অনুকুল আবহাওয়া ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে তাবলিগ জামাতের শীর্ষ মুরব্বিদের গুরুত্বপূর্ণ বয়ান ও মুসল্লিদের নফল নামাজ, তাসবিহ-তাহলিল, জিকির-আসগারের মধ্যদিয়ে আজ শনিবার বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় দিন অতিবাহিত হয়েছে। রোববার পূর্বাহ্নে অর্থাৎ বেলা সাড়ে ১১টা থেকে ১২টার মধ্যে আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে এবারের ৫৫তম বিশ্ব ইজতেমা শেষ হচ্ছে বলে জানিয়েছে বিশ্ব ইজতেমার আয়োজক কমিটির শীর্ষ মুরুব্বি প্রকৌশলী শাহ মো. মুহিবুল্লাহ। তাবলীগের ৬ উসূলের (মৌলিক বিষয়ে) উপর বাদ ফজর ভারতের মাওলানা মুরসালিনের বয়ানের মধ্যদিয়ে দ্বিতীয় দিনের বয়ান শুরু হয়, তাঁর বয়ান বঙ্গানুবাদ করেন মাওলানা মুফতি আজিম উদ্দিন। বাদ যোহর বয়ান করেন ভারতের মাওলানা মুফতি রিয়াসত, তাঁর বয়ান বাংলায় অনুবাদ করেন মাওলানা আব্দুল্লাহ মনসুর। বাদ আসর বয়ান করেন বাংলাদেশের মাওলানা মোশাররফ হোসেন। বাদ মাগরিব বয়ান করেন মাওলানা জামশেদ, তাঁর বয়ান বাংলায় ভাষান্তর করেন বাংলাদেশের মাওলানা মুনির বিন ইউসুফ। ইজতেমার প্রথমপর্বের মতো দ্বিতীয় পর্বেও ৭ জোড়া যৌতুকবিহীন বিয়ে পড়ানো হয়েছে। বিয়ে পড়ান ভারতের মাওলানা শামীম আজমী। তবে তা বয়ানের মঞ্চে না পড়িয়ে বিদেশি মুসল্লিদের তাঁবুতে পড়ানো হয়। বহুল কাঙ্খিত আজকের আখেরি মোনাজাত দিল্লি মারকাযের মুরুব্বি মাওলানা জামশেদ পরিচালনা করার কথা রয়েছে।
মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে বয়ান : বাদ ফজর ভারতের মাওলানা মুরসালিন ইমান, আমল, জাহান্নাম, জান্নাত ও দাওয়াতে মেহনতের উপর গুরুত্বপূর্ণ বয়ান রাখেন। তিনি বলেন, নবি করিম (স.) এর কাছে ফেরেশতা জিব্রাইল (আ.) আসতেন এবং নবি করিমকে (স.) সবকিছু শিখাতেন। পরে নবি করিম (স.) সবকিছু সাহাবায়ে কেরামদের শিখাতেন। সাহাবায়ে কেরামগণ তা শিক্ষা করে যার যার ঘরে ফিরে তাঁদের স্ত্রী-সন্তানদের শিক্ষা দিতেন। তিনি আরও বলেন, ভাই-দোস্ত বুজুর্গ আমাদের বর্তমান সমাজে অনেক কিতাব আছে, কিতাবের বড় বড় লাইব্রেরি আছে। তবে আমাদের মাঝে দ্বীনের মেহনত নাই। কিন্তু সাহাবায়ে কেরাম আজমাইনদের সময় কিতাব ছিল না, তারা লেখাপড়া জানতেন না। কিন্তু তাদের মধ্যে দ্বীনের মেহনত ছিল। তাঁরা দাওয়াতে মেহনতের মাধ্যমে দ্বীন জিন্দা করেছেন। তাদের দাওয়াতের মাধ্যমেই সারা দুনিয়ায় দ্বীন বাস্তবায়ন হয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের টঙ্গী ইজতেমায় দেশ-বিদেশের যত মুসল্লি হাজির হয়েছেন তাদের প্রত্যেককে নিয়ত করতে হবে যে, আমরা নিয়মিত ( মাসে একবার তিনদিনের চিল্লায় যাওয়া, সপ্তাহে দুইদিন এলাকায় গাস্ত করা, প্রতিদিন নিজ এলাকার মসজিদে তালিম করা, মাশোয়ারা করা এবং প্রতিদিন মসজিদ আবাদের মেহনত করা) পাঁচ কাজের মধ্যে নিয়োজিত রাখবো। পাঁচ কাজের আমল করলে আমাদের জীবন সুন্দর ও সুখময় হবে। পাঁচ কাজের পাবন্দির মাধ্যমে আমাদের জীবনে পরিবর্তন আসবে।
তিনি আরও বলেন, পাঁচ কাজের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো-আমাদের প্রত্যেকের এলাকার মসজিদগুলোকে আবাদ করা। নামাজ-কালাম, জিকির-আসকারের মাধ্যমে মসজিদকে আবাদ করতে হবে।
তিনি বলেন, নবি করিম (স.)এর দেখানো পথে আমল করতে হবে তাহলেই কামিয়াবী পাওয়া যাবে। তিনি আরও বলেন, সব কাজের আগে বিসমিল্লাহ বলা অনেক ফজিলত। যে ব্যক্তি বিসমিল্লাহ বলে খানা খায়, বিছানায় ঘুমাতে যায়, ঘর থেকে বের হয় এবং বিসমিল্লাহ বলে যে কাজই করুক শয়তান তার সাথে শরীক হতে পারে না। তাই বিসমিল্লাহর সাথে আমল করার জন্য সবাইকে প্রস্তুত থাকতে হবে। তিনি বলেন, ভাই-বুযুর্গ ও দোস্ত, নবীর তরিকার উপর শয়তান কোনো দখল নিতে পারে না। এজন্য নবীর তরিকা ছাড়া রক্ষার কোনো রাস্তা নাই, নাজাতের কোনো পথ নাই। কারন, আল্লাহতায়ালা নবি করিম (স.) এর সুন্নত অনুযায়ী চলা ব্যক্তিদেরকেই পছন্দ করেন। এ ব্যাপারে একটি হাদিস উচ্চারণ করে তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, মুহাম্মদ (স.) এর তরিকার বিপরীতে যে চলবে তার জন্য ধ্বংস, তার জন্য বরবাদি।
বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সদস্যরা ময়দানে : শনিবার দুপুরে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সদস্য মুশফিকুর রহিমের নেতৃত্বে একদল ক্রিকেট খেলোয়াড় ইজতেমা ময়দানে এসেছেন। তারা ময়দানের ১নং বিল্ডিংয়ের ভিআইপি কামরায় অবস্থান করছেন। তার সাথে আরও রয়েছেন ক্রিকেটার শাহরিয়ার নাফিস, জুনায়েদ সিদ্দিকী, রাকিবুল হাসান ও সোহান। তারা ময়দানে বাংলাদেশ তাবলিগ জামাতের শূরা সদস্য সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলামের সাথে সাক্ষাত করেন। এ সময় সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম মুশফিকুর রহিমসহ তার সাথে আগত মেহমানদের দীর্ঘমেয়াদি চিল্লায় আল্লাহর রাস্তায় বের হওয়ার জন্য তাশকিল করেন। আজ আখেরি মোনাজাত শেষে তারা ময়দান ত্যাগ করবেন বলে জানা গেছে।
নিরাপত্তা ও যান চলাচল : আখেরি মোনাজাত উপলক্ষে টঙ্গী ও আশপাশ এলাকায় পুলিশের পক্ষ থেকে যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মো. আনোয়ার হোসেন জানান, শনিবার মধ্যরাত থেকে রোববার বিকেল পর্যন্ত ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের চান্দনা চৌরাস্তা থেকে টঙ্গী পর্যন্ত, টঙ্গী-কালীগঞ্জ সড়কের মিরেরবাজার থেকে স্টেশন রোড পর্যন্ত, কামারপাড়া থেকে আশুলিয়া পর্যন্ত এবং বিমানবন্দর থেকে টঙ্গী ব্রিজ পর্যন্ত সব ধরনের যান চলাচল নিয়ন্ত্রণে থাকবে। তিনি বলেন, ইজতেমা ময়দানসহ আশপাশ এলাকা কড়া নিরাপত্তার মধ্যে রয়েছে। সামিয়ানার ভেতরে ও বাইরে মুসল্লি বেশে রয়েছে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সহ¯্রাধিক সদস্য।
আখেরি মোনাজাত উপলক্ষে বিশেষ ট্রেন : টঙ্গী রেলওয়ে জংশনের স্টেশন মাস্টার মো. হালিমুজ্জামান জানান, দ্বিতীয় পর্বের আখেরি মোনাজাত উপলক্ষে আখাউড়া, কুমিল্লা ও ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন রুটে বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করেছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। মোনাজাতের আগে ও পরে সব ট্রেন টঙ্গী স্টেশনে ৫মিনিট যাত্রা বিরতি করবে। ইজতেমায় আগত যাত্রীদের কথা বিবেচনায় রেখে টঙ্গী রেলওয়ে জংশনে অতিরিক্ত টয়লেট ও বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে বলেও তিনি জানান।
ইজতেমা ময়দানে আরও চার মুসল্লির মৃত্যু : টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে আরও চার মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে। শুক্রবার রাত ও গতকাল শনিবার ভোরে বার্ধক্যজনিত কারণ ও হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তাদের মৃত্যু হয়। তারা হলেন- রংপুর জেলার পীরগঞ্জ থানার উসমানপুর গ্রামের মৃত. হাজি জয়নাল উদ্দিনের ছেলে হুমায়ুন কবির (৬৫), ঝিনাইদহ সদর উপজেলার কালাহাট গোপালপুর গ্রামের আফম জহুরুল আলম (৬২), ঢাকার উত্তরা পশ্চিম থানার নলভোগ এলাকার ফজলু মিয়ার ছেলে ইলিয়াস মিয়া (৮৫) ও গাইবান্দা জেলার সাঘাটা থানার কামালেরপাড়া গ্রামের আলহাজ মো. আবুল কাশেমের ছেলে আলহাজ মো.আব্দুস সোবহান (৮০)। ময়দানের জিম্মাদার রফিকুল ইসলাম এতথ্য জানান। এনিয়ে ময়দানে ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বে সাতজন মুসল্লির মৃত্যু হলো।
তাশকিল কামরা : ময়দানের উত্তর-পশ্চিম কোণে করা হয়েছে তাশকিলের কামরা। ময়দানের খিত্তাগুলো থেকে চিল্লায় নাম লেখানো ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের জামাতবন্দী করে তাশকিলের কামরায় জায়গা করে দেওয়া হচ্ছে। আখেরি মোনাজাত শেষে এসব মুসল্লিরা ঢাকার কাকরাইল মসজিদে গিয়ে রিপোর্ট করে তাবলীগের মুরুব্বিদের দিক-নির্দেশনা অনুযায়ী জামাতবন্দী হয়ে দ্বীনের দাওয়াতি মেহনতে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়বেন। এসব জামাতবন্দিদের মধ্যে ৪০দিন, ৩ মাস, ৬ মাস, ১ বছর ও আজীবন চিল্লাধারি মুসল্লিরা রয়েছেন। তারা বর্হিবিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা শহর এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে দাওয়াতি কাজ করবেন।
আয়োজক কমিটির বক্তব্য : ইজতেমা আয়োজক কমিটির জিম্মাদার প্রকৌশলী শাহ মো. মুহিবুল্লাহ বলেন, ময়দানে আইনশৃংলা বজায় থাকায় পরিচ্ছন্নভাবে বিশ্ব ইজতেমা পালিত হচ্ছে। ময়দানে আগত দেশ-বিদেশের মুসল্লিরা স্বাচ্ছন্দে ইবাদত-বন্দেগি করছেন। ইনশাআল্লাহ, রোববার বেলা সাড়ে ১১টা থেকে ১২টার মধ্যে আখেরি মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে।