারামারি করল! ক্যাম্পাসে কী কখনো বহিরাগত আসে না? শুধুই আসা-যাওয়া নয়, ছাত্রহলগুলোতে বহিরাগতরা তো সব সময়ই থাকছে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের ‘অতিথি’ হিসেবে। বুয়েটের ঘটনায় একজন শিক্ষার্থীর মৃত্যু হলেও আরও ২০ ছাত্রের জীবন নষ্ট হয়ে গেছে। তারা সবাই মেধাবী ছিল। এই মেধাবী ছাত্ররা রাজনীতির ছত্রছায়ায় এসে একসময় দানবে পরিণত হয়েছে। এসব মেধাবীরা ঠিক কোন প্রক্রিয়ায় দানবে পরিণত হচ্ছে, তা চিহ্নিত করে সেই প্রক্রিয়া বন্ধ করা দরকার।
নুরুল হক ডাকসুর নির্বাচিত ভিপি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাকে নির্বাচিত করে নেতা বানিয়েছে। নুরের কার্যালয়ে আলো নিভিয়ে (নিজেদের আড়াল করতে) যেভাবে হামলা হয়েছে, যা সভ্য সমাজে অচিন্তনীয়। এমনকি হামলাকারীদের নির্দয় আঘাতে সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের এক নেতাকে লাইফ সাপোর্টে পর্যন্ত নিতে হয়েছে। একজন নির্বাচিত ভিপির ওপর দাঙ্গাবাজি কায়দায় বারবার এবং প্রকাশ্যে হামলা? ঢাকার বাইরেও আক্রমণের শিকার হয়েছেন এই ভিপি। এভাবে বারবার প্রাণঘাতী হামলা হচ্ছে, অথচ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, পুলিশ কিংবা সরকার কেউ তাকে ক্যাম্পাসে কিংবা ক্যাম্পাসের বাইরে ন্যূনতম নিরাপত্তাও দিতে পারছে না? প্রশাসন এবং ছাত্রলীগ থেকে বলা হয়েছে, সেখানে ডাকসু ভবনে নুরুর সঙ্গে বহিরাগতরা ছিল। নুরু তা স্বীকার করেই বলছেন, তিনি অনিরাপত্তাজনিত কারণে একা চলাফেরা করেন না। যদি প্রশাসন বহিরাগত বিষয়টিকেই জোর দেয় তাহলে প্রশ্ন, নুরুর নিরাপত্তার জন্য প্রশাসন কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিল?
হামলার প্রতিবাদে চরম ব্যথিত ও মর্মাহত হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রুশাদ ফরিদি নিজের ফেসবুক পেজে আবেগঘন স্ট্যাটাস দেন। এই সহকারী অধ্যাপক এর আগেও বিভিন্ন অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। এ কারণে তাকে ক্লাস পর্যন্ত নিতে দেয়া হয়নি। পরে তিনি সিড়িতে দাঁড়িয়ে ক্লাস নেন। ভিপি নুরের ওপর হামলার ঘটনায় রুশাদ ফরিদির ফেসবুক স্ট্যাটাসটি ছিলো এরকমÑ
‘শিক্ষকতা ছেড়ে দেয়ার সময় হয়েছে। চোখের সামনে ডাকসু ভিপি নুরু আর অন্যান্য ছাত্রদের মেরে শেষ করে ফেলা হল। কিছুই করতে পারলাম না। নিজেদের ছাত্রদের রক্ষা করতে পারি না এই শিক্ষকতার কি দাম আছে? ডাকসু অফিসের দোতলায় উঠে দেখি কেউ কেউ পানি পানি বলে চিৎকার করছে। কেউ অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। ওরা দরজা বন্ধ করে বসেছিল। বার বার আশ্বাস দেয়ার পরেও ভয়ে দরজা খুলছে না। বলছিল, লাইট নিভিয়ে দিয়ে লোহার রড দিয়ে এলোপাথারি মারা হয়েছে। কয়েক বোতল পানি শুধু এগিয়ে দিতে পারলাম। এইটা একটা বিশ্ববিদ্যালয়? আর আমিও একজন শিক্ষক? ছিঃ ছিঃ ছিঃ...’।
‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ’ সংগঠনটির কর্মী পরিচয়ে এর আগেও নুরুলসহ একাধিক ছাত্রনেতার ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। তাদের খুঁটির জোর কোথায়? হামলার ঘটনায় ছাত্রলীগ ও মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নেতারা জড়িত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নামের সংগঠনের নেতারা নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করার কথা নয়। কিন্তু তারা করেছে। এটা নিছকই গু-ামি। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সবচেয়ে পবিত্র বিষয়। এ নাম নিয়ে সংগঠন বানিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকা- করা জঘন্য কাজ। কারা এসব সন্ত্রাসী কাজ ঘটাচ্ছে তাদের চিহ্নিত করা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পক্ষে কোনো কঠিন কাজ নয়। মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নাম দিয়ে কেউ এ ধরনের কাজ করলে তা সমর্থনযোগ্য নয়। সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ঘৃণার আগুন যেন মুক্তিযুদ্ধের পবিত্র নাম স্পর্শ করতে না পারে, সে ব্যবস্থা নিতে দায়ী সব নেতাকর্মীর বিচার ও শাস্তি দেওয়া জরুরি।
ডাকসু ভবনে গত রোববার হামলার নেতৃত্ব দেয়া মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের দায়িত্ব এখন কেউই নিতে চাইছে না। সবাই এখন এই সংগঠনের সঙ্গে নিজেদের সংশ্নিষ্টতা পাশ কাটাতে চাইছে। কারা এই মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ চালাচ্ছে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বিশিষ্টজন বলছেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের নাম নিয়ে যারা এ ধরনের হামলা, সন্ত্রাসী কর্মকা- চালাচ্ছে, তারা কোনোভাবেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কেউ হতে পারে না। এ হামলার ব্যাপারে তারা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের স্পষ্ট অবস্থানও দাবি করেন। প্রশ্ন হলো, এই সরকার কি মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী? নাকি মুক্তিযোদ্ধ প্রজন্মের স্বার্থ বিরোধী। যার জন্য সংগঠন করে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্মের স্বার্থ রক্ষা করতে হবে? ওরা কী সব মানুষকে বোকা মনে করছে? এরা আসলে মুক্তিযুদ্ধকে কলংকিত করে বর্তমান সরকারকেও বিব্রত করছে চাইছে কিনা সংশ্লিষ্টদের ভাবতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ কারো বাক্তিগত বা সাংগঠনিক সম্পত্তি নয়। মুক্তিযুদ্ধ প্রতিটি দেশপ্রেমিক বাংলাদেশির হৃদয়ে মিশে আছে। এর সম্মান আকাশসম। যারা মুক্তিযোদ্ধের নামকে ব্যবহার করে সন্ত্রাসী করে মানুষ হত্যার প্রয়াশ করে, তারা আর যেই হোক কোন দেশপ্রেমিক নয়। তারা প্রকৃত পক্ষেই দেশদ্রোহী, সন্ত্রাসী এবং হিংস্র, হায়েনা। বাংলাদেশের মানুষের শ্রেষ্ঠ অহংকার মুক্তিযুদ্ধ। ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ’ নামীয় সংগঠনটিকে মুক্তিযুদ্ধ শব্দটি ব্যবহার করে করে সন্ত্রাস করার অধিকার কে দিয়েছে? এরা কারা? এরা কবেকার মুক্তিযোদ্ধা?
গত রোববার ডাকসু ভিপি নুরকে তার ডাকসু কক্ষে বাতি নিভিলে পিটিয়ে আহত করেছে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ। ছাত্রলীগ এই হামলায় সরাসরি অংশ নেয় বলে অভিযোগ ভিপি নুরের। এ সময় ভাঙচুর করা হয় ডাকসু ভবনের জানালার গ্লাস, ভিপির কক্ষের কম্পিউটার, চেয়ারসহ বিভিন্ন আসবাব। ছাদ থেকে ছুড়ে ফেলা হয় ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের দুজনকে। এই হামলায় রক্তাক্ত হন ভিপি নুর, তুহিন ফারাবীসহ অন্তত ৩০ জন। প্রত্যক্ষদর্শীরা গণমাধ্যমকে জানান, দুই দফায় নুরুল হক ও তার সহযোগীদের রড, লাঠি ও বাঁশ দিয়ে পেটানো হয়। প্রথম দফায় মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের একাংশের সভাপতি আমিনুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক আল মামুনের নেতৃত্বে সংগঠনের নেতাকর্মীরা ডাকসু ভবনে ঢুকে তাদের পেটান। এর পর ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সঞ্জিত চন্দ্র দাস ও সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হুসাইন ঘটনাস্থলে আসেন। তাদের উপস্থিতিতে দ্বিতীয় দফায় হামলা ও মারধর করা হয়।
হামলার পর ডাকসুর সব সিসিটিভি ফুটেজ গায়েব করে ফেলারও অভিযোগ উঠেছে। ডাকসু ভবনের ভেতরে-বাইরে মিলিয়ে মোট ৯টি ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা থাকলেও হামলার পর থেকে সিসিটিভি ফুটেজ সংরক্ষণ করার কম্পিউটারটি নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিয়াশীল বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মী এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা প্রশাসনের এই দায়িত্বহীনতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও প্রক্টরের পদত্যাগের দাবি তুলেছেন। এখন বুঝা গেল, কেন আবরার হত্যার পর বুয়েটের ছাত্ররা ফুটেজ অক্ষত অবস্থায় হাতে নিয়েছিলেন? আজকে যদি সিসিটিভি ফুটেজ না থাকত তাইলে আবরারকে ছাত্রশিবির বানাতে বা একেবারে গুম করতে বিন্দু মাত্র বেগ পেতে হত না। আমরা বিস্মিত, এক ঘণ্টা ধরে এ হামলার ঘটনা ঘটলেও ডাকসু ভবন থেকে মিনিটখানেক দূরত্বের কলাভবনের নিচতলায় প্রক্টর তার কার্যালয়ে থাকলেও ঘটনাস্থলে আসেননি। হামলা সম্পন্ন হওয়ার পর তিনি আসেন।
ভিপি নূরুকে এইভাবে বার বার পিটিয়ে আর লাঞ্ছিত করে ছাত্রলীগ আরো তাকে জনপ্রিয় করে তুলেছে। এখন সে অধিকাংশ সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের সহানুভূতি পাচ্ছে। চলনে-বলনে ফ্যাসনেবল না হয়েও নুর তার সাধারণ স্বাভাবিকতা নিয়ে তাদের কাছে চলে যেতে পেরেছেন, যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ তরুণ। একদল ছেলেমেয়ের মনের জোরে ভর করে নুর আজ বড় ছাত্রনেতা। গত কয়েক বছরে যে নির্দলীয় ছাত্র অধিকার আন্দোলন চলে আসছে, তার শেকড় অবশ্যই সমাজের গভীরে। নুর ব্যক্তি হিসেবে কে! কী! কেমন? তারচে বড় তিনি যাদের প্রতিনিধিত্ব করেন, তারা বিরাট, বিপুল ও সংগ্রামী মনোভাবসম্পন্ন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, শুধু ছাত্রলীগের জন্য বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের খুব কঠিন সময় অপেক্ষা করছে। সরকারের ভাল কাজগুলো আজ চোখে পরেনা কেবল ছাত্রলীগের অপকর্মের জন্য। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও সরকারের সব অর্জন ধুলায় মিশিয়ে দিতে ছাত্রলীগ একাই যথেষ্ট। আমরা উগ্রতা বা সন্ত্রাসের জায়গায় বারবার ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ সংগঠনকে দেখেছি। তারা কেন এটা করে? ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনটির বেপরোয়া হতে এর চেয়ে বড় উদাহরণ আর কী হতে পারে! ভুলে গেলে চলবে না, ঢাকার রাজপথে দর্জি যুবক খুন হওয়ার ঘটনার দায়ও ছাত্রলীগের। বর্তমান সরকারের মন্ত্রীদের কথাবার্তায় বোঝা যায়, তারা ছাত্রলীগের কর্মকা- সমর্থন করে না। ছাত্রলীগ কি তাহলে সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে? দেশে একটা বড় ধরনের বিপদ ঘটার আলামত দেখা যাচ্ছে। পেশীশক্তি ব্যবহার করে সব নিয়ন্ত্রণের এই সহিংস পথ যেকোন সময় চরম অরাজকতার কারণ হয়ে যেতে পারে। সংশ্লিষ্টদের হুশ হওয়া জরুরি। যারা রক্ত ঝরাচ্ছে তারা যদি পরিস্থিতি অনুধাবন না করে আগামীর বাংলাদেশ তাদেরকে ইতিহাসের কাঠ গড়ায় দাড় করাবে।