আমার লেখালেখির বয়স ২৪ বছর। ১৯৯৫ থেকে ক্রমশ সত্য ও সুন্দরের জন্য নিবেদিত থেকে লিখে যাচ্ছি। ছাত্র জীবন থেকে লেখালেখির কারণে পাঠ ও পঠনের রাস্তাটিও আমি মননশীলতায় অনবরত তৈরি করেছি। ধর্ম- দেশ-সমাজ-বিশ্ব-শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি-অর্থনীতি সহ বিভিন্ন বিষয়ে আমার জানার চেষ্টাটি ছিলো দৃঢ়। সেই ধারাবাহিকতায় আমার জানার সুযোগ হয়েছে সাদ্দাম হোসেন, গাদ্দাফি, বুশ থেকে শুরু করে বর্তমানের শাসক- স্বৈরশাসক- শোসকদের রঙচটা কথা। বিশেষ করে যদি বলি- সুদানে যেভাবে ওমর আল-বশিরের শাসনামল শুরু হয়েছিল, সেভাবেই সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাকে ক্ষমতা ছাড়ার কথা। তাহলে দেখা যাবে- আল-বশিরকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে এবং একটি অন্তবর্তীকালীন সামরিক কাউন্সিল দুই বছরের জন্য দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছে। একটি নির্বাচন আয়োজন করা হবে তাদের দায়িত্ব। তিনমাসের জন্য দেশটিতে জরুরি অবস্থা এবং একমাসের জন্য কারফিউ জারি করা হয়েছে। ওমর আল-বশিরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং একটি নিরাপদ স্থানে রাখা হয়েছে। আল-বশিরের রাজনৈতিক জীবনকে যুদ্ধ দিয়েই সবচেয়ে ভালোভাবে বর্ণনা করা যায়। ইতিহাস বলে- ১৯৮৯ সালে তিনি ক্ষমতায় আসেন এবং শক্ত হাতে দেশ পরিচালনা করেছেন। ২০১১ সালে বিভক্ত হয়ে দক্ষিণ সুদানের জন্ম না হওয়া পর্যন্ত এই দেশটি ছিল আফ্রিকার সবচেয়ে বড় দেশ। যখন তিনি ক্ষমতা দখল করেন, সুদান তখন উত্তর আর দক্ষিণের মধ্যে ২১ বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধের মধ্যে রয়েছে। মি. বশির শক্ত হাতে জবাব দিতে শুরু করেন। তার বিরুদ্ধে দমন পীড়ন এবং যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ আনে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত। তার বিরুদ্ধে ২০০৯ ও ২০১০ সালে দুইটি আন্তর্জাতিক গ্রেপ্তারের পরোয়ানা জারি করা হয়। যদিও তিনি অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। আন্তর্জাতিক চাপ সত্ত্বেও তিনি ২০১০ ও ২০১৫ সালের দুইটি নির্বাচনে বিজয়ী হন। তার সর্বশেষ নির্বাচন বিরোধীরা বর্জন করে। এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানার কারণে তার ওপর আন্তর্জাতিক ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা তৈরি হয়। তারপরেও মি. বশির মিশর, সৌদি আরব আর দক্ষিণ আফ্রিকায় ভ্রমণ করেন। ২০১৫ সালের জুনে তিনি অনেকটা বিব্রতকর ভাবে দক্ষিণ আফ্রিকা ত্যাগ করতে বাধ্য হন, কারণ দেশটির একটি আদালত বিবেচনা করছিল যে, তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাটি কার্যকর করা হবে কিনা।
অবশ্য সত্য হলো এই যে, ক্ষমতা গ্রহণের আগে সেনাবাহিনীর একজন কমান্ডার ছিলেন মি. বশির। তিনি বিদ্রোহী নেতা জন গ্যারাঙ্গের বিরুদ্ধে বেশিরভাগ অভিযান পরিচালনা করেন। যখন তিনি সুদানিজ পিপলস লিবারেশন মুভমেন্টের পক্ষে গ্যারাঙ্গের সঙ্গে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেন, তখন তিনি বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছিলেন যাতে চুক্তিটি পরাজয় বলে মনে না হয়। তিনি বলেছিলেন,'' আমরা অসহায় হয়ে ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর করিনি, বরং আমরা যখন বিজয়ের শীর্ষে ছিলাম, তখনি তাতে স্বাক্ষর করেছি।'' তার সবসময়েই লক্ষ্য ছিল একটি একীভূত সুদান রক্ষা করা, কিন্তু শান্তি চুক্তির অংশ হিসাবে দক্ষিণ সুদানের বিষয়ে একটি গণভোট আয়োজন করতে বাধ্য হন। ২০১১ সালের জানুয়ারির গণভোটে ৯৯ শতাংশ দক্ষিণ সুদানিজ ভোটার আলাদা হয়ে যাওয়ার পক্ষে ভোট দেন। ছয় মাস পরে স্বাধীন দক্ষিণ সুদান ঘোষিত হয়। যখন তিনি দক্ষিণ সুদানের স্বাধীনতার পক্ষে সম্মত হন, তখনো দারফুরের প্রতি তার মনোভাব ছিল আগ্রাসী। সেই ব্যক্তিটি এখন নির্মমতা কাকে বলে, তা হারে হারে টের পাচ্ছেন।
তবে এ কথা সত্য- বিক্ষুব্ধ পৃথিবী আজ- বললে বোধ হয় বেশি বলা হয় না। মহাদেশগুলোর কোনো না কোনো দেশে, এমনকি একাধিক দেশেও গণবিক্ষোভ চলছে। হাজার-হাজার এমনকি লাখ-লাখ মানুষ ওই সব দেশের রাস্তায়। বিক্ষোভের কারণে এরই মধ্যে কয়েকটি দেশে সরকারের পতনও ঘটে গেছে। ওই সব দেশের জনগণের অভিযোগগুলো বিচার করলে সাধারণভাবে যা বোঝা যায় তা এরকম- ১. সরকার এবং রাষ্ট্রযন্ত্র ভয়াবহভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত; ২. বৈষম্য এবং বেকারত্ব জনগণের সহ্যসীমা ছাড়িয়ে গেছে; ৩. শাসকশ্রেণী, রাষ্ট্রযন্ত্র এবং সরকার সীমাহীন লুটপাটে ডুবে আছে; ৪. জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো কেড়ে নেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে পৃথিবীর যে সমস্ত দেশে নির্বাচন হয়েছে তার অধিকাংশ দেশেই বাম-গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল দলগুলো বিজয়ী হয়েছে। এশিয়ায় আন্দোলনের মুখে লেবাননে হারিরি সরকারের পতন ঘটেছে। ইরাক এবং পাকিস্তান সরকার পতনের মুখে রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। ইসরায়েলে চরম দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল এবং উগ্র সাম্প্রদায়িক নেতানিয়াহু সরকার গঠন করতে ব্যর্থ হয়েছেন, বিরোধী আরব জোট সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েও সরকার গঠন করতে পারেনি। হংকংয়ে নাগরিক অধিকার কেড়ে নেয়ার বিরুদ্ধে প্রচ- বিক্ষোভ চলছে। বিক্ষোভের মুখে সরকার পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। সিঙ্গাপুরের জনতা পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে রাস্তায় নেমেছে। সম্প্রতি ভারতের মহারাষ্ট্র এবং হরিয়ানায় প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ দুটি রাজ্যেই বিজিপি শিবসেনা জোট ক্ষমতায় রয়েছে। এবারের নির্বাচনে এই জোট আসন হারিয়ে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। কারণ এই দুই প্রদেশে সম্প্রতি নিজেদের দাবিতে কৃষকরা বিরাট আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। এক লাখ কৃষক হেঁটে দিল্লিতে এসেছিল তাদের দাবি জানাতে এবং কৃষকের দাবি মেনে নেয়ার ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়েছিল সরকার। মহারাষ্ট্রে এই আন্দোলনের নেতা সিপিএম প্রার্থী বিজিপি জোট প্রার্থীকে ষাট হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেছেন। মহারাষ্ট্র এবং হরিয়ানায় কৃষক আন্দোলনের বেশ কয়েকজন নেতা এ নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন। তবু বারবার সঙ্কট নির্মিত হচ্ছে। কথা উঠছে স্বচ্ছতা নিয়ে। সারা বিশ্বে একই অবস্থা।
হয়তো শাসক- স্বৈরশাসক-এর পার্থক্য থেকেই চলতি ২০১৯ সালকে বলা হচ্ছে ‘দ্য ইয়ার অব দ্য স্ট্রিট প্রটেস্টার’ বা ‘বিক্ষোভকারীদের বছর’। সারা বছরই প্রতিবাদ-বিক্ষোভে উত্তাল ছিল বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। কিন্তু বিক্ষোভকারীদের দাবি-দাওয়া এক নয়। কোথাও দাবি ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানের পদত্যাগ বা অপসারণ। কোথাও আবার টানা রাজপথে দেশের গণতন্ত্রের সুরক্ষায় কিংবা সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে। নাগরিক অধিকারের দাবিতেও বিক্ষোভ ছিল চোখের পড়ার মতো। নির্দিষ্ট কোনো দাবিতে ক্ষুব্ধ বিক্ষোভকারীরা রাস্তায় নামলে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে বড় পরিসরে। শেষ পর্যন্ত এসব বিক্ষোভের বেশিরভাগই সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়। সব দেশে বিক্ষোভ সফল না হলেও টানা বিক্ষোভ-প্রতিবাদের মুখে গুটিকয়েক দেশে পতন হয়েছে সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানের। গণবিক্ষোভের মুখে যেসব দেশে সরকার পতন হয়েছে, তার তালিকা ধরে এগিয়ে যেতে যেতে জেনেছি- কয়েক বছর ধরে অর্থনৈতিকভাবে সংকটে ভুগছে সুদান। বিশেষ করে দক্ষিণ সুদান আলাদা হয়ে যাওয়ার পর। কারণ দেশের মোট উত্তোলিত তেলের চার ভাগের তিন ভাগই রয়েছে দক্ষিণ সুদানে। সম্প্রতি দেশটিতে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বেকারত্ব, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিসহ বিভিন্ন কারণেই লৌহমানবখ্যাত ওমর আল বসিরের সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ জোরালো হয়ে ওঠে। গত বছরের ডিসেম্বরে সরকার তেল ও রুটির দাম বাড়ানোর পর তার ৩০ বছরব্যাপী শাসনামলের মধ্যে সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ শুরু হয়। আন্দোলনে তুঙ্গে পৌঁছালে ১১ এপ্রিল সামরিক বাহিনী বশিরকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে নেয়। শেষে চলতি বছরের আগস্টে ট্রানজিশনাল মিলিটারি কাউন্সিল (টিএমসি) এবং গণতন্ত্রপন্থী অ্যালায়েন্স ফর ফ্রিডম অ্যান্ড চেঞ্জের মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগির একটি চুক্তি হয়েছে। চলতি বছরের শুরুতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও শাসন ব্যবস্থা পরিবর্তনের দাবিতে প্রবল গণআন্দোলন শুরু হয়। কয়েক সপ্তাহের বিক্ষোভের মুখে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন প্রেসিডেন্ট আবদেলাজিজ বুতেফ্লিকা। পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়েও ২০ বছর ধরে ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছিলেন ৮২ বছর বয়সী বুতেফ্লিকা। দেশটির সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল গায়েদ সালাহ অবিলম্বে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব থেকে বুতেফ্লিকাকে সরে যাওয়ার আহ্বানের কয়েক ঘণ্টা পরই পদত্যাগ করেন তিনি। ১৭ অক্টোবর বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নতুন কর আরোপের ঘোষণা দেয় লেবানন সরকার। এতে বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে লেবাননের জনতা। পরে কর প্রত্যাহার করা হলেও রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ চলতে থাকে দেশটিতে। ২৯ অক্টোবর তীব্র বিক্ষোভ-আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরি। তারপরও বিক্ষোভ রয়েছে লেবাননে। চলতি বছরের ২০ অক্টোবর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগে বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে উত্তর আমেরিকার দেশ বলিভিয়া। এ বিক্ষোভের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন দেশটির প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেস। বিক্ষোভে সহিংসতায় অন্তত ১৮ জন নিহত হয়েছেন। এছাড়া, আটক করা হয়েছে ছয় শতাধিক বিক্ষোভকারীকে। দুর্নীতি দমনে ব্যর্থতার অভিযোগ ও প্রশাসনে সংস্কারের দাবিতে চলতি বছরের নভেম্বরে সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে নামে কুয়েতি জনগণ। এক সপ্তাহের টানা বিক্ষোভের মুখে পতন হয় দেশটির প্রধানমন্ত্রী জাবির আল মুবারাক আল হামাদের সরকার। সর্বশেষ ১ অক্টোবর থেকে উন্নত জীবন ব্যবস্থা ও কর্মসংস্থান এবং দুর্নীতির অবসানের দাবিতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে ইরাকে। চলমান এ বিক্ষোভে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে এ পর্যন্ত চার শতাধিক বিক্ষোভকারী নিহত ও ১৫ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। ৩০ নভেম্বর প্রবল বিক্ষোভের মুখে ইরাকের প্রধানমন্ত্রী আদেল আবদুল মাহদি পদত্যাগ করে প্রমাণ দিয়েছে শাসক- স্বৈরশাসকের পার্থক্য অনেক বড়।
তবে বরাবরের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যে, বিশ্বময় পরির্বতন ঘটতে যাচ্ছে। বাগদাদ থেকে হংকং, সান্টিয়াগো থেকে বার্সেলোনা সম্প্রতি বিশ্বের বিভিন্ন শহরের রাজপথ প্রতিবাদ-বিক্ষোভে প্রকম্পিত হয়ে উঠেছে। অতিতের রেকর্ড বলছে- ২০১০ সালের পর থেকে আরব বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে সহিংস প্রতিবাদ বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল। বেকারত্ব, স্বৈরাচার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে পরিচালিত ওই আন্দোলনের নাম দেয়া হয়েছিল আরব বসন্ত। আরব বসন্তের তিউনিসিয়ার স্বৈরশাসক জয়নুল আবদিন বেন আলীর পতন ঘটে, মিসরের স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের পতনের পর দেশটিতে প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ব্রাদারহুডের ড. মুহাম্মদ মুরসি। অবশ্য পরবর্তীকালে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মিসরের নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং পার্লামেন্ট ভেঙে সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখল করে। এখনো স্বৈরশাসক জেনারেল আল সিসি ব্যাপক দমনাভিযান চালানোর মাধ্যমে দেশটিতে একনায়কতন্ত্র অব্যাহত রেখেছেন। তবে সেখানে তার বিরুদ্ধেও নতুনভাবে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। দেশের গোটা রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং অর্থনৈতিক সংস্কারের দাবিতে লেবানন এবং ইরাকে ব্যাপক বিক্ষোভ চলছে। আন্দোলনের মুখে লেবাননে ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরি পদত্যাগ করেছেন। বেকারত্ব, ধীরগতির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং বিশ্বব্যাপী অর্থনেতিক অনিশ্চয়তা, দুর্নীতি ও স্বৈরতন্ত্রই এসব বিক্ষোভের মূল কারণ। আবার কোনো কোনো দেশের বিক্ষোভের কারণ একই সূত্রে গাঁথা নয়। যেমন উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, হংকংয়ের প্রতিবাদ বিক্ষোভের সূত্রপাত হয় হংকংয়ের লোকদের মেইন ল্যান্ড চীনে স্থানান্তরের মাধ্যমে বিচার করা হবেÑ অর্থাৎ স্থানীয় সরকার হংকংয়ের অধিবাসীদের মূল দেশ চীনে স্থানান্তর করার লক্ষ্যে আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিলে সেখানে বিক্ষোভ শুরু হয়। অপর দিকে লেবাননে হোয়াটসঅ্যাপের মেসেজিং সার্ভিসের কলে করারোপের ঘোষণা দিলে সেখানে বিক্ষোভ শুরু হয়। অর্থাৎ লেবাননে হোয়াটসঅ্যাপের কলের ওপর কর নির্ধারণ করায় জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিবাদ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। আবার কিছু প্রতিবাদ বিক্ষোভের মধ্যে সামঞ্জস্যতা খুঁজে পাওয়া যায়। এগুলো হলো অর্থনৈতিক মন্দা ও রাজনৈতিক হতাশার কারণে মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। একক ও বিচ্ছিন্ন কারণে বিক্ষোভ শুরু হওয়া দেশগুলোর মধ্যে শুধু লেবানন একা নয়।
সরকার জ্বালানির ওপর দেয়া সাবসিডি তুলে নেয়ার পর চলতি মাসে ইকুয়েডরে বিক্ষোভ শুরু হয়। দেশটির জনগণ বছরের পর বছর ধরে এই সুবিধা ভোগ করে আসছিল। হঠাৎ করে জ্বালানির ওপর দেয়া ভর্তুকি প্রত্যাহার করায় তারা প্রতিবাদে রাজপথে নেমে আসে। চিলিতে সাব-ওয়েতে মূল্যবৃদ্ধির পর গত মাসে সেখানে সহিংসতা শুরু হয়। এ দিকে ভারতেও মানুষ পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদ জানায়। প্রায় প্রত্যেক ক্ষেত্রে প্রতিবাদ বিক্ষোভ পরবর্তীকালে সহিংস ও বিশাল আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। কয়েকটি দেশে বিক্ষোভ বন্ধ হলেও অনেক দেশে তা এখনো চলমান রয়েছে। চিলিতে প্রেসিডেন্ট ভাড়া বৃদ্ধি বাতিল ঘোষণা করার পরও প্রতিবাদ অব্যাহত থাকে। জনগণের এসব অসন্তোষের মূল কারণ হলো অসমতা। আয়ের ক্ষেত্রে অসমতা ও বৈষম্যের কারণে অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতার সৃষ্টি হয় এবং এতে মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। লেবাননে হোয়াটসঅ্যাপে করারোপের কারণে বিক্ষোভ শুরু হলেও দেশটি হচ্ছে বিশ্বের অত্যন্ত অসম অর্থনীতির একটি দেশ। দেশটিতে ২০০৫ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ১ শতাংশ ধনী মোট জাতীয় উৎপাদনের ২৫ শতাংশ দাবি করে। চিলি হলো তার পার্শ্ববর্তী অনেক দেশের চেয়ে অধিকতর স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ দেশ। অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের সদস্য দেশগুলোর মধে চিলিতে সর্বোচ্চ পর্যায়ের পোস্ট ট্যাক্স ইনকাম অসমতা বিদ্যমান রয়েছে। অথচ বিশ্বের কয়েকটি ধনী দেশের মধ্যে এই সংস্থার সদস্য দেশগুলোর অবস্থান। ইরাকে গোটা প্রজন্মই অর্থনৈতিক দুর্দশায় নিপতিত হওয়ার কারণে অসন্তোষ ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেক দেশে প্রতিবাদ বিক্ষোভের মূল কারণ হলো আয়ে অসাম্যতা। বিশেষভাবে ধীর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং সরকারের ক্রমবর্ধমান ঋণ নীতিনির্ধারণকে বিপদের মুখে ঠেলে দেয়। পরিণতিতে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়।
এ কিছুর পরও আমি মনে করি- চলতি অর্থবছর বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে কেবল ৩ শতাংশ। অথচ গত জুলাই মাসে বলা হয়েছিল- প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ২ শতাংশ হবে। এই পূর্বাভাস সঠিক হলে, গত আর্থিক সঙ্কটের পর থেকে এটা হবে সবচেয়ে ধীর বা শ্লথ প্রবৃদ্ধি। বহু দেশ নিজেদের বাঁচানোর জন্য বড় ধরনের ঋণ করেছিল এবং এখনো তারা ঋণগ্রস্ত। বিশেষভাবে লেবাননের অবস্থা খুবই খারাপ। সেখানে জিডিপি অনুপাতে ১৫৫ শতাংশ ঋণ নেয়া হয়েছে। এতে করে দেশটি বিশ্বের তৃতীয় সর্বাধিক ঋণগ্রস্ত দেশে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনীতির নগণ্য প্রতিনিধি হিসেবে বলবো- বাংলাদেশের অবস্থাও ভালো না। স্বাধীনতা বিরোধী-দুর্নীতিবাজ-জঙ্গী নিয়ন্ত্রিত সরকারের একাংশের ভুল নীতির কারণে দুর্নীতির বাইরে ও সরকারের বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে এবং জনগণ ফুঁসে ওঠে। জনগণ তাদের স্থানীয় সরকার তাদের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষায় আর সক্ষম নয় বলে মনে করায় সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে। মনে রাখতে হবে- হংকং আন্দোলনের মুখে নতুন প্রত্যর্পণ বিল প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। একইভাবে আন্দোলনের মুখে লেবাননে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের পরও আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে এবং ইকুয়েডর বা চিলিতেও আন্দোলন প্রশমিত হয়নি। অবশ্য লেবাননসহ কয়েকটি দেশে সরকার পতনের দ্বারপ্রান্তে গিয়ে পৌঁছেছে। এসব আন্দোলন-সংগ্রামের কারণে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো শুধু অর্থনৈতিকভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, বরং সেখানে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে এবং বহু মানুষের প্রাণপ্রদীপ চিরতরে নিভে গেছে। আমি মনে করি সমাধান নীতি-আদর্শ-সততায় আসতে পারে আমাদের দেশ সহ সারা বিশ্বে...
২০১৯-এর সকল লোভাতুর রাজনীতির কথা ভুলে যেতে হবে ২০২০ সালে। নিতে হবে বিনয়- দেশপ্রেম ও সততার শপথ। এমনটিই আমি মনে করি রাজনীতির কনিষ্ট ধারক-বাহক ও যোদ্ধা হিসেবে...
মোমিন মেহেদী : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, অনলাইন প্রেস ইউনিটি