টঙ্গীর কহর দরিয়াখ্যাত তুরাগ নদের তীরে কাল শুক্রবার তাবলিগ জামাতের শীর্ষ মুরুব্বি ভারতের মাওলানা মুফতি শেহজাদের আ’ম বয়ানের মধ্যদিয়ে শুরু হয়েছে মাওলানা সা’দ কান্ধলভী অনুসারি তাবলিগ জামাতের ৫৫তম বিশ্ব ইজতেমা। ১৯ জানুয়ারি দুপুরে আখেরি মোনাজাতের মধ্যদিয়ে তা শেষ হবে। ইজতেমাকে সামনে রেখে ইতোমধ্যে ময়দানের সকল কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের ঢল এখন টঙ্গী মুখী। পুরো ময়দান এখন টুপি-পাঞ্জাবী পড়া মানুষে ভরপুর। ইবাদত-বন্দেগীর মোক্ষম সময় হৃদয়ে ধারণ করে মুসল্লিদের ¯্রােত টঙ্গী অভিমুখে বেড়েই চলছে। এ ¯্রােত থাকবে আখেরি মোনাজাতের আগ পর্যন্ত। শুক্রবার ইজতেমা ময়দানে দেশের বৃহত্তম জুমার জামাত অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশের মাওলানা মোশারফ হোসেন জুমার জামাতের ইমামতি করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিশ্ব ইজতেমা শুক্রবার শুরু হলেও গত ১৬ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে জামাতবদ্ধ মুসল্লি¬রা ইজতেমা ময়দানে আসতে শুরু করেছেন। দেশের ৬৪টি জেলার মুসল্লিরা তাদের জন্য নির্ধারিত খিত্তায় অবস্থান নিয়ে ইবাদত বন্দেগিতে মশগুল রয়েছেন। কোনো কোন জেলার মুসল্লি¬ কোনো খিত্তায় অংশ নেবেন সে দিক নির্দেশনাও ইতোমধ্যে দেওয়া হয়েছে। ময়দানে মুসল্লিদের অবস্থানও জেলাওয়ারি নির্দিষ্ট খিত্তায় (ভাগে) বিভক্ত করা হয়েছে।
ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বে বিশ্বের শতাধিক দেশের প্রায় ১০-১২ হাজার বিদেশি মেহমান আখেরি মোনাজাতে অংশগ্রহণ করবেন বলে আয়োজক কমিটির মুরুব্বিরা আশা করছেন। বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত বিশ্বের অর্ধশতাধিক দেশের প্রায় ৩ হাজার ১৯জন বিদেশি মেহমান ময়দানে তাদের জন্য নির্ধারিত নিবাসে অবস্থান নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন বিশ্ব ইজতেমার মিডিয়া সমন্বয়কারী হাজি মো. মনির হোসেন ও মো. সায়েম। তবে পাশ্ববর্তী দেশ ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও কাশ্মির থেকে সর্বোচ্চ সংখ্যক মুসল্লি ময়দানে অবস্থান নিয়েছেন বলে জানা গেছে। ভারতের নাগরিকত্ব বিলের কারণে ভিসা জটিলতায় অনেক চিল্লাধারী ইজতেমার সাথী বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারছেন না বলেও জানান তারা।
দেশি-বিদেশি ইসলামি চিন্তাবিদ ও ওলামায়ে কেরামগণ ছয় উসুল যথা-ঈমান, নামাজ, এলেম ও জিকির, একরামুল মুসলিমীন, তাসহীহে নিয়ত, দাওয়াত ও তাবলিগ সম্পর্কে বিভিন্ন দিক-নির্দেশনামূলক মূল্যবান বয়ান রাখবেন। মূল বয়ান সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ভাষায় তরজমা করা হবে।
বৃহস্পতিবার ময়দানে বয়ান করলেন যাঁরা : ইজতেমা ময়দানে বৃহস্পতিবার বাদ যোহর সমবেত মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে ইস্তেকবালি (স্বাগত) বয়ান করেন ভারতের মাওলানা ইকবাল হাফিজ। তাঁর বয়ান বাংলায় তরজমা করেন বাংলাদেশের মাওলানা মুনির বিন ইউসুফ। ইজতেমার আনুষ্ঠানিক বয়ান শুক্রবার বাদ ফজর থেকে শুরু হলেও বৃহস্পতিবার বাদ আসর থেকেই বয়ান শুরু করেন শীর্ষ মুরুব্বিরা। বাদ আসর বয়ান করেন তাবলিগ জামাতের বাংলাদেশের শূরা সদস্য সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম। বাদ মাগরিব বয়ান করেন দিল্লি নিজামুদ্দিন মারকাযের মাওলানা শামীম আজমী। তাঁর বয়ান বাংলায় তরজমা করেন স্বাগতিক বাংলাদেশের মাওলানা জিয়া বিন কাসিম।
দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমায় বাংলাদেশের শীর্ষ মুরুব্বিদের অবস্থান : দ্বিতীয় পর্বের বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে অবস্থান নিয়েছে বেশ কয়েকজন শীর্ষ মুরুব্বি। তারা হলেন-মাওলানা সা’দ আহমদ কান্ধলভীপন্থী বিশ্ব ইজতেমা বাংলাদেশের শূরা সদস্য সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম, প্রকৌশলী খান মো. শাহাবুদ্দিন নাসিম, মাওলানা মোজাম্মেল হক, মাওলানা মোশারফ হোসেন, প্রফেসর ইউনুস শিকদার, মাওলানা আশরাফ আলী, মাওলানা আবদুল্লাহ মনছুর প্রমুখ।
দিল্লির নিজামুদ্দিন মারকাযের ৩২ সদস্যবিশিষ্ট জামাত ময়দানে : ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বে মাওলানা সা’দ আহমদ কান্ধলভী মনোনীত দিল্লির নিজামুদ্দিন মারকাযের ৩২ সদস্যবিশিষ্ট একটি জামাত বুধবার বাদ মাগরিব টঙ্গী ইজতেমা ময়দানে এসে পৌঁছেছেন। এ জামাতের নেতৃত্বে রয়েছেন দিল্লির নিজামুদ্দিন মারকাযের শূরা সদস্য মাওলানা আবদুস সাত্তার। জামাতের অপর সদস্যরা হলেন- মাওলানা শামীম আজমী, মাওলানা জামশেদ, মাওলানা মিয়াজী আজমত উল্লাহ, মাওলানা মুফতি শেহজাদ, মাওলানা রিয়াজুর রহমান, মাওলানা ইকবাল হাফিজ প্রমুখ।
ইজতেমা ময়দানে আসার পথে ট্রেনের ধাক্কা ও হৃদরোগে দুই মুসল্লির মৃত্যু : গত বুধবার রাতে টঙ্গী রেলওয়ে জংশনে ট্রেনের ধাক্কায় মো. গোলজার হোসেন (৪০) নামে এক মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে। নিহত গোলজার গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি থানার টেংরাকান্দি গ্রামের বাসিন্দা বলে জানা গেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, টঙ্গী বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বে অংশ নিতে গোলজার ও তার সাথীরা গাইবান্ধা থেকে ট্রেনে করে এসে টঙ্গী জংশনে নেমে মালামাল গোছানোর কাজ করছিলো। এ সময় পেছন দিক থেকে একটি ট্রেন গোলজারকে মাথায় সজোরে ধাক্কা দিলে সে পাশের রেললাইনে ছিটকে পড়ে গুরুতর আহত হয়। পরে ঘটনাস্থলে উপস্থিত তার সাথীরা তাকে উদ্ধার করে শহিদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। অপর দিকে ইজতেমা ময়দানে সুনামগঞ্জ জেলার আনছার আলী (৬৫) নামে এক মুসল্লির হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। তবে তার পূর্ণ ঠিকানা পাওয়া যায়নি।
ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বেও আইনশৃংখলা জোরদার : দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমা উপলক্ষে টঙ্গীতে আইনশৃংখলা জোরদার করা হয়েছে। ইজতেমা মাঠের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে প্রায় ৮ হাজার পুলিশসহ র্যাব, সাদা পোশাকধারী বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের মোতায়েন করা হয়েছে। নিরাপত্তা জোরদার করতে র্যাবের কমিউনিকেশন উইং, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে ২০টি প্রবেশপথসহ চারপাশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে তিন শতাধিক ক্লোজসার্কিট ক্যামেরা বসানো হয়েছে। এছাড়াও রয়েছে মেটাল ডিটেক্টর, নাইটভিশন গগল্স, বাইনোকুলার, বোম্ব ডিসপোজাল টিম, এন্টিটেরোরিজম ইউনিট, হেলিকপ্টার-নৌ টহল ও স্টাইকিং ফোর্স। বিশেষ প্রয়োজনে হেলিকপ্টার উঠানামার জন্য বাটা গেট ও জেরিনা গার্মেন্ট কারখানায় দুটি হেলিপ্যাড প্রস্তুত রাখা হয়েছে। নিরাপত্তার স্বার্থে বিভিন্ন স্থানে বসানো র্যাবের ১০টি ও পুলিশের ১৪টি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার থেকে পর্যবেক্ষক দল সার্বক্ষণিক বিশ্ব ইজতেমা ময়দানের পর্যবেক্ষণ করবেন।
মাসলেহাল জামাত : ইজতেমা ময়দানে আগত মুসল্লিদের নতুন যেকোনো সমস্যা সমাধানকল্পে ময়দানের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে আশরাফ সেতুর পেছনে মাসলেহাল জামাতের কামরা তৈরি করা হয়েছে। সেখানে বসে ওই জামাতের মুরুব্বিরা উদ্বুত সমস্যার সমাধান দিচ্ছেন।
বিদেশী মুসল্লিদের অংশগ্রহণ: ইথিওপিয়া, ভারত, কানাডা, কম্বোডিয়া, ক্যামোরস, ইন্দোনেশিয়া, কেনিয়া, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, নাইজেরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, চীন, অস্ট্রেলিয়া, কাজাখাস্তান, মালয়েশিয়া, আমেরিকা, স্পেন, সৌদিআরবসহ বিশ্বের অর্ধশতাধিক দেশের প্রায় ৩ হাজার ১৯ জন বিদেশি মেহমান বৃহস্পতিবার বিকেলে পর্যন্ত ইজতেমা ময়দানে উপস্থিত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন ইজতেমা ময়দানের গণমাধ্যম সমন্বয়কারি হাজি মনির হোসেন ও মো. সায়েম। এপর্বের ইজতেমায় ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও কাশ্মির থেকে অধিক সংখ্যক মেহমান ময়দানে এসেছে বলে জানা গেছে। বিভিন্ন মহাদেশ ও ভাষাভাষী অনুসারে ইজতেমা ময়দানে বিদেশি মেহমানরা ভিন্নভিন্ন তাবুতে অবস্থান করছেন। সেখানে তাদের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
ময়দানের ভেতরে হকারদের উৎপাত : প্রতিবছর ইজতেমা ময়দান থেকে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে হকাররা তাদের বিভিন্ন মালামালের পসরা সাজিয়ে বসতো। কিন্তু এবছর খোদ ময়দানের ভেতরেই বিশেষ করে ৭, ৮ ও ৯নং গেটে তাদেরকে টুপি, বিভিন্ন বই, সিঙ্গার-সমুচা, পিঠা, আতর-তাসবিহ ও মেছওয়াকসহ নানা ধরনের পণ্যের দোকান সাজিয়ে বেচাকেনা করতে দেখা গেছে। এতে ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের যাতায়াতে বেশ কষ্ট হচ্ছে।
হারানো প্রাপ্তি বিষয়ক আহ্বান : বৃহস্পতিবার বাদ ফজর বয়ান শেষে সমবেত মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে হারানো ও প্রাপ্তি বিষয়ক এক এলান (আহ্বান) জানানো হয়। এতে বলা হয় ময়দানের কোথাও কোনো কিছু পাওয়া গেলে এবং কোনো বয়োবৃদ্ধ মুসল্লি পথ হারিয়ে ফেললে তাদেরকে ময়দানের পশ্চিমপাশে স্থাপিত হারানো ও প্রাপ্তির কন্ট্রোলরুমে জমা দিতে বলা হয়েছে। এছাড়াও কেউ কিছু হারিয়ে থাকলেও অনূরুপ হারানো ও প্রাপ্তির কন্ট্রোলরুমে গিয়ে উপযুক্ত প্রমাণ দিয়ে নিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে।
এব্যাপারে ইজতেমা ময়দানের জিম্মাদার প্রকৌশলী শাহ মো. মুহিবুল্লাহ বলেন, ইতোমধ্যে ময়দানের শতভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। দেশ-বিদেশের কয়েক লাখ ধর্মপ্রাণ মেহমান ময়দানে নির্ধারিত খিত্তায় অবস্থান নিয়ে ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল রয়েছেন। আগামি রোববার আখেরি মোনাজাতের মধ্যদিয়ে বিশ্ব ইজতেমা শেষ হবে। ইনশাআল্লাহ।