গত বছরের ২০ জুন পটুয়াখালীর কলাপাড়ার ১৮৯ জন নদী দখলদারের তালিকা পটুয়াখালী জেলা প্রশাসক ও জেলা নদী কমিটির সভাপতি বরাবর প্রেরণ করেছেন কলাপাড়া উপজেলা সহকারী কমিশনার(ভূমি) অনুপ দাশ। কিন্তু ছয় মাসেও এই নদী দস্যুদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোন অভিযান কিংবা নদী উদ্ধারে নেয়া হয়নি কোন পদক্ষেপ। এ কারণে সারাদেশে নদী উদ্ধারে অভিযান চললেও কলাপাড়ার প্রধান নদীগুলো দখল চলছে প্রকাশ্যে। নির্মাণ হচ্ছে পাকা, আধাপাকা স্থাপনা। এমনকি যে স্থাপনাগুলো ভেঙ্গে দেয়া হয়েছিলো প্রশাসনের অগোচরে আবার একই স্থানে নির্মিত হয়েছে স্থাপনা। এমনকি নদীর প্রবাহমান পানির মধ্যে পাইলিং করে নির্মাণ হচ্ছে স্থাপনা। এ চিত্র গোটা কলাপাড়ার।
“আন্ধারমানিক”মানে অন্ধকারে মুক্ত-মানিকের ভান্ডার। এমন নামের যথার্থতা রয়েছে কলাপাড়ার আন্ধারমানিক নদীটি ঘিরে। বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে সংযোগ থাকায় সকল প্রজাতির মাছের সঙ্গে ইলিশের অভয়াশ্রম হিসেবে পরিচিত ছিলো এই নদীটি। কিন্তু গত এক যুগে নদীর দুই তীর দখল,দূষন, ভরাট আর ডুবোচরের কারনে অস্তিত্ব সংঙ্কটে পড়েছে। যে নদীতে একসময় ষ্টিমার, জাহাজ চলাচল করতো,এখন সেই নদীর কোথাও কোথাও ভাটার সময় বাঁশ ও লগি দিয়ে খেয়া নৌকা পার হতে হয়। এ নদীর দুই কিলোমিটারের মধ্যে তিনটি সেতু নির্মাণ হওয়ায় পলির স্তর জমা হয়ে একদিকে জেগে উঠেছে বিশাল চর, অণ্যদিকে ভাঙ্গনের তীব্রতার সাথে বিলীন হয়েছে বনাঞ্চল। সেই সাথে নদীর কলাপাড়া পৌর শহরের লঞ্চঘাট থেকে শুরু করে বালিয়াতলী খেয়াঘাট পর্যন্ত ময়লা ফেলে ভরাটের সাথে একেরপরএক স্থাপনা নির্মাণ করায় নদীর প্রবাহ বাধাঁগ্রস্থ্য হচ্ছে। এ কারনে নদীর তীরে শ্যাওলা ও পলি জমে জমে ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে প্রবাহমান এই নদীটি। এ কারনে এক সময়ে যেখানে নদীর স্রোত ছিলো সেখানে গড়ে উঠেছে বসতি। নির্মান হয়েছে পাকা রাস্তা।
এক যুগ আগেও প্রমত্তা নদী হিসেবে পরিচিতি ছিলো আন্ধারমানিক নদীটি। পটুয়াখালী জেলা ও বরগুনা জেলায় অবস্থিত এ নদীটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৪০ কিলোমিটার ও প্রস্থ্য ছিলো প্রায় ৫০০ মিটার। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক আন্ধারমানিক নদীর প্রদত্ত পরিচিতি নম্বর দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের নদী নং ৪ । এটা গঙ্গা পদ্মা সিস্টেমে অবস্থিত উপকূলের অন্যতম বৃহৎ নদী। এ চিত্র কাগজে কলমে। বাস্তবে নদীটি কোথাও কোথাও খালে পরিনত হয়েছে। একই অবস্থা টিয়াখালী দোন নদী, শিববাড়িয়া নদীর।
আন্ধারমানিক নদীটি কলাপাড়া উপজেলার মিঠাগঞ্জ ইউনিয়নে প্রবাহমান টিয়াখালী নদী থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। নদীর জলধারা নীলগঞ্জ ও খাপড়াভাঙ্গা ইউনিয়ন হয়ে বরগুনা জেলার আমতলী উপজেলার বড়বগী পর্যন্ত প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। এ কারনে নদীর পানির প্রবাহ ছিলো গতিময় ও তীব্র ছিলো। কিন্তু দখল ও দূষণে নদিিট এখন নাব্যতা সংকটে পড়েছে। ৪০ কিলোমিটার নদীর বিভিন্ন মোহনায় প্রায় ২৫ কিলোমিটার এলাকায় চর জেগে ওঠায় মরা খালে পরিনত হয়েছে।
স্থানীয়দের মতে, ১৯৬০ এর দশকে স্থানীয় সরকার আন্ধারমানিক নদীর উপর অনেক বাঁধ নির্মান করার পর থেকে নদীর নাব্যতা কমতে শুরু করে। একই সাথে একই নদীর উপর তিনটি সেতু নির্মান করায় নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে এখন শুকনো মেীসুমে ভাটার সময় কোমড় পানির প্রবাহ থাকায় লঞ্চ,জাহাজ ও মালবাহী কার্গো চলাচলে বাঁধার সম্মুখীন হচ্ছে।
এ নদীর রামনাবাদ মোহনায় এখন পায়রা সমুদ্র বন্দরের উন্নয়ন কর্মকান্ড চলছে। কিন্তু নাব্যতা সংকট থাকায় মাদার ভ্যাসেল এ নদী পথে চলাচল অসম্ভব হয়ে পড়ছে চর জেগে ওঠায়। এছাড়া নদীর তীরে চলছে একাধিক ইটভাটা নির্মান এবং অব্যাহত দখল ও দূষন। এ কারণে ইলিশের অভয়াশ্রম আন্ধারমানিক নদীর মোহনায় চর জেগে ওঠায় পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্থ হওয়ায় এখন ইলিশের প্রজনন মেীসুমেও ইলিশ ধরা পড়ছে না।
কলাপাড়া ভূমি অফিস থেকে আন্ধারমানিক নদী দখলদারসহ উপজেলার ১৮৯ জন নদী দখলদারের তালিকা জেলা প্রশাসন বরাবর প্রেরণ করেছে। কিন্তু সারা দেশে নদী দখল উচ্ছেদ অভিযাপন চললেও কলাপাড়ার নদী দখলদাররা রয়ে গেছে বহাল তবিয়তে।
স্থানীয়রা জানান, একসময় এ নদীতে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত। নদীতে জাল ফেললে অনেক সময় জাল কেটে উঠাতে হতো মাছের কারনে। এখন সেই নদীতে দুই/একটি চিংড়ি ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায়না।
যে নদীর স্রোত শুকনো মেীসুমেও ছিলো ভয়াল সেই নদীতে এখন ভরা জোয়ারেও লঞ্চ,কার্গো চলাচল করতে পারছে না। এমনকি লঞ্চ ভিরতে পারে না লঞ্চ ঘাটে। ভাটার সময় নদীর চর জেগে ওঠায় খেয়া নৌকা পর্যন্ত বাঁশ দিয়ে ঠেলে ঠেলে এগুতে হয়। যে নদীতে এক পার থেকে অন্য পার ধূ ধূ দেখা যেতো, চর জেগে ওঠার কারনে নদীর নাচনাপাড়া পয়েন্ট থেকে এখন ঁেহটে পার হতে পারছে মানুষ।
স্থানীয়দের অভিযোগ এক নদীর মধ্যে নির্র্মিত হয়েছে তিনটি সেতু। কিন্তু নদীর নাব্যতা বৃদ্ধিতে ড্রেজিং না করায় ক্রমশ নদীটি ভরাট হচ্ছে। নদী ভরাট হওয়ার সাথে সাথে দক্ষিণ তীরে জেগে উঠেছে মাইলের পর মাইল এলাকা জুড়ে চর। আর উত্তর পার দখল করে নির্মিত হচ্ছে কাঁচা পাকা স্থাপনা।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন(বাপা) কলাপাড়া শাখার সদস্য মেজবাহউদ্দিন মাননু বলেন, নদীর নাব্যতা বাড়াতে দ্রুত নদীটি ক্ষণন করা দরকার। সেই সাথে নদী তীর দখলমুক্ত করতে প্রশাসনের দ্রুত উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা উচিত।
কলাপাড়া উপজেলা সহকারি কমিশনার(ভূমি) অনুপ দাশ বলেন, আন্ধারমানিক নদীসহ কলাপাড়ার নদী দখলকারী ১৮৯ জনের তালিকা জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠানো হয়েছে। জেলা প্রশাসনের অনুমোদন পেলেই এ দখলদারদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হবে।
কলাপাড়া উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মনোজ কুমার সাহা বলেন, আন্ধারমানিক নদীটি ইলিশের অভয়াশ্রম। কিন্তু এ নদীতে এখন কোন মাছই পাওয়া যায় না শুধু দখল ও দূষণের কারনে। এ ইলিশের অভয়াশ্রম রক্ষায় জরুরী ভিত্তিতে নদী খননসহ দখলদারদের উচ্ছেদ করা প্রয়োজন।
কলাপাড়ায় সাংবাদিকদের সাথে এক মতবিনিময়সভায় জাতীয় নদী রক্ষা কশিশনের চেয়ারম্যান ডঃ মুজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, নদীর জায়গা কেউ দখল করতে পারে না এমনকি নদী দখল করে কোন উন্নয়ন কর্মকান্ড করা নিষিদ্ধ। সরকার চাইলে যেকোন সময় নদীর জায়গা দখল করে যেসব অবৈধ স্থাপনা নির্মান করেছে তা বাতিল করতে পারে।