একটি বছর শেষ হওয়ার সরল অর্থ আমার জীবন থেকে একটি বছর ফুরিয়ে গেল, লাইফটাইম সংকীর্ণ হয়ে এলো। এতো আনন্দের নয়, চিন্তার ব্যাপার। এখন আনন্দ-উল্লাসের সময় নয়, বরং সময় হলো, যে বছরটির শুভ সূচনা হবে তা কীভাবে সুন্দরভাবে কাটানো যাবে সে হিসাব-নিকাশের। অথচ থার্টিফার্স্টে আমাদের তরুণ-তরুণীরা এমন উদ্দাম, উন্মত্ততা ও উচ্ছলতা, উৎসব, আনন্দে নিজেকে সঁপে দেয়, তখন শ্লীল আর অশ্লীলের বাছবিচার থাকে না। প্রায় প্রতি বছর থার্টিফার্স্ট নাইট উদযাপনকে কেন্দ্র করে নানা আনাচার ঘটে। ১৯৯৯ সালে টিএসসিতে বাঁধন শালীনতাহানির শিকার হয়েছিলেন। ২০১২ সালের আবারও ঘটে অনুরূপ ঘটনা। ২০১৩ সালের চট্টগ্রামের একটি হোটেলে থার্টিফার্স্ট নাইট উদযাপন উপলক্ষে আয়োজন করা হয় অশ্লীল নৃত্যের। সে অনুষ্ঠানের অভ্যন্তরে নেশাজাতীয় দ্রব্য এবং কনডম বিক্রি করা হয়। দেশের সভ্য মানুষ পত্রিকায় সে খবরটি পড়ে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল।
অপসংস্কৃতি আর থার্টিফার্স্ট নাইটের মতো অনুষ্ঠানের কারণেই আমাদের দেশে প্রতিনিয়ত জন্ম হচ্ছে ধর্ষণের সেঞ্চুরিয়ান মানিকের মতো অসভ্য ও মা-বাবার হত্যাকারী ঐশীরা। নিজের ঘরকে অরক্ষিত রেখে অনেক মায়েরা বিভিন্ন কর্মকা-ে সম্পৃক্ত হওয়ার কারণে মাতৃস্নেহ বঞ্চিত সন্তান বড় হচ্ছে নৈতিক, পারিবারিক ও ধর্মীয় শিক্ষাহীনভাবে। এ অবস্থায় ভয়াবহ ঝুঁকির মুখে পড়ে আমাদের সন্তানেরা একপর্যায়ে বখাটে, নেশাখোর, সর্বশেষ সন্ত্রাসী হিসেবে নিজেকে আবিষ্কার করছে। অনেক মা-বাবাই সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্টে নিজ কর্ম ও প্রভাববলয়ে ব্যস্ত থাকেন। সন্তানদের সঙ্গ দিতে না পারায় সন্তানরাও বাবা-মার শাসন থেকে মুক্ত হয়ে একদিন মাদকের খপ্পরে পড়বে সেটি আর বিচিত্র কী!
নতুন বছরে সৃষ্টিকর্তার কাছে কামনা হতে পারে, আগামীর দিনগুলো যেন সুন্দর হয়, প্রত্যাশা হতে পারে পুরাতন বছরের সব গ্লানি-অপ্রাপ্তি ঝেড়ে ফেলে নবউদ্যমে সন্মুখপানে এগিয়ে যাওয়ার। কিন্তু বাস্তবে আমরা থার্টিফার্স্ট নাইটের অনুষ্ঠানের নামে রাজধানী ঢাকায় প্রতি বছর যে চিত্র দেখতে পাই তা সত্যিই লজ্জা ও বেদনাদায়ক। বিশেষ করে ধানম-ি, গুলশান, বনানী, ডিওএইচ এবং ঢাবি’র টিএসসিতে যে হইহুল্লোড় মার্কা অনুষ্ঠান, ‘মাদকের হাতে খড়ি’, আতশবাজি, বাদ্য-বাজনা, নাচ-গান, যুবক-যুবতীর ফ্রি স্টাইলে উল্লাস, ওপেন এয়ার কনসার্ট, লাইভ ড্যান্স, বেলেল্লাপনা আর লাল, নীল, পানীয় পানের যে সমারোহ চলে তাতে করে নতুন বছরের কামনা-বাসনা আর প্রত্যাশার মূলেই কুঠারাঘাত করা হয়। নববর্ষ পালন করতেই হবে, বা না করা নিয়ে কোনো বক্তব্য নেই। কিন্তু সব থেকে বেশি মাথাব্যথা মানুষের বিবেক বোধ নিয়ে। দিনদিন আমরা কোনপথে চলছি তা নিয়ে। আমাদের শিক্ষার হার বাড়ছে কিন্তু শিক্ষিতের হার বা সু-নৈতিকতার হার বাড়ছে না।
কোন জাতিকে অকার্যকর করার জন্য যুবসমাজকে ধ্বংস করে দেয়াই যথেষ্ট। বর্তমানে যুবসমাজের ধ্বংসের পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করছে অপসংস্কৃতি। যারা আগামী বাংলাদেশের কর্ণধার হবে তারা যদি এমন পথে পা বাড়ায় তবে দেশের ভবিষ্যৎ চির অন্ধকারে ছেয়ে যাবে। তরুণ-তরুণীদের ধ্বংস করার জন্য যা চাই, তার সবটার রসদ এ সকল অনুষ্ঠানে মজুদ থাকে। খোলামেলা আচরণ আর নিষিদ্ধ পানীয় পানের মহোৎসবের ফলে যে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তা সামাল দিতে আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও হিমশিম খেতে হয়। এ জন্য ইংরেজী নববর্ষের আগেই নানা ধরনের দিক-নির্দেশনা জানানো হয় ডিএমপির পক্ষ থেকে।
দেশে মাদকাসক্তি আজ এক নীরব মারণাস্ত্রের ভূমিকায় রয়েছে। মাদকাসক্ত হওয়ার পর উপায় খুঁজে বের করার হয়রানির চেয়ে, মাদকাসক্ত যেন না হয় সেদিকেই সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া দরকার। মাদকাসক্তির মতো ভয়াবহ মরণনেশা ধরে রাখতে মাদকাসক্তরা বেছে নেয় ছিনতাইসহ ভায়োলেন্সের সেই অন্ধকার পথ, যে পথে অস্ত্র ঠেকিয়ে, সন্ত্রাসী করে টাকার পথ খোঁজা হয়। স্বভাবতই মাদকাসক্তি সংসার ও সমাজে অশান্তিসহ যুবশক্তিকে নিঃশেষ করে দেয়।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের সকল উৎসব আমাদের সভ্যতা, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সাথে মানানসই নয়। কোনো বিবেকবান জাতির জন্য শোভনীয় নয়, তারা অন্য দেশের সংস্কৃতিকে অন্ধভাবে অনুসরণ করবে। সংস্কৃতির অর্থ- সংস্কার, উন্নয়ন, উৎকর্ষসাধন, উত্তম বা উন্নতমানের চরিত্র, কর্ষণ, সংশোধন, পরিমার্জন, শুদ্ধিকরণ, সৌন্দর্য প্রকাশ ইত্যাদি। তবে নোংরামি, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, হইহুল্লোড়, শ্লীলতাহানি ইত্যাদি অপকর্মগুলো কীভাবে সংস্কৃতি হয়? বর্তমানে বর্ষবরণের নামে যে অশ্লীলতা, বেহায়াপনা এবং নগ্নতার প্রদর্শন চলে, তা কোন সভ্য মানুষের কাজ হতে পারে না। এদিনে তরুণ-তরুণীরা নৈতিকতার সব বাঁধ ভেঙ্গে অশ্লীলতায় লিপ্ত হয়, আর এই কর্মকা-ের অবধারিত রূপ হচ্ছে মদ্যপান, পানোন্মত্ততা ও কামচারিতা। উৎসব পালনের নামে উচ্চস্বরে গান-বাজনা করা বা শোনা, গভীর রাতে বিকট শব্দে ইচ্ছেমত বাজি ফুটানো। বেলেল্লাপনা, হইহুল্লোড় করে আশপাশের মানুষের সমস্যাকে গুরুত্ব না দিয়ে যখন এগুলো করা হয়, তখন তাকে উৎসব উদযাপন না বলে বর্ষবরণের বর্বর, অমানুষের অহেতুক, অনর্থক কর্মকা- বলাই স্রেয়।
খ্রিষ্টপূর্ব ৪৬ সালে জুলিয়াস সিজার সর্বপ্রথম ইংরেজি নববর্ষ উৎসবের প্রচলন করে। পহেলা জানুয়ারি পাকাপোক্তভাবে নববর্ষের দিন হিসেবে নির্দিষ্ট হয় ১৫৮২ সালে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের প্রবর্তনের পর। ধীরে ধীরে ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে পোপ গ্রেগরিয়ান নামানুসারে ক্যালেন্ডার ও নববর্ষ পালন করা হচ্ছে। নতুন বছর নতুন কল্যাণ বয়ে আনে, দূরীভূত হয় পুরোনো কষ্ট ও ব্যর্থতার গ্লানিÑএধরনের কোনো তত্ত্ব কোনো ধর্মে আদৌ সমর্থিত নয়, বরং নতুন বছরের সাথে কল্যাণের শুভাগমনের ব্যাপার ছিল আদিযুগের প্রকৃতি ও সূর্যপূজারীদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধ্যান-ধারণা। হাজার বছরের পুরোনো সূর্য পূজাকে নিজস্ব সংস্কৃতিতে ঢুকিয়ে আধুনিক হওয়ার অপচেষ্টা মাত্র।
থার্টিফার্স্টের উৎসবের নামে নষ্টামি, নোংরা, বর্বর কালচারটি আমদানি এবং প্রচার করেছে এদেশেরই কিছু বুদ্ধির ফেরিওয়ালা ও আত্মবিস্মৃত মিডিয়া। যারা বেসামাল আচরণ আর বেহায়াপনায় আরও সুঁড়সুঁড়ি দিয়ে বলেÑ এসব তারুণ্যের উন্মাদনা। তারা একটি শালীন ও সভ্য সমাজের ভিত্তি স্থাপনের পরিবর্তে নষ্টামি ও অশ্লীলতার নর্দমা সৃষ্টিতেই বেশি পারঙ্গম। আশ্চর্য ব্যাপার হলোÑএরাই আবার দেশবাসীকে নছিহত করেÑ মাদক, সন্ত্রাস, ইভটিজিং ও নারী নির্যাতনকে না বলুন।
বিভিন্ন দেশের উৎসবের উপলক্ষগুলোয় দেখা যায়, উৎসব পালনকারী জাতির ধমনীতে প্রবাহিত ধর্মীয় অনুভূতি, সংস্কার ও ধ্যান-ধারণার ছোয়া। যেমন- গায়ে পানি ছিটানো থাইল্যান্ডের উৎসব। আঙুর খাওয়া স্পেনের উৎসব। ১২টি ঘণ্টা বাজানো ও ১টি করে আঙ্গুর খাওয়া, যে উদ্দেশ্যে আঙ্গুর খাওয়া হবে সে উদ্দেশ্য পূরণ হবে যা মেক্সিকোর উৎসব। শিক্ষকদের কাছে দীর্ঘায়ু কামনা করা ভিয়েতনামের উৎসব। পরিবারের সকল সদস্যরা একসাথে আহার করা আর্জেন্টিনার উৎসব। সাদা পোশাক পরিধান করা ব্রাজিলীয়দের উৎসব। খ্রিস্টানদের সৌভাগ্যের দিন মনে করে ভালো খাওয়া ও কাপড় ব্যবহার। জাপানে বাড়ির সম্মুখভাগে খড়ের দড়ি ঝুলিয়ে রাখে যেন কোনো অশুভ প্রেতাত্মা বাড়িতে প্রবেশ করতে না পারে। কানাডা এবং বৃটিশ কলম্বিয়াতে একশ্রেণীর মানুষ ঠা-া বরফ পানিতে সাঁতারের পোশাকে নেমে তাদের ঐতিহ্যকে অনুসরণ করে থাকে। ডেনমার্কে প্রতিবেশীর দরজায় কাঁচের জিনিসপত্র ছুড়তে থাকে, যার দরজায় যতবেশী কাঁচ জমা হবে, নতুন বছর তার তত ভাল যাবে। কোরিয়ানরা যৌবন হারানোর ভয়ে রাতে ঘুম থেকে বিরত থাকে ইত্যাদি প্রচলিত আছে। এসব আয়োজনের মধ্যে কোন অশ্লীলতা নেই।
নতুন বছরের শুভেচ্ছা বিনিময় সুস্থ সংস্কৃতির অংশ। বছরের প্রথম দিনে ফুর্তি করায় দোষের কিছু নেই। দোষ তখনই ঘটে যখন দেখা যায়, বিভিন্ন স্থানে চলে কনসার্টের নামে তারুণ্যের বাঁধ ভাঙা উম্মাদনা, নগ্নতা, বেহায়াপনা। কিন্তু এ রাতের ইতিবাচক দিকের তুলনায় নেতিবাচক দিকই শিক্ষার্থী, তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতীর জীবনে বেশি প্রভাব বিস্তার করে। নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও আদর্শবাদী মানুষরা যখন গভীর ঘুমে মগ্ন, এমন সময় পটকা ফাটিয়ে, ঢোল পিটিয়ে আতশবাজি করে প্রচ- আওয়াজে ঘুম ভেঙে দিয়ে রাজ পথে ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ সেøাগান কী ধরনের চেতনা তা বোধগম্য নয়। একদিনের বাঙালি, ও চেতনাধারী ব্যবসায়ী হিসেবে পহেলা বৈশাখে যাদেরকে আমরা রাজপথে দেখি তারাই আবার থার্টিফার্স্টের মতো ভিনদেশি সংস্কৃতি পালনে অতি উৎসাহী।
সেক্যুলার বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত, বরেণ্য চিন্তাবিদ ও লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদও বাধ্য হয়ে ইতোপূর্বে লিখেছেন, ‘আমি আমার নিজের শৈশব ও কৈশোরের পহেলা বৈশাখকে যেভাবে দেখছি, আজকের পহেলা বৈশাখ উদযাপনের সঙ্গে সেই নববর্ষ উৎসবের কোন মিলই নেই। তখনকার নববর্ষের উৎসবের মধ্যে ছিল অকৃত্রিম প্রাণের আমেজ, তাতে ন্যূনতম কৃত্রিমতা ছিল না, আয়োজনে বিন্দুমাত্র মেকি বা লোক দেখানো বিষয় ছিল না। যা করা হতো, তা হতো স্বতঃস্ফূর্তভাবে, প্রাণের আনন্দে ও অকৃত্রিম জাতীয়তাবাদী আবেগে। কারণ এ সমাজের পঞ্চাশ শতাংশ মানুষ খুবই দরিদ্র। তারা ক্ষুধার জ্বালায় পান্তাভাত, পচাডাল ও অখাদ্য জাতীয় জিনিস যা পায় প্রতিদিন তাই খায়। রাস্তায় দাঁড়িয়ে পান্তাভাত আর ইলিশের তরকারী, মুড়িঘণ্টা যারা খায়, তারা বস্তুত এক ধরনের সংস্কৃতিক অপরাধ করে। এসব আচরণের মাধ্যমে তারা আসলে দেশের অগণিত দরিদ্র মানুষকে পরিহাস করে’।
আমরা দেখছি, যেখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা অট্টালিকার নিকটে খাদ্য-বস্রহীন, দুঃখী মানুষেরা ছিন্ন কাঁথা বিছিয়ে অনাহারে রাত পাড় করছে। সেখানে গরম ভাতে পানি দিয়ে হাজার-হাজার টাকা অপব্যায় করে বছরে একটি দিন মাটির শানকিতে হাপুস-হুপুস ফ্যাশনের ‘পান্তা-ইলিশ’ ভোজন কতবড় অমানবিক, অনৈতিক উৎসব যা নিঃসন্দেহে গরিবদের সাথে উপহাস করার নামান্তর।
যে সব তরুণ প্রচ- শীত উপেক্ষা করে বিভিন্ন স্থানে এ উৎসবে করবে, তারা কি পারে না শীতার্থ, বস্ত্রহীন মানুষের পাশে দাঁড়াতে কিংবা অনাহারির মুখে একমুঠো খাবার তুলে দিতে। কিন্তু তরুণদের তো সে কাজগুলো করতে দেখা যায় না। তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতীদের শ্রেষ্ঠ হতে হবে কর্ম গুণে। তাদেরকে দেখে ছোটরা শিক্ষা নেবে। অভিভাবকদেরও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়ে ছেলেমেয়েকে সুশিক্ষায় গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। কেননা, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপশি পারিবারিকভাবে নৈতিকতার অভাব বলেই আজ সর্বত্র অশান্তি বিরাজ করছে। আমরা যেন অপসংস্কৃতির খপ্পরে পড়ে আমাদের নিজস্ব সাংস্কৃতি আদলকে বিকৃত না করি, আমাদের বিশ্বাস, মূল্যবোধ, পরিচ্ছন্ন রুচিবোধ ইত্যাদিকে বিনষ্ট না করি।