“হে আল্লাহ, আমাদের জিন্দেগীর গুনাহ খাতা মাফ করে দেন। হে আল্লাহ, উম্মত গুনাহগার, আপনি সকল উম্মতকে মাফ করে দেন। হে আল্লাহ, আপনার হাবিবের এতিম উম্মতকে মাফ করে দেন। হে আল্লাহ, আমাদের ইমানী জিন্দেগী নসিব করে দেন। হে আল্লাহ ইমানের সঙ্গে মউত নসিব করে দেন। হে আল্লাহ, খারাবী মউত থেকে আমাদের হেফাজত করেন। হে আল্লাহ, সারা জীবন যেন আপনার হাবিবের সুন্নতের উপর চলতে পারি সেই তৌফিক দান করেন। হে আল্লাহ, জাহেলী জামানা খতম করেন। হে আল্লাহ, এলেমী জিন্দেগী কায়েম করে দেন। হে আল্লাহ, যে এলেম আমাদের দুনিয়া ও আখেরাতে উপকারে আসবে সেই এলেম আমাদের দান করেন। হে আল্লাহ, বিশ্বের সকল মুসলমানের জানা-মাল, ইমান, আমল, ইজ্জত-আব্রু রক্ষা করেন। হে আল্লাহ, আমাদের ঝগড়া-বিবাদ, মারামারি-হানাহানি খতম করে দেন। হে সকল মুসলমানকে এক শরীরের মতো বানিয়ে দেন। হে আল্লাহ, আমাদের দিলের মধ্যে মহ্ববত তৈরি করে দেন। হে আল্লাহ, আপনি আমাদের প্রতি রাজি হয়ে যান। হে আল্লাহ, সারা দুনিয়াকে রক্ষা করেন। হে আল্লাহ, আমাদের পেরেশানি দূর করে দেন। হে আল্লাহ, সারা দুনিয়ায় এই দাওয়াতি কাজ পৌঁছে দেন। হে আল্লাহ, বাতিলের সব রাস্তাকে বন্ধ করে দেন। হে আল্লাহ, সারা দুনিয়ার মানুষকে হকের উপর কায়েম করেন। হে আল্লাহ, হক্ক ওয়ালাদের রহমত করেন। হে আল্লাহ, যাঁরা রোগে আক্রান্তদেরকে শেফা দান করেন। হে আল্লাহ, বিশ্ব ইজতেমাকে কবুল করেন। হে আল্লাহ, আমাদের দোয়া কবুল করেন” ইত্যাদি গভীর আকুতি-মিনতিপূর্ণ মোনাজাতের মধ্য দিয়ে গতকাল তাবলিগ জামায়াতের বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব শেষ হয়েছে।
এদিকে ধর্মমন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের নির্দেশে প্রথম পর্বে আগত মুসল্লিরা আজ (সোমবার) আসরের পূর্বে ইজতেমা ময়দান ত্যাগ করতে হবে বলে জানিয়েছেন টঙ্গী পশ্চিম থানার ওসি মো. এমদাদুল হক।
মোনাজাতে সমগ্র বিশ্বের মুসলমানদের নিরাপত্তা, মুক্তি এবং ইহ ও পারলৌকিক কল্যাণ কামনা করে মহান রাব্বুল আলামীনের কাছে কাকুতি মিনতি জানানো হয়। গভীর ভাবাবেগপূর্ণ পরিবেশে ‘আমীন, আল্লাহুম্মা আমীন’ ধ্বনিতে মধ্যাহ্নের আকাশ-বাতাস কাপিঁয়ে মহামহিম ও দয়াময় আল্ল¬াহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে অপার করুণা ও অশেষ রহমত কামনা করেছেন দেশ-বিদেশের অগণিত ধর্মপ্রাণ মুসলমান।
লাখো মানুষের কাঙ্খিত আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করেন কাকরাইল জামে মসজিদের পেশ ইমাম ও খতীব হাফেজ মাওলানা জোবায়ের আহমদ।
বেলা ১১ টা ০৮ মিনিট থেকে শুরু করে ১১ টা ৪৬ মিনিট পর্যন্ত ৩৮ মিনিট স্থায়ী আবেগঘন আখেরী মোনাজাতে অযুতকন্ঠে উচ্চারিত হয়েছে রাহমানুর রাহীম আল্লাহর মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব। মনীব-ভৃত্য, ধনী-গরীর, নেতা-কর্মী নির্বিশেষে সকল শ্রেণী-পেশা-গোষ্ঠীর মানুষ পরওয়ারদেগার আল্লাহর দরবারে দু’হাত তুলে নিজ নিজ কৃতকর্মের জন্য নি:শর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। দক্ষিণে খিলক্ষেত, উত্তরে গাজীপুর চৌরাস্তা, পূর্বে টঙ্গী বিসিক শিল্পনগরী ও পশ্চিমে আশুলিয়া পর্যন্ত প্রায় ১৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকা বিস্তৃত বিশাল জনসমুদ্র থেকে মধ্যাহ্নের আকাশ কাপিয়ে ধ্বনি উঠে- হে আল্লাহ, হে আল্লাহ। মুঠোফোনে এবং স্যাটেলাইট টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারের সুবাধে দেশ-বিদেশের আরো লাখ লাখ মানুষ এক সঙ্গে হাত তুলেছেন পরওয়ারদিগারের শাহী দরবারে। গুনাহগার, পাপী-তাপী বান্দা প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা চেয়ে কান্নায় বুক ভাসিয়েছেন। দেশের ৬৪ জেলার মুসল্লি ছাড়াও বিশ্বের ৬৫টি দেশের প্রায় ২৫শ’ তাবলিগ অনুসারী বিদেশি মেহমান আখেরি মোনাজাতে অংশ নিয়েছেন।
সকাল থেকে দিক নির্দেশনামূলক বয়ানের পর লাখো মানুষের প্রতীক্ষার অবসান ঘটে বেলা ১১ টা ০৮ মিনিটে। জনসমুদ্রে হঠাৎ নেমে আসে পিনপতন নীরবতা। যে যেখানে ছিলেন সেখানে দাঁড়িয়ে কিংবা বসে হাত তুলেন আল্লাহর দরবারে। আখেরি মোনাজাতকে ঘিরে গতকাল লাখ লাখ মুসলমান যেন ভেঙে পড়েছিলেন টঙ্গীতে। সকল পথের মোহনা হয়ে উঠে তুরাগ তীরের ইজতেমা নগরী। রাজধানী ঢাকা ছিল প্রায় ফাঁকা। টঙ্গী, গাজীপুর, উত্তরাসহ চারপাশের এলাকার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কলকারখানা, মার্কেট, বিপনীবিতান, অফিসসহ সব কিছু ছিল বন্ধ। সকলের প্রাণান্তকর চেষ্টা ছিল দেশ-বিদেশের লাখ লাখ মুসল্লিদের সাথে মোনাজাতে শরীক হয়ে নিজের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা। ৩৮ মিনিটের আবেগঘন মোনাজাতে হাফেজ মাওলানা জুবায়ের আহমেদ প্রথম ১৭ মিনিট মূলত: পবিত্র কোরআনে বর্ণিত দোয়ার আয়াতগুলো উচ্চারণ করেন। শেষ ২১ মিনিটে তিনি বাংলা ভাষায় দোয়া করেন।
ভিআইপিদের মোনাজাতে অংশগ্রহণ : ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বি মিয়া, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আলহাজ মো. জাহিদ আহসান রাসেল, গাজীপুর সিটি মেয়র অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর আলম, গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার আনোয়ার হোসেন, জেলা প্রশাসক এসএম তরিকুল ইসলাম আখেরি মোনাজাতে অংশগ্রহণ করেন ।
ইজতেমায় মুসল্লি¬দের বাঁধভাঙ্গা জোয়ার : শনিবার আখেরি মোনাজাতে শরীক হতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে র্ধমপ্রাণ মুসল্লিগণ টঙ্গী অভিমুখে ছুটতে থাকেন শুক্রবার থেকে। বিশ্ব ইজতেমায় অংশগ্রহণকারীরা ছাড়াও কেবলমাত্র আখেরি মোনাজাতে শরীক হতে দূর-দূরান্ত থেকে মুসল্লিগণ বাস, ট্রাক, মিনিবাস, কার, মাইক্রোবাস, ট্রেন, লঞ্চ-ষ্টিমারে করে টঙ্গীতে পৌঁছে অবস্থান নিতে শুরু করেন। রাজধানীসহ পার্শ্ববর্তী এলাকার লোকজন ভিড় এড়াতে নানা ঝক্কি ঝামেলা উপেক্ষা করে রাতেই টঙ্গীমুখো হয়। রাজধানী ঢাকার সরকারি বেসরকারি অফিস, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, দোকানপাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সর্বত্রই ছিল পূর্ণ ছুটির আমেজ। গভীর রাত থেকে টঙ্গীমুখি সকল প্রকার যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়ায় দীর্ঘ পথ হেঁটে টঙ্গী পৌঁছতে হয়েছে লাখ লাখ মানুষকে। কয়েক লাখ মানুষ রাতেই ইজতেমার মাঠ কিংবা আশপাশের বাসা-বাড়ি, ভবন, ভবনের ছাদ কিংবা করিডোরে এমনকি গাছতলায় অবস্থান নিয়েছেন। শনিবার ভোররাত থেকে যানবাহন শূন্য সড়ক-মহাসড়ক ও নদীপথে টুপি পাঞ্জাবি পরা মানুষের বাধঁভাঙ্গা জোয়ার শুরু হয়। চারিদিকে যত দূর চোখ যায় শুধু মানুষ আর মানুষ। সকাল আটটার মধ্যে গোটা এলাকা জনতার মহাসমদ্রে পরিণত হয়।
এদিকে বিশ্ব ইজতেমার আখেরী মোনাজাতে আগের তুলনায় মহিলাদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। পুরুষদের পাশাপাশি বিভিন্ন বয়সী মহিলাকে মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে টঙ্গী পৌঁছে মোনাজাতে অংশ গ্রহণ করতে দেখা গেছে। টঙ্গী, গাজীপুর ও সাভারের সকল গার্মেন্ট কারখানা বন্ধ থাকায় এসব কারখানার হাজার হাজার মহিলা শ্রমিক মোনাজাতে যোগ দেয়। প্রচণ্ড ভিড়ে অনেক বেপর্দা মহিলার সমাগম কোনো কোন ক্ষেত্রে বিব্রতকর পরিস্থিতিও তৈরি করে।
মোনাজাতে যা বলা হল : গতবারের মতো এবারও আরবির সঙ্গে বাংলায় বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করা হয়। কাকরাইল জামে মসজিদের পেশ ইমাম ও খতীব হাফেজ মাওলানা জুবায়ের আহমেদ আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করেন।
প্রথম ১৭ মিনিট আরবিতে এবং পরে ২১ মিনিট বাংলা ভাষায় মোনাজাত পরিচালনা করেন। মোনাজাতে তিনি বলেন, হে আল্লাহ, আমাদের জিন্দেগীর গুনাহ খাতা মাফ করে দেন। হে আল্লাহ, আমাদের সকল গুনাহ মাফ করে দেন। হে আল্লাহ, উম্মত গুনাহগার, আপনি সকল উম্মতকে মাফ করে দেন। হে আল্লাহ, আপনার হাবিবের এতিম উম্মতকে মাফ করে দেন। হে আল্লাহ, আমাদের ইমানী জিন্দেগী নসিব করে দেন। হে আল্লাহ ইমানের সঙ্গে মউত নসিব করে দেন। হে আল্লাহ, খারাবী মউত থেকে আমাদের হেফাজত করেন। হে আল্লাহ, সারা জীবন যেন আপনার হাবিবের সুন্নতের উপর চলতে পারি সেই তৌফিক দান করেন। হে আল্লাহ, জাহেলী জামানা খতম করেন। হে আল্লাহ, এলেমী জিন্দেগী কায়েম করে দেন। কায়মনোবক্যে আকুতি জানিয়ে মোনাজতে আরো বলা হয়, হে আল্ল¬াহ, তুমি তো ক্ষমাশীল, তোমার কাছেইতো আমরা ক্ষমা চাইব। দ্বীনের উপর আমাদের চলা সহজ করে দাও। হে আল্লাহ, তুমি আমাদের উপর সন্তুষ্ট হয়ে যাও। আমরা যেন তোমার সন্তুষ্টি মাফিক চলতে পারি সে তওফিক দাও। দুনিয়ার সকল বালা-মসিবত থেকে আমাদের হেফাজত করো। নবীওয়ালা জিন্দেগী আমাদের নসিব করো। ইজতেমার আয়োজনে যাঁরা শ্রম দিয়েছে তাদের কবুল করো। যাঁরা তোমার কাছে হাত তুলেছে সকলকে তুমি কবুল করো। ইজতেমার বক্তা ও শ্রোতা সকলকে তুমি কবুল করো। দাওয়াতে তাবলিগকে বিশ্বব্যাপী প্রসারিত করো।
হেদায়েতি বয়ান : তাবলিগের রীতি অনুযায়ী ইজতেমার মোনাজাতের দিন বাদ ফজর কোনো বয়ান হয় ন্ াতবে সকাল ৮টা থেকে হেদায়েতি বয়ান করা হয়। গতকাল সকাল ৮টা থেকে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত হেদায়েতি বয়ান করেন পাকিস্তানের মাওলানা জিয়াউল হক। তাঁর বয়ান বাংলায় ভাষান্তর করেন বাংলাদেশের মাওলানা ওমর ফারুক। মাওলানা জিয়াউল হক সমবেত মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে বলেন, আমাদেরকে সব সময় ইমান, আমল ও দ্বীনের দাওয়াতের কাজ করতে হবে। তিনি বলেন, নবী-রাসূলগণ দুনিয়াতে এসেছেন, দ্বীনের দাওয়াত দিয়েছেন। কিন্তু কারো কাছে কিছু চান নি। তেমনিভাবে আমরা দ্বীনের দাওয়াতের কাজ করতে বের হবো এবং দাওয়াতে মেহনতের কাজ করবো। সে মেহনতের পুরস্কার মানুষের কাছে চাইব না। দাওয়াতে মেহনতের পুরস্কার স্বয়ং আল্লাহপাক দিবেন। তিনি আরও বলেন, আমরা যখন দাওয়াতের কাজে বের হবো তখন দোয়া করে বের হবো। প্রতিটি কাজ করার আগে দোয়া করতে হবে। তিনি আরও বলেন, মানুষ হেদায়েত পেতে হলে মেহনত করতে হবে। মেহনত অনেক ধরনের রয়েছে যেমন: ব্যবসার মেহনত, ক্ষেতখামারের মেহনত, মাল সামানার মেহনত দ্বারা হেদায়েত পাওয়া যাবে না। তিনি বলেন, নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সালাম ও সাহাবায়ে আজমাঈনগণ যে তরিকায় মেহনত করেছেন ওই তরিকায় যখন মেহনত হবে তখন আল্লাহ তা’য়ালা আমাদেরকে হেদায়েত দান করবেন। তিনি আরও বলেন, মেহনত হবে সুন্নতি তরিকায়। তিনি বলেন, আমাদের ইমানকে নতুন করতে হবে, তাজা করতে হবে। নবি করিম (স.) সাহাবায়ে কেরামের ইমান তাজা করার জন্য তাগিদ দিয়েছেন।
মোনাজাতপূর্ব সমাপনী বয়ান : ভারতের মাওলানা ইব্রাহীম দেওলা আখেরি মোনাজাতপূর্ব সমাপনী বয়ান পেশ করেন। তিনি তার বয়ানে বলেন, হয়রত ইলিয়াস (র.) বলতেন-সকলের মেহনতকে জমা করা বা একত্র করা হলো ইজতেমা। দীর্ঘ এক বছর বিভিন্ন এলাকায় সাথী ভাইদের নিয়ে মেহনত করে করে বছর শেষে এক সাথে জমা হওয়া। পরে আবার বিভিন্ন সময়ের জন্য চিল্লায় বের হয়ে ঘরে ঘরে গিয়ে দাওয়াতের মেহনতের মাধ্যমে সমস্ত মানুষের জেহেন তৈরি করা। দেশের জন্য বিদেশের জন্য, কাছের জন্য দুরের জন্য জামাত তৈরি করা এবং আল্লাহর রাস্তায় চলতে থাকা। আল্লাহর রাস্তায় মেহনত করতে থাকা। ইজতেমার আগেও এক মেহনত এবং পরেও এক মেহনত। এই দুই মেহনতকে একত্র করার জন্যই এই ইজতেমা। তিনি বলেন, যেদিন থেকে ইজতেমার তারিখ নির্ধারণ হয়ে যায়, সেদিন থেকেই ইজতেমার মেহনত শুরু হয়ে যায়। তিনি আরও বলেন, সব মেহনতেরই একটা উদ্দেশ্য থাকে। একজন ব্যবসায়ী সে মুনাফা লাভের আশায় মেহনত করে। আর ইজতেমা ওয়ালাদের মেহনতের উদ্দেশ্য হলো- মেহনতের মাধ্যমে আমাদের প্রত্যেকের পুরো জীবনে যেন দ্বীন এসে যায়। তিনি বলেন, দাওয়াতের মেহনতের মাধ্যমে ইমান মজবুত হয়। তিনি তার বয়ানে আরও বলেন, আল্লাহ তায়ালার অস্তিত্ব সবার আগে। আল্লাহ তায়ালার আগেই আর কেউ নেই। তাই আল্লাহর হক আদায় করতে হবে। আল্লাহ তায়ালার হক হলো-আল্লাহর উপর ইমান রাখা, ইবাদত করা, আল্লাহর হুকুম মেনে চলা। আল্লাহর হুকুমকে যথাযথভাবে পালন করতে হবে। মূর্খতা ও অজ্ঞতার সাথে পালন করা যাবে না। তিনি বলেন, ইবাদত অন্যের দেখাদেখি করলে হবে না। এলেম শিখে ইবাদত করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা ইবাদত করার জন্য এলেম নাজিল করেছেন। তাই এলেম শিখে আল্লাহর ইবাদত করতে হবে। তিনি আরও বলেন, আখেরাতের জিন্দেগী তাদের জন্য সুখময় হবে, যাঁরা দুনিয়াতে কোনো বড়াই না করে চলে। দুনিয়াতে এমনভাবে থাকতে হবে যাতে মানুষের মাঝে কোনো অহংকার না আসে, বড়াই না আসে। তিনি বলেন, প্রত্যেককে ইনসাফ ও এহসান করতে হবে। কারো হক নষ্ট করা যাবে না। একটি হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি আরও বলেন, তুমি তোমার ভাইকে সাহায্য কর, আল্লাহ তোমার সাহায্য করবেন। তুমি তোমার ভাইয়ের পেরেশানিকে দূর কর, আল্লাহ তোমার পেরেশানিকে দূর করবেন।
ফিরতি যাত্রায় বিড়ম্বনা : আখেরি মোনাজাত শেষ হওয়ার পর এক সঙ্গে লাখ লাখ মানুষ ফিরতে শুরু করলে সর্বত্র মহাজটের সৃষ্টি হয়। টঙ্গী স্টেশনে ফিরতি যাত্রীদের জন্য অপেক্ষমাণ ট্রেনগুলোতে উঠতে মানুষের জীবনবাজির লড়াই ছিল উদ্বেগজনক। ট্রেনের ভেতরে জায়গা না পেয়ে ছাদে ও দরজা-জানালায় ঝুলে হাজার হাজার মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফিরতে দেখা যায়। একপর্যায়ে মানুষের জন্য ট্রেন দেখা যাচ্ছিল না। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক ও আশুলিয়া সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় ফিরতি মুসল্লিদের বিড়ম্বনা ও কষ্টের সীমা ছিল না। ৩-৪ দিন ধরে টঙ্গীতে জমায়েত হওয়া মুসল্লিরা আখেরি মোনাজাত ও যোহরের নামাযের পর একযোগে নিজ নিজ গন্তব্যে ফিরতে চাইলে অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হন। হাজার হাজার বৃদ্ধ, শিশু-কিশোর ও মহিলা মাইলের পর মাইল হেঁটে মোনাজাতে শরীক হন এবং একইভাবে ফিরেন। বিকেলে সীমিত আকারে যানবাহন চলাচল শুরু হলেও পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি হয়নি।
২০২১ সালে শূরায়ী নেজামের দুই ধাপে বিশ্ব ইজতেমার ঘোষণা : আগামি ২০২১ সালে টঙ্গীর তুরাগ নদের তীরে বিশ্ব ইজতেমা শূরায়ী নেজামের বিশ্ব ইজতেমার তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। আখেরি মোনাজাতের পরপরই বয়ান মঞ্চের মাইকে তা ঘোষণা করা হয়। ৮, ৯, ১০ জানুয়ারি প্রথমপর্ব মাঝে ৪দিন বিরতি দিয়ে ১৫, ১৬, ১৭ জানুয়ারি-২০২১ইং দুইধাপে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হবে।
এবারের ইজতেমা ওলামা-মাশায়েক শূরায়ী নেজাম অনুসারী মুসল্লিদের সংখ্যা বেশি হওয়ায় দেশি-বিদেশি মুসল্লিদের সুবিধার্থে ২০২১ সালে দুই ধাপে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছেন ইজতেমার মুরুব্বি প্রকৌশলী মাহফুজ হান্নান। আগামি ২৭ নভেম্বর থেকে ১ ডিসেম্বর-২০২০ শূরায়ী নেজামের পাঁচ দিনে জোড় ইজতেমা অনুষ্ঠিত হবে।
বিশ্ব ইজতেমা ময়দানের গণমাধ্যম সমন্বয়কারী মুফতি জহির ইবনে মুসলিম বলেন, প্রায় ৪০-৪৫ লাখ মুসল্লি আজকের আখেরি মোনাজাতে অংশ নিয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে দিন দিন মুসল্লি সংখ্যা বাড়তেই থাকবে। ইনশাআল্লাহ।
ইজতেমায় ১৩ মুসল্লির মৃত্যু : শনিবার রাত ও রোববার দুপুর পর্যন্ত ইজতেমা ময়দানে আরও তিন মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে। এনিয়ে তিনদিনের ইজতেমায় ১৩জন মুসল্লির মৃত্যু হলো। তারা হলেন-কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদি থানার দুলদিয়া গ্রামের পীর বক্সের ছেলে নুরু ইসলাম (৬০), কক্সবাজার জেলার টেকনাফ থানার করাচিপাড়া গ্রামের মোছম আলীর ছেলে আলী আহমেদ (৬১) ও জয়পুরহাট জেলার পাঁচবিবি থানার হাটখোলা গ্রামের জমির উদ্দিনের ছেলে আবদুল মমিন (৫৫) হৃদরোগসহ বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেছেন। এছাড়াও ময়দানে মারা গেছেন -রাজশাহী জেলার চারঘাট থানার বন কিশোর গ্রামের আবদুর রহমানের ছেলে আবদুর রাজ্জাক (৬৫), ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আশুগঞ্জ থানার বড়তল্লা গ্রামের আবদুস সাত্তারের ছেলে শাহজাহান (৬০), কুমিল্লা জেলার দেবিদ্বার থানার ভিংলাবাড়ি গ্রামের আবদুস সোবহানের ছেলে তমিজ উদ্দিন (৬৫), বরিশাল জেলার গৌরনদী থানার খালিজপুর এলাকার আলী আজগর (৭০), নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানার দক্ষিণ কলাবাগান এলাকার মো. ইউসুফ আলী মেম্বার (৪৫), নওগাঁর শহিদুল ইসলাম (৫৫), গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়া এলাকার ইয়াকুব শিকদার (৮৫), সিরাজগঞ্জের খোকা মিয়া (৬০) এবং চট্টগ্রামের মুহাম্মদ আলী (৭০) মারা যান। বিষয়টি ইজতেমা ময়দানের মাসলেহাল জামাতের জিম্মাদার মো. আদম আলী নিশ্চিত করেছেন। এছাড়াও আখেরি মোনাজাতে অংশগ্রহণ করতে শনিবার রাত আটটার দিকে ইজতেমা ময়দানে যাওয়ার পথে কলেজগেট এলাকায় মাজাহারুল নামে এক মাদরাসা ছাত্র গাড়ির চাপায় নিহত হয়েছেন। গাড়ির জানালার দিয়ে বমি করার সময় অনাবিল পরিবহণের একটি গাড়ি তার মাথায় সজোরে আঘাত করলে সে গুরুতর আহত হয়। পরে তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
নিহত মাজহারুল নেত্রকোনা জেলার পূর্বধলা থানার বিলজুরা গ্রামের আবদুর রহিমের ছেলে। তিনি গাজীপুর মহানগরীর গাছা এলাকার আবদুল কাদের জিলানী (র.) নুরিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসার হেফজ বিভাগের ছাত্র ছিলেন।
বিদেশি ৯০টিসহ ২ হাজার জামাত : ইজতেমা আয়োজক কমিটির শীর্ষ মুরুব্বি প্রকৌশলী মাহফুজ হান্নান বলেন, তাবলীগের শীর্ষ মুরুব্বিদের দিক-নির্দেশনা অনুযায়ী আখেরি মোনাজাত শেষে বিদেশি ৯০টিসহ ২ হাজার জামাত দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছেন। এসব জামাতবন্দীদের মধ্যে ৪০ দিন, ৩ মাস, ৬ মাস, ১ বছর ও আজীবন চিল্লাধারী মুসল্লিরা রয়েছেন। তারা বর্হিবিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা শহর এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে দাওয়াতি কাজ করবেন।
মুসল্লিদের ময়দান ছাড়ার নির্দেশ প্রশাসনের : ইজতেমা ময়দানে প্রথম পর্বে অংশগ্রহণকারী সকল মুসল্লিকে আজ সোমবার আসরের পূর্বে ময়দান ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে টঙ্গী পশ্চিম থানার ওসি মো. এমদাদুল হক বলেন, ধর্মমন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের নির্দেশে সোমবার আসর নামাজের পূর্বে সমবেত মুসল্লিদের ময়দান ত্যাগ করতে বলা হয়েছে।
ভিক্ষুকদের আনাগোনা : ইজতেমা ময়দানের চর্তুপাশে ছিল ভিক্ষুকদের আনাগোনা। তাদের পঙ্গু, অর্ধনগ্ন ও বিকৃত চেহারায় অনেককে বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়েছে।
ইজতেমা আয়োজক কমিটির সন্তোষ প্রকাশ : দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মুসল্লিদের আসতে এবং ময়দানের সার্বিক নিরাপত্তা বিধানে আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের ভূমিকায় প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও সরকারের প্রতি ইজতেমা আয়োজক কমিটি সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। এ ছাড়া ময়দান ও এর আশপাশে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটায় তারা সন্তুষ্ট।