চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনের কাছে সরকারি এশাধিক ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছে। ওই ঋণ ফেরত পাওয়া নিয়ে শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। গত জুন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির কাছে ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা। তার মধ্যে সোনালী ব্যাংকেরই পাওনা পরিমাণ ৪ হাজার ২৪৫ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটিকে দেয়া বেশির ভাগ ঋণেরই বর্তমানে সরকারি কোনো গ্যারান্টি নেই। বরং ব্যাংক কম্পানি আইন ভঙ্গ করেই চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনকে বড় অঙ্কের ঋণ দেয়া হয়েছে। এমনকি সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো অনুমোদনও নেয়া হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন ও সরকারি গ্যারান্টি ছাড়া প্রতিষ্ঠানটিকে বিপুল অঙ্কের ঋণ দেয়ায় সোনালী ব্যাংকের ব্যাখ্যা তলবের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেজন্য ব্যাখ্যা তলব করা হবে বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের কাছে সরকারি সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের পাওনার পরিমাণ ৬ হাজার ৯৮১ কোটি টাকা। তার মধ্যে ২০১৯ সালে নতুন অনুমোদিত ৫১৩ কোটি টাকাসহ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের কাছে সোনালী ব্যাংকেরই পাওনা চার হাজার ২৪৫ কোটি ৫৪ লাখ টাকা, যা ব্যাংকটির মূলধনের ৯০ শতাংশ। তাছাড়া ঋণের বিপরীতে জনতা ও অগ্রণী ব্যাংকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের গ্যারান্টির মেয়াদ ইতিমধ্যে উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। তবে সোনালী ও রূপালী ব্যাংকের ঋণের বিপরীতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের গ্যারান্টি গ্রহণের শর্ত থাকলেও মন্ত্রণালয় কর্তৃক কোনো গ্যারান্টি প্রদান করা হয়নি। ওই বিপুল পরিমাণ ঋণের বিপরীতে অর্থ মন্ত্রণালয় কর্তৃক গ্যারান্টি প্রদান করা না হলে সোনালী ব্যাংকে আর্থিক বিপর্যয় সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। সূত্র জানায়, ব্যাংক কম্পানি আইন অনুযায়ী কোনো একক গ্রহীতার অনুকূলে একটি ব্যাংক তার মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি ঋণ দিতে পারবে না। কিন্তু জুন পর্যন্ত হিসাবে চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনে সোনালী ব্যাংকের মূলধনের ৯০ শতাংশের বেশি ঋণ কেন্দ্রীভূত হয়। আর নভেম্বর পর্যন্ত হিসাবে তা ১০৬ শতাংশ ছাড়িয়েছে। একক ঋণগ্রহীতার অনুকূলে এতো পরিমাণ ঋণ দিয়ে ব্যাংকটি ঝুঁকিতে রয়েছে। তাছাড়া বিএইচএফসির কাছে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের ১১০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ রয়েছে। তারপরও সম্প্রতি আরো ৩০০ কোটি টাকার ঋণ মঞ্জুর করা হয়েছে। আর বিএইচএফসির কাছে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের সুদসহ ৬২৫ কোটি টাকার বেশি পাওনা রয়েছে। কিছুদিন আগে ওই টাকা ব্যাংকটি ফেরত চাইতে গেলে সঙ্কটের কথা বলে প্রতিষ্ঠানটি উল্টো আরো ৫০০ কোটি টাকার ঋণ চেয়ে বসে। আর বিএইচএফসির কাছে রূপালী ব্যাংকের পাওনা রয়েছে ৫৮০ কোটি টাকা।
সূত্র আরো জানায়, বর্তমানে চরম আর্থিক সংকটে রয়েছে বিএইচএফসি। নিজেদের সংকটের কথা তুলে ধরে কয়েক দফা শিল্প মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠিও পাঠিয়েছে বিএইচএফসি। তাতে উল্লেখ করা হয়, করপোরেশনে দীর্ঘদিন চরম আর্থিক সংকট বিরাজ করায় চিনিশিল্প প্রায় ধ্বংসের মুখে। এদিকে ঋণের টাকা প্রসঙ্গে সোনালী ব্যাংকের এমডি আতাউর রহমান জানান, চিনিশিল্প করপোরেশনকে ঋণ হিসেবে অর্থ দেয়া হয়েছে। বড় অ্যামাউন্ট হলেও যেহেতু সরকারি একটি প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়া হয়েছে, তাই আশা করা যায় ওই টাকা ফেরত পাওয়া যাবে। কিছু ঋণের সরকারি গ্যারান্টি থাকলেও তার মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে। অন্যগুলোতে করপোরেশনের গ্যারান্টি আছে। তবে যেগুলোর সরকারি গ্যারান্টির মেয়াদ শেষ হয়েছে, সেগুলো রিনিউ করার আবেদন করা হয়েছে। আশা করা যায় সরকারের গ্যারান্টিও পাওয়া যাবে। একই প্রসঙ্গে জনতা ব্যাংকের এমডি মো. আবদুছ ছালাম আজাদ জানান, জনতা ব্যাংক ৩০০ কোটি টাকার ঋণ মঞ্জুর করেছে। তবে এখানে শর্ত দেয়া হয়েছে, সরকারের গ্যারান্টি পেলেই ওই অর্থ ছাড় করা হবে। তাছাড়া করপোরেশনের আগের ঋণগুলো নবায়ন করা হয়েছে। অগ্রণী ব্যাংকের এমডি মোহম্মদ শামস-উল ইসলাম জানান, বিভিন্ন সমস্যার কারণে টাকা ফেরত দিতে পারছে না চিনিশিল্প করপোরেশন। আবার ওসব ঋণের সরকারি গ্যারান্টিও আনতে পারছে না করপোরেশন। গ্যারান্টি না পেলে ব্যাংকগুলো ওই ঋণখেলাপি করে ফেলবে। তখন প্রতিষ্ঠানটি নতুন কোনো ঋণ পাবে না। অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে বিএইচএফসির চেয়ারম্যান অজিত কুমার পাল জানান, কর্পোরেশনের প্রতি কেজি চিনির উৎপাদন খরচ ৬০ টাকা। বিপরীতে বাজারে চিনি বিক্রি করা হয় ৫০ টাকায়। ফলে প্রতি কেজি চিনিতে লোকসান তথা ট্রেডগ্যাপ ১০ টাকা। চিনির উৎপাদন মূল্য ও বিক্রয় মূল্যের পার্থক্য ভর্তুকি হিসেবে সরকারের দেয়ার কথা। ২০১২ সাল পর্যন্ত ট্রেডগ্যাপ হিসেবে সরকারের কাছে কর্পোরেশনের পাওনা ছিল ১৭০০ কোটি টাকা। তার মধ্যে বিভিন্ন সময়ে ৪৩০ কোটি টাকা পাওয়া গেছে। বাকি রয়েছে আরো ১২৭০ কোটি টাকা। আর ২০১২ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত আরো ১২০০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। সব মিলে ট্রেডগ্যাপ পাওনা আড়াই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। ওই অর্থ পেতে প্রচুর চেষ্টা করা হলেও এখনো পাওনা টাকা পাওয়া যায়নি।