সরকারের বিশেষ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বেশিরভাগ মেগা প্রকল্পের অগ্রগতিই গতিহীন। একমাত্র পদ্মা সেতুর অগ্রগতি সন্তোষজনক। আর্থসামাজিক উন্নয়ন, বিশেষ করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতেই ১০টি মেগা প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। মূলত স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছর ২০২১ সালের মধ্যে দেশকে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে ওঠার লক্ষ্য সামনে রেখেই ওসব প্রকল্প গস্খহণ করা হয়। আর জাতীয় গুরুত্ব বিবেচনায় ওসব প্রকল্প বাস্তবায়নে বিশেষ নজর দিতে ফাস্ট ট্র্যাক-এ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু জাতীয় অতি গুরুত্বপূর্ণ বিশাল ওসব প্রকল্পে যে ধরনের গতি থাকা প্রয়োজন, কার্যত তা নেই। এমন পরিস্থিতিতে নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে, অসম্পূর্ণ কাজ সম্পন্ন করতে বাস্তবসম্মত সময়ভিত্তিক একটি কর্মপরিকল্পনা করার সুপারিশ করেছে আইএমইডি। তাছাড়া মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে বলা হয়েছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, মূল্যায়ন ও পরিবীক্ষণ বিভাগ (আইএমইডি) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মত, ফাস্ট ট্র্যাকের আওতায় ১০ মেগা প্রকল্পগুলো হচ্ছে পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র, মেট্রোরেল প্রকল্প, এলএনজি টার্মিনাল ও গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্প, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর, পদ্মা সেতুতে রেলসংযোগ প্রকল্প, দোহাজারী-রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু-মিয়ানমারের কাছে ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প ও সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ। কিন্তু বেশিরভাগ প্রকল্পের অগ্রগতি কম। তবে তার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত প্রকল্প পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন অগ্রগতি ভালো। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত এ প্রকল্পের মূল সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে ৮৫ দশমিক ৫ শতাংশ। চলতি জানুয়ারিতে আরো ১ শতাংশ কাজ শেষ হবে। সেতুর জাজিরা এবং মাওয়া দুই প্রান্তে সংযোগ সড়ক নির্মাণ, নদীশাসনসহ অন্যান্য মিলে সার্বিক বাস্তবায়ন অগ্রগতি ৭৬ দশমিক ৫০ শতাংশ। কাজের গতি অনুযায়ী চলতি বছরই প্রকল্পের নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা। তবে সরকারের আগামী বছরের জুন নাগাদ পদ্মা সেতু যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
সূত্র জানায়, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত পদ্মা বহুমুখী নির্মাণ প্রকল্পে মোট ২১ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। ২০০৭ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে তা অনুমোদিত হয়। ওই সময় প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার কোটি টাকা। তার পর তিন দফা সংশোধনের মাধ্যমে প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানো হয়। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের যোগাযোগ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে পদ্মা সেতু রেলসংযোগ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। তাতে পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ১৭৩ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে। গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ওই প্রকল্পের কাজ মাত্র ৩০ দশমিক ২২ শতাংশ শেষ হয়েছে। ওই সময় পর্যন্ত ১১ হাজার ৮৬০ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। প্রকল্পে সংশোধিত ব্যয় ধরা হয় ৩৯ হাজার ২৫৮ কোটি ১৩ লাখ টাকা। তাতে চীন সরকারের বিনিয়োগের পরিমাণ ২১ হাজার ৩৬ কোটি টাকা। বাকি ১৮ হাজার ২১০ কোটি টাকা সরকার নিজে জোগান দিচ্ছে। ২০১৬ সালে প্রকল্পটি অনুমোদনের সময় ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৪ হাজার ৯৮৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। মেয়াদ ধরা হয়েছিল ২০২২ সালের ডিসেম্বর; কিন্তু ২০১৮ সালের এপ্রিলে প্রকল্পের ব্যয় আরো চার হাজার ২৬৯ কোটি ২৭ লাখ টাকা বাড়িয়ে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়।
সূত্র আরো জানায়, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে দুই হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি অর্থের বিবেচনায় সবচেয়ে বড় প্রকল্প। ওই প্রকল্পের ব্যয় এক লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। আর গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যয় করা হয়েছে ২৭ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা। অর্থাৎ সার্বিক কাজ এগিয়েছে মাত্র ২৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ। ২০২৫ সালের জুনে প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। প্রকল্পটি মনিটরিংয়ে আইএমইডি বলেছে, এটি বাস্তবায়নে সমন্বিত পরিকল্পনা নেয়া হয়নি। তাছাড়া ক্রয় পরিকল্পনায় ত্রুটি রয়েছে। যেমন একাধিক পদ্ধতি, দরপত্র আহ্বান, চুক্তি সই ও চুক্তি সমাপ্তির ক্ষেত্রে একাধিক তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে। এসব সমাধানে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে আইএমইডির পক্ষ থেকে। তাছাড়া ২০১২ সালের জুলাইয়ে মেট্রোরেল প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরু হয়ে ২০১৯ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রকল্পের আশানুরূপ অগ্রগতি না থাকায় স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে ২০২১ সালের বিজয় দিবসে দেশের প্রথম মেট্রোরেল প্রকল্প উদ্বোধনের সংশোধিত তারিখ নির্ধারণ কর হয়। তবে এখন পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে ৩৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ। ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকার প্রকল্পে জাপান সরকারের উন্নয়ন সংস্থা জাইকা ঋণ দিচ্ছে ১৬ হাজার ৫৯৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। আর ২০১৪ সালের জুলাই মাসে কক্সবাজারের মহেশখালীতে ১২০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রকল্পটি নেয়া হয়। জাপান সরকারের সহযোগিতায় ওই প্রকল্পটি ২০২৩ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে ২৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ। ৩৫ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকার প্রকল্পে ১০ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। অবশ্য ভূমি অধিগ্রহণের মতো বড় কাজ এবং প্রকল্পের আওতায় পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণকাজ শতভাগ শেষ হয়েছে। আর রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ উদ্যোগে নির্মিত হচ্ছে। বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি (বিআইএফপিসিএল) প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। ওই প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৬ হাজার কোটি টাকা। ২০০৯ সালের জুলাই থেকে এর কাজ শুরু হয়ে ২০২০ সালের জুনে কাজ শেষ হওয়ার কথা। প্রকল্পটির ভূমি অধিগ্রহণ, বাউন্ডারি ওয়াল, ভূমি উন্নয়ন ও অফিস কাম আবাসিক ভবনের কাজ শতভাগ শেষ হয়েছে। তবে সার্বিক অগ্রগতি সন্তোষজনক নয়। তাছাড়া দোহাজারী-রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু-মিয়ানমারের কাছে ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্প ২০১০ সালের জুলাই মাসে শুরু হয়েছে। সংশোধিত মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছে ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত। তবে গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কাজ শেষ হয়েছে ২৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটিতে এ পর্যন্ত ব্যয় করা হয়েছে মাত্র চার হাজার ৩১৬ কোটি টাকা। আর পায়রা বন্দরের সঙ্গে দেশের সড়ক-মহাসড়কের মধ্যে সংযোগ এবং বন্দরের কার্যক্রম সহজ করতে পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্পটি গ্রহণ হয়। ২০১৫ সালে শুরু হয়ে ২০১৮ সালে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা থাকলেও সময় ও ব্যয় বৃদ্ধি করা হয়। সংশোধিত ব্যয় ধরা হয় ৩ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। মূল ব্যয় ছিল এক হাজার ১২৮ কোটি টাকা। গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাস্তবায়ন অগ্রগতি মাত্র ১৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ। তাছাড়া কক্সবাজারের মহেশখালীর কাছে বঙ্গোপসাগরে বিশাল এলএনজি টার্মিনাল থেকে গত বছর আগস্ট থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজি সরবরাহ শুরু হয়েছে। সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী প্রকল্পের মেয়াদ ২০৩২ সাল পর্যন্ত। প্রকল্পটি সম্প্রসারণ করে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের পাশাপাশি মহেশখালী-আনোয়ারা গ্যাস সঞ্চালন সমান্তরাল পাইপলাইন নির্মাণ, আনোয়ারা-ফৌজদারহাট গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ এবং চট্টগ্রাম-ফেনী-বাখরাবাদ গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ প্রকল্প যুক্ত করা হয়েছে। ওই গ্যাস সঞ্চালন লাইন নির্মিত না হওয়ায় আমদানি করা পুরো গ্যাস দেশে ব্যবহার করা যাচ্ছে না। টার্মিনাল স্থাপন সন্তোষজনক হলেও ওই গ্যাস সঞ্চালনে পাইপলাইন স্থাপন কাজ সন্তোষজনকভাবে হয়নি। তবে সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্পটির কাজ এখনো শুরু হয়নি। অবশ্য কারিগরি ও অর্থনৈতিক সমীক্ষা শেষ করেছে জাপানের প্যাসিফিক কনসালট্যান্ট ইন্টারন্যাশনাল (পিসিআই)।
এদিকে অতিসম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর তেজগাঁও কার্যালয়ে ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্প মনিটরিং কমিটির সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্প মনিটরিং কমিটির আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বড় প্রকল্প পর্যবেক্ষণ করা উচিত। সরকার বিদ্যমান ১০ ফাস্ট প্রকল্পের সঙ্গে আরো বেশ কিছু প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করবে।