বিস্তার অভিযোগের ভিত্তিতে উপজেলা শিক্ষা অফিসারের অডিট রির্পোটে ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি ও জালজালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের তথ্য ফাঁস হওয়ার পর গত চার মাস পর্যন্ত কলেজে আসা বন্ধ করে আত্মগোপন করেছেন জামায়াত সমর্থিত অধ্যক্ষ মো. ইখতিয়ার উদ্দিন।
যে কারণে চার মাস বেতন-ভাতা বন্ধ থাকায় ওই কলেজের শিক্ষক ও কর্মচারীরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ইতোমধ্যে বিষয়টি স্থানীয় শিক্ষানুরাগীদের জানিয়েও কোনো সুফল না পেয়ে অবশেষে শিক্ষক ও কর্মচারীরা সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপ কামনা করে গত ২ জানুয়ারি মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছেন। ঘটনাটি জেলার গৌরনদী আল-আমিন টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজের।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শুরু থেকেই অধ্যক্ষ মো. ইখতিয়ার উদ্দিন নিজ সমর্থিত (জামায়াত) নেতাদের যোগসাজশে দুর্নীতির আঁতুর ঘরে পরিণত করেন পুরো কলেজটি। নিজের ইচ্ছেমতো কলেজ পরিচালনা, আয় ও ব্যয়ের হিসেব কাউকে না দিয়ে নিজের খেয়ালখুশি মতো নামে বেনামে ভাউচার তৈরি করে পুরো অর্থ আত্মসাত, নিয়োগ বাণিজ্যসহ বিস্তার অভিযোগ রয়েছে তার (অধ্যক্ষ) বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের সময় পুরোনো কলেজ গবর্নিং কমিটি বিলুপ্ত করে নতুন করে কমিটি গঠণ করা হয়। এরপর অধ্যক্ষর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের মধ্যে মাত্র একবছরের (২০১৪-১৫ অর্থ বছরের) কলেজের আয়-ব্যয়ের অডিট করা হয়েছে।
অডিট কমিটির প্রধান উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. সেলিম মিয়া ও অপর সদস্য সহকারী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা লিটু চট্টোপ্যাধয়ের ২০১৮ সালের ৩ জুন স্বাক্ষরিত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ওই একবছরের অডিটেই অধ্যক্ষ মো. ইখতিয়ার উদ্দিনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
সূত্রমতে, দুর্নীতি, অনিয়মসহ বেপরোয়া নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে কলেজের বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করে অধ্যক্ষ মো. ইখতিয়ার উদ্দিন ইতোমধ্যে গৌরনদী বন্দর সংলগ্ন ও কালকিনি উপজেলায় জমি ক্রয়ের মাধ্যমে অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন।
সূত্রে আরও জানা গেছে, প্রথম গৌরনদী গার্লস হাইস্কুল এণ্ড কলেজে অর্থনীতি বিভাগের প্রভাষক থাকাকালীন সময় ইখতিয়ার উদ্দিনের ইনডেক্সের মেয়াদ না হওয়া সত্ত্বেও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে তিনি (ইখতিয়ার) পাশ্ববর্তী কালকিনি উপজেলার কয়ারিয়া এসপিএস উচ্চ বিদ্যালয়ে ২০০৪ সালের ২ মে যোগদান করে কারিগরি কলেজে উন্নীত করেন। দীর্ঘদিন পর ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং সভাপতি জানতে পারেন তার প্রতিষ্ঠানে দুইজন প্রধান। যারমধ্যে স্কুল শাখার প্রধানশিক্ষক আবদুল লতিফ মিয়ার বেতন আসে মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে আর কারিগরি কলেজের প্রধান ইখতিয়ার উদ্দিনের বিল আসে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে। একই প্রতিষ্ঠানে দুইজন প্রধান থাকার বিষয়টি জানতে পারেন কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের তৎকালীন মহা-পরিচালক নিতাই রায় চৌধুরী। পরবর্তীতে তিনি ইখতিয়ার উদ্দিনকে সমূদয় বেতনের টাকা ফেরত দেয়ার নির্দেশ দেন। এরপর ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ইখতিয়ার উদ্দিন চাকরিচ্যুত হন।
স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে গৌরনদী বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন উত্তর পার্শ্বের গয়নাঘাটা ব্রিজ সংলগ্নস্থানে একটি এতিমখানা নির্মানের জন্য এলাকার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মো. শাহজাহান ঠাকুর ৭৬ শতক জমি দান করেন। পরবর্তীতে ওইজমির ওপর স্থানীয় জামায়াত নেতাদের উদ্যোগে গৌরনদী আল-আমিন এতিমখানা গড়ে তোলা হয়।
সূত্রমতে, কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের মহা-পরিচালক পদে রদবদল হওয়ার পর চাকরিচ্যুত ইখতিয়ার উদ্দিন গৌরনদীর জামায়াত নেতাদের নিয়ে বৈঠক করে ২০০৬ সালে ওই এতিমখানার সম্পত্তি ও পাশ্ববর্তী সরকারি খালের জমি ভরাট করে গৌরনদী আল-আমিন টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের তৎকালীন কতিপয় কর্মকর্তার যোগসাজশে তিনি (ইখতিয়ার উদ্দিন) ওই কলেজের অধ্যক্ষ পদে অধিষ্ঠ হন। শুরু থেকেই তিনি (অধ্যক্ষ) নিজের পছন্দসই লোককে কলেজ গবর্নিং বডির কমিটিতে রেখে লুটপাটের মেতে ওঠেন। তিনি শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগের নামে শুরু করেন বেপরোয়া নিয়োগ বাণিজ্য। মোটা অংকের টাকা ঘুষ দেয়ার পরেও বিনাবেতনে দীর্ঘ বছর দায়িত্ব পালন করার পর বিল হবেনা জানিয়ে বিতাড়িত করা হয় একাধিক শিক্ষক ও কর্মচারীদের। পরবর্তীতে ওইসব শূণ্যপদে খন্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগ করে পূর্ণরায় মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে জালজালিয়াতির মাধ্যমে তাদের এমপিও করা হয়েছে।
জানা গেছে, অধ্যক্ষর চাহিদা অনুযায়ী কলেজ উন্নয়নের নামে মোটা অংকের টাকা ডোনেশন নিয়ে ২০০৬ সালের ১০ জুন কম্পিউটার প্রদর্শক পদে রোখসানা জেরিন, একই বছর সাচিবিক বিদ্যায় একই পন্থায় জেসমিন পারভীন, বাংলা বিভাগের প্রভাষক ইসরাত জেরিন, গার্ড রুবেল সন্যামতসহ অনেকেই নিয়োগ দেয়ার পর তারা দীর্ঘদিন বিনাবেতনে স্ব-স্ব দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হলে তাদের বিল হবে এবং তখন তাদের ডাকা হবে জানিয়ে একপ্রকার জোরকরেই প্রতিষ্ঠান থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে। ওইসব শূণ্যপদে পূর্ণরায় মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে খন্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। এরইমধ্যে ২০১০ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি এমপিওভুক্ত করা হয়েছে।
পরবর্তীতে পূর্বের ডোনেশন দেওয়া শিক্ষক-কর্মচারীরা কলেজ অধ্যক্ষর সাথে যোগাযোগ করলে তাদের একপ্রকার নাজেহাল করে কলেজ থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে। পরবর্তীতে খোঁজনিয়ে ওইসব শিক্ষক-কর্মচারীরা জানতে পারেন, পূর্ণরায় মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে অধ্যক্ষ তার পছন্দসই খন্ডকালীন শিক্ষকদের জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে এমপিও করিয়েছেন। এরমধ্যে কম্পিউটার প্রদর্শক পদে প্রথম নিয়োগ পাওয়া রোখসানা জেরিনের স্থানে জালিয়াতির মাধ্যমে এমপিও করা হয়েছে খন্ডকালীন শিক্ষক যুবদল নেতা মাসুম বিল্লাহ মিলনকে।
অভিযোগ রয়েছে, কলেজটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে এমপিওভুক্ত হওয়ার বেশ কয়েকবছর পর পর্যন্ত কলেজ গবর্নিং বডির সভাপতি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন জামায়াতের বরিশাল জেলা সুরা কমিটির সাবেক সদস্য ও মহানগর জনশক্তি কমিটির অন্যতম সদস্য অধ্যাপক মোসলেম উদ্দিন সিকদার। সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন জামায়াতের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত থাকার সুবাদে অত্র কলেজে অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ পাওয়া মো. ইখতিয়ার উদ্দিন।
সূত্রমতে, মো. ইখতিয়ার উদ্দিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সময় শিবিরের সক্রিয় নেতা ছিলেন। গৌরনদীর স্থায়ী বাসিন্দা না হওয়া সত্ত্বেও শুরুতে গবর্নিং বডির শিক্ষানুরাগী সদস্য করা হয়েছিলো বরিশাল টেকনিক্যাল স্কুল এণ্ড কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ জামায়াত সমর্থিত মো. সেলিম ভূঁইয়াকে। শিক্ষানুরাগী অপর সদস্য ছিলেন দীর্ঘদিন যাবৎ জামায়াতের গৌরনদী পৌর আমীর পদে অধিষ্ঠিত থাকা উজিরপুর উপজেলার ধামুরা ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক মো. আলাউদ্দিন মিয়া। গৌরনদী উপজেলা জামায়াতের সাবেক আমীর ডাঃ সরোয়ার আলম সিকদারকে ম্যানেজিং কমিটির সেক্রেটারি ও জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামের স্থানীয় প্রতিনিধি এইচএম নাসির উদ্দিনকে ছাত্র এবং জামায়াতের নারী সদস্য আনোয়ারা বেগমকে ছাত্রী অভিভাবক সদস্য করা হয়েছিলো। এছাড়াও ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যক্ষর স্ত্রী, জামায়াত ও বিএনপির প্রভাবশালী নেতাদের কয়েকজন আত্মীয়-স্বজনদের স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে শিক্ষক ও কর্মচারী পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
উল্লেখিত সকল অভিযোগ অস্বীকার করে কলেজ অধ্যক্ষ মো. ইখতিয়ার উদ্দিন বলেন, আমি কোনো রাজনীতিক দলের সাথে জড়িত নেই। মূলত কলেজের বর্তমান কমিটি নিয়ে দ্বন্ধের জেরধরে কতিপয় শিক্ষক যাঁরা আমাকে সরিয়ে কলেজের অধ্যক্ষ হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন তারা স্থানীয় এক প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতার প্রভাব বিস্তার করে আমাকে কলেজে যেতে নিষেধ করেছেন। ওইসব শিক্ষকরা গত তিন বছর পর্যন্ত কলেজের আয়ের প্রায় ৩০ লাখ টাকা নিজেদের কাছে রেখেছেন। আমি একজন অধ্যক্ষ হয়েও কলেজের আয় ব্যয়ের হিসেব চাইতে গেলে তারা ক্ষমতার প্রভাব দেখিয়ে আমাকে মারধর করতে চাইছেন। তাই তাদের হামলার ভয়ে আমি গত চারমাস পর্যন্ত কলেজে যেতে পারছিনা।
তিনি আরও বলেন, কমিটির অনুমোদন দিয়েছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য মন্ত্রী আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ মহোদয়। এখানে আমার কি করার আছে। তিনি চাইলেই কমিটি পরিবর্তন করা সম্ভব নতুবা আমার কিছুই করার নেই। অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগের কোনো সত্যতা নেই বলেও তিনি (অধ্যক্ষ) উল্লেখ করেন।