নুরল হক নূর। দীর্ঘ ২৮ বছর পর গত ১১ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ২৫তম সহ-সভাপতি (ভিপি) পদে বর্জন ভোটে জয় পান নূর। এর আগে আলোচিত কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। সব মিলে নুরল হক নূর সময়ের আলোচিত এক ছাত্রর নাম। বলিষ্ট কন্ঠ, দক্ষ নেতৃত্ব, দূরদর্শী ও মিষ্টভাষী উদীয়মান মেধাবী ছাত্রনেতা, ইত্যোকার নানাবিধ বিশেষণ পিছু ফেলে ভাগ্যবিড়ম্বনা নির্যাতন জয়ী নূর আজ প্রতিবাদ কন্ঠে পরিণত হয়েছেন। ডাকসুর ভিপি হওয়ার আগে-পরে গত এক বছরে অন্তত দশবার ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের দ্বারা হামলার শিকার হয়েছেন নূর। আওয়ামী স্তবকরা তার বিরুদ্ধে একেক সময় একেক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অভিযোগ চাউর করে।
ডাকসু নির্বাচন চলাকালীন রোকেয়া হলের প্রভেস্ট জিনাত হুদাকে লঞ্ছনা ও হল ভাঙচুরের অভিযোগে ভিপি নূর, অপর ভিপি প্রার্থী ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি লিটন নন্দীসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে গত ১১ মার্চ রাতে রাজধানীর শাহবাগ থানায় নৃত্যকলা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মারজুকা রায়না বাদি হয়ে মামলা করেছে। মামলা নং- ৯। (তথ্যসূত্র : বাংলানিউজটুয়েন্টিফোরডটকম- ১২.০৩.২০১৯)
‘ভিপি’ পদ ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, অনৈতিক তদবির বাণিজ্য ও অর্থ লেনদেনের অভিযোগ তুলে নূরের বিরুদ্ধে গত ১০ ডিসেম্বর ঢাকা মহানগর হাকিম জিয়াউর রহমানের আদালতে মামলা করেছে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ছাত্র সংসদের ভিপি মুজাহিদ কামাল উদ্দিন। আদালত শাহবাগ থানার ওসিকে তদন্ত করে আগামী ৮ জানুয়ারির মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন। (তথ্যসূত্র : যুগান্তর- ১১.১২.১৯)
নূরের উপর নিসংশ হামলার কথা বলতে গিয়ে চ্যানেল আইয়ের উপস্থাপিকা সম্প্রতি এক টক-শোতে নূরের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন- ‘ছাত্রলীগ আপনাকে মারতে মারতে শেষ পর্যন্ত ডাকসুর ভিপি বানিয়ে দিলো।’ ২০১৮ সালের ৩০ জুন থেকে গত ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন সময় তার উপর হামলাগুলো করা হয়। কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করায় অস্ত্র উঁচিয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাকে হুমকি দেয়। এ বিষয়ে নূরের পক্ষে থানা পুলিশ জিডি পর্যন্তও নেয়নি। প্রতিবার প্রকাশ্যে ন্যক্কারজনক হামলার ঘটনা ঘটলেও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুলিশের সহযোগিতা চেয়েও পাওয়া যায়নি। বলা যায়, পুলিশের নীরব ভূমিকা যেনো সন্ত্রাসীদের সহায়ক।
বলা যায়, শুধু অন্যায়-অনিয়মের প্রতিবাদ করার কারণেই নূর ও তার প্রতিষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’-এর নেতা-কর্মীরা বারবার ক্ষমতাসীন দলের রোষানলের স্বীকার হচ্ছে। ডাকসু নির্বাচনের পরও ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীদের দ্বারা নূরকে অন্তত ১০ বার হামলার শিকার হতে হয়েছে। ডাকসু নির্বাচন চলাকালে রোকেয়া হলকেন্দ্রে ভোটের অনিয়মের প্রতিবাদ করতে গিয়ে ছাত্রলীগের মারধরের শিকার হয়ে সংজ্ঞা হারান নূর।
গত ১৭ডিসেম্বর বিকেল চারটায় পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ি নূরের নেতৃত্বে শিক্ষার্থীরা ভারতে নাগরিকত্ব আইন ও এনআরসির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সংহতি সমাবেশ করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে এলে শিক্ষার্থীদের উপর হামলা চালায় মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ। এসময় নূরের দুই আঙুল ভেঙে দেয় মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নেতাকর্মীরা। হামলায় বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের অন্তত ১০ জন আহত হন। এ সময় হামলাকারীরা ‘ভিপি নূর দুর্নীতিগ্রস্ত, তাকে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সমাবেশ করতে দেয়া হবে না’ বলে স্লোগান দেয়।
গত ২২ ডিসেম্বর দুপুর পৌনে একটায় ডাকসু ভবনের নিজ কক্ষে হামলার শিকার হন নূর। হামলায় নূরের সঙ্গে থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও কয়েকটি কলেজের অন্তত ৩২ জন ছাত্র আহত হয়েছেন। নূরের আপন ছোট ভাই আমিনুলও আহত হয়েছেন। ঘটনার প্রায় ৪৫ মিনিট পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এ কে এম গোলাম রব্বানী নুরুলসহ আহত ছাত্রদের ডাকসু ভবন থেকে উদ্ধার করে সবাইকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। (তথ্যসূত্র : প্রথম আলো- ২২.১২.২০১৯)
নূরের উপর প্রথম আক্রমণ করা হয় কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে নূরের রুমে এসে অস্ত্র উঁচিয়ে হুমকি দেয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ ঘটনায় থানায় গেলেও জিডিটা পর্যন্ত নেয়নি পুলিশ। এরপর দ্বিতীয় দফায় তার উপর হামলা করা হয় ২০১৮ সালের ৩০ জুন। ওইদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির সামনে মিডিয়ার উপস্থিতিতে তার উপর হামলা হয়। সেখানে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা তাকে নির্মমভাবে মেরেছে।
অছাত্র-বহিরাগতদের হল থেকে পরিত্যাগ করতে বলার অভিযোগে গত ১ এপ্রিল সলিমুল্লাহ মুসলিম (এসএম) হলে তৃতীয় দফায় ছাত্রলীগের হামলার শিকার হয় নূর। উর্দু বিভাগের শিক্ষার্থী ফরিদ হাসানকে পেটানোর প্রতিবাদ জানাতে এসএম হলে যাওয়ার পর ২ এপ্রিল বিকেলে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা নূরকে অবরুদ্ধ করে। বিকেলে ওই ঘটনার সময় হলের বাইরে অবস্থানরত শামসুন্নাহার হলের ভিপি শেখ তাসনিম আফরোজ ইমিসহ নূর ও অন্যান্যদের ওপর ডিম ছুড়ে হেনস্তা করারও অভিযোগ উঠে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। গত ২৫ মে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ইফতার মাহফিলে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদান দিতে যাওয়ার সময় বগুড়াতে জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের উপস্থিতিতে নির্মমভাবে হামলার শিকার হন নূর। হামলায় নূরসহ পাঁচজন আহত হন। (তথ্যসূত্র : প্রথম আলো- ২৬.০৫.১৯)
গত ১৪ আগস্ট বেলা এগারোটায় নিজ শহর পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার উলানিয়া বাজারে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতাকর্মীদের দ্বারা হামলার শিকার হন নূর। তার সফরসঙ্গীদের ওপরও হামলা চালানো হয়। ঘটনাস্থলের পাশে থাকা পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। জানা যায়, দশমিনা উপজেলার এক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন নূর। উলানিয়াবাজার থেকে মোটরসাইকেলে করে যাওয়ার পথে উপজেলার উলানিয়া বন্দর এলাকায় কিছু দুষ্কৃতকারী নূরের মোটরসাইকেল আটকে তাকে একটি স্টিলের দোকানে নিয়ে বেধড়ক মারধর করে।
হামলার সময় নূরের সঙ্গে ছিলেন হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ফাহিম। তিনি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, হামলার একপর্যায়ে নূরকে ওই দোকানে প্রথমে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। খবর পেয়ে পটুয়াখালীর সার্কেল এসপি মু. হাফিজুর রহমান ও গলাচিপা থানার ওসি আকতার হোসেন তাকে উদ্ধার করে অ্যাম্বুলেন্সে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। সেখানে তার প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়। হামলার কারণ হিসেবে নূর গণমাধ্যমে জানিয়েছেন, নূর এলাকায় আসার খবর ছড়িয়ে পড়লে বন্ধুবান্ধব এবং শুভাকাঙ্খীরা তাকে দেখতে বাড়িতে আসেন। এতে ঈর্ষান্বিত হয়ে স্থানীয় এমপি এসএম শাহাজাদা সাজু এবং গলাচিপা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক উপজেলা চেয়ারম্যান শাহিন শাহর নেতৃত্বে ওই হামলার ঘটনা ঘটেছে। (তথ্যসূত্র : যুগান্তর- ১৫.০৮.১৯)
গত ১৪ আগস্ট নূরের হামলার জেরে গ্রামবাসী গত ১৯ অক্টোবর গলাচিপা উপজেলা চেয়ারম্যান শাহিন শাহর বিরুদ্ধে ঝাড়– ও জুতা মিছিল কর্মসূচি পালন করেছেন। ওইদিন চরবিশ্বাস এলাকায় মৎস্যজীবী লীগের বিশেষ বর্ধিত সভায় যোগদান দিতে মোটরসাইকেল শোডাউন নিয়ে নূরের এলাকায় বুধবাড়িয়া বাজারের কাছে পৌঁছলে চেয়ারম্যান শাহিন শাহকে লক্ষ্য করে করে জুতা, ডিম ও ঢিল নিক্ষেপ করেছে বিক্ষুব্ধ জনতা।
এ সময় চেয়ারম্যান শাহিন ও তার কর্মীরা পালিয়ে একটি দোকানে আশ্রয় নেয়। পরে থানা পুলিশের সহায়তায় রক্ষা পায় তারা। পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে লাঠিচার্জ করে পুলিশ। ঝাড়– মিছিলসহ জুতা ও ডিম নিক্ষেপের একটি ভিডিও চিত্রেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তা দ্রুত সময়ে ভাইরাল হয়। বড়ই লজ্জার বিষয় হচ্ছে যে, নূরের উপর হামলার একটা ঘটনারও বিচার হয়নি।
ছাত্রলীগ নিয়ে নূরের অভিমত, ছাত্রলীগ দেশব্যাপী সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাচ্ছে। ছাত্রলীগ একটা নৈরাজ্য কায়েম করতে সারাদেশে মানুষের উপর দমন নিপীড়ন চালাচ্ছে। এটি তাদের মূলদল নির্দেশনা দিয়েছে বলেই এ ধরনের বেপোরোয়া কার্যক্রম চালাচ্ছে। যদি সেটা না হতো তাহলে অন্তত্য বাংলাদেশের দ্বিতীয় পার্লামেন্টখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিপিকে বারবার আক্রমণ করার ফলে লোক দেখানো তো একটা ব্যবস্থা নেওয়া যেতো, কিন্তু সেটাও করা হয়নি। এরমধ্যে স্পষ্ট যে, তারা ভিন্নমতো দমন করতে ছাত্রলীগকে লাইসেন্স দিয়েছে।
নূর আরো বলেন, ‘যতোটা না ছাত্রসংগঠন তার চেয়ে বেশি সন্ত্রাসী কার্যক্রম, টেন্ডার-চাঁদাবাজি। একটা ছাত্রসংগঠনের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক পর্যন্ত এই চাঁদাবাজির কারণে তাকে পদ থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়েছে। সুতরাং এই সংগঠনটা আজকে মানুষের কাছে কতটা প্রশ্নবিদ্ধ, বা মানুষের কাছে কতোটা ইমেজ শঙ্কটে রয়েছে সেটি আর বলার অপেক্ষা রাখে না।’
অনেক দিন থেকেই সুযোগ খোঁজ ছিলাম নূরের বাবার সাথে কথা বলতে। গত ২০ ডিসেম্বর দুপুরে নূরের বাবা ইদ্রিস হাওলাদার সাহেবের মোবাইল ফোনে কল দিই। কুশলাদি বিনিময়ের এক পর্যায়ে জনাব ইদ্রিস হাওলাদার জানান, তার বয়স সত্তোরের উপর। এ বৃদ্ধ বয়সে ছেলে নূরের ওপর নির্যাতন তাকে সব সময় ভাবিয়ে তুলে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, ক্ষমতাসীন দলের নেতা ছাড়াও সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার লোকদের কাছ থেকেও প্রতিনিয়ত হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে নূর। এমতাবস্থায় আমরা প্রাণনাশের শঙ্কাবোধ করছি। জনাব ইদ্রিস হাওলাদারের শেষ কথা ছিল, দেশবাসীর কাছে অনুরোধ, আপনারা অন্যায়ের-অনিয়মের বিরুদ্ধে নূর তথা প্রতিবাদী মানুষদের পাশে দাঁড়িয়ে সন্ত্রাসীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার হোন।
আমরা বরতে চাই, অধিকার প্রশ্নে নির্যাতন জয়ী নূরদের প্রতিবাদ দেখাদেখি সারা দেশবাসী জেগে উঠবে এবং মানুষের ঢল যখন রাজপথে নামবে, তখন কেউ অন্যায়-অনিয়ম করার সাহস পাবে না। ক্ষমতার মসনদ জবরদখল করতে নির্বাচনের নামে ‘নির্বাচনী নাটক’ মঞ্চায়ন করার কেউ সুযোগ খোঁজবে না। অপক্ষমতায় অর্থবিত্তের কালো পাহাড় গড়ার দূস্বপ্ন দেখবে না। বিচারের নামে ভিন্নমতের লোকজনকে কারাপ্রকষ্টে আটকিয়ে রাখার হিম্মত দেখাবে না। অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গণতন্ত্র নির্বাসনে পাঠিয়ে কিংবা ধ্বংসের পর বেসামাল উন্নয়ন ফেরি করে জনগণের চোখে ধোঁকা দেওয়া সহজ হবে না। সুতরাং এখনই সময় যুদ্ধে যাবার। এখনই সময় স্বৈরাচার রুখবার। এখনই সময় নূরদের প্রতিবাদ মিছিলে শরীক হবার। মহান সৃষ্টিকর্তা মজলুমের ফরিয়াদ নিশ্চয় কবুল করবেন। আমীন। ছুম্মা আমীন।
[এম. কে. দোলন বিশ্বাস, দৈনিক সংবাদের সাবেক সহ-সম্পাদক]