অসাধু চক্রের কারসাজিতে দিনে দিনে বেড়েই চলেছে দেশের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা বাজার তদারকিতে থাকা সত্ত্বেও গত এক মাসের ব্যবধানে অন্তত ১০ রকম নিত্যপণ্যের মূল্য বেড়েছে। তার মধ্যে রয়েছে চাল, ডাল, আটা, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ, রসুন, দারুচিনি, এলাচ, শুকনো মরিচ ও আদা। শুধুমাত্র চালের মূল্যই বেড়েছে কেজিতে ৭ টাকা। আটার মূল্য বেড়েছে ১০ টাকা। ডালের মূল্য বেড়েছে কেজিতে ১০ টাকা। আর সয়াবিন তেলের মূল্য বেড়েছে ২০ টাকারও বেশি। গত বছরের এই সময়ে ২০ টাকায় যে পেঁয়াজ পাওয়া যেতো, এখন ওই পেঁয়াজ কিনতে হচ্ছে ১২০ টাকায়। রসুনের মূল্য বেড়েছে ২০ টাকা। আর শুকনো মরিচের মূল্য কেজিতে বেড়েছে ৩০ টাকা। দারুচিনির মূল্য বেড়েছে ২০ টাকা। আর এক মাসের ব্যবধানে প্রতিকেজি এলাচের মূল্য বেড়েছে ১ হাজার ৪শ’ টাকা। একইভাবে চিনির মূল্য বেড়েছে ১০ থেকে ১২ টাকা। এক মাস আগে যে চিনির কেজির মূল্য ছিল ৫৫ টাকা, বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে ৬৫ থেকে ৬৭ টাকা দরে। টিসিবি এবং বাজার সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, মোকামে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় খুচরা বাজারেও তার প্রভাব পড়ছে। গত এক মাসে সাধারণ মানের মিনিকেট ও নাজির চালের মূল্য বেড়েছে ১১ দশমিক ৫৮ শতাংশ। আর সরু চালের মূল্য বেড়েছে প্রায় ৭ শতাংশ। গত ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে সরু চালের মূল্য ছিল ৪৫ টাকা কেজি। এখন ওই চাল বিক্রি হচ্ছে ৫২ থেকে ৫৩ টাকায়। একইভাবে এক মাস আগে সাধারণ মানের মিনিকেট ও নাজির শাইল চালের মূল্য ছিল ৪৫ টাকা। এখন ওই চালই বিক্রি হচ্ছে ৫৩ থেকে ৫৪ টাকায়। পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, চালের মূল্য কমতে আরো তিন মাস লেগে যাবে। তাছাড়া গত এক মাসে গরিবের মাংস হিসেবে বিবেচিত ডালের মূল্য বেড়েছে কেজিতে ১০ টাকা। ডাল বেশি কেনে নিম্ন আয়ের মানুষ। এক মাস আগে ওই ডাল ৫৫ টাকা কেজিতে পাওয়া গেলেও এখন তা ৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সরকারের তথ্য মতে গত এক মাসে মোটা দানার ডালের মূল্য বেড়েছে ১৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ। আর এক মাসে চালের চেয়েও আটার মূল্য বেশি বেড়েছে। এক মাস আগে যে প্যাকেট আটা ৩৫ টাকা কেজি বিক্রি হতো, এখন ওই একই আটা বিক্রি করতে হচ্ছে ৪৫ টাকা। টিসিবি’র তথ্য অনুযায়ী গত এক মাসে প্যাকেট আটার মূল্য বেড়েছে ১৫ দশমিক ৯৪ শতাংশ। পাশাপাশি সয়াবিন তেলের মূল্য বেড়েছে ২০ টাকারও বেশি। গত নবেম্বর মাস থেকে কয়েক ধাপে বেড়েছে খোলা সয়াবিন ও পাম তেলের মূল্য। লিটারে বেড়েছে ১৫ থেকে ২০ টাকা। বোতলের তেলও লিটারে ২০ টাকা বেড়েছে। এক মাস আগে ৫ লিটার বোতলজাত সয়াবিনের মূল্য ছিল ৫০০ টাকা। এখন ওই বোতল বিক্রি হচ্ছে ৫২০ টাকা। তাছাড়া এক মাস আগে যে পাম তেলের মূল্য ছিল ৭৯ টাকা, এখন তা বেড়ে হয়েছে ৯০ টাকা।
সূত্র জানায়, পেঁয়াজের অস্বাভাবিক মূল্য দেশের মানুষকে এখনো ভোগাচ্ছে। রাজধানীর বাজারগুলোতে ১০০ টাকার নিচে দেশী নতুন পেঁয়াজের কেজি মিলছে না। তবে আমদানি পেঁয়াজের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬০-৮০ টাকায়। টিসিবির হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে দেশি পেঁয়াজের মূল্য বেড়েছে ৩৪৪ শতাংশ এবং আমদানি করা পেঁয়াজের মূল্য বেড়েছে ২২২ শতাংশ। পেঁয়াজের পাশাপাশি গত এক মাসে রসুনের মূল্যও বেড়েছে। টিসিবির তথ্যানুযায়ী এক মাস আগে প্রতিকেজি রসুন বিক্রি হয়েছে ১৮০ টাকা। এখন ওই রসুন বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকায়। আমদানি করা রসুনের মূল্য এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ১৮৩ শতাংশ। বর্তমানে আমদানি করা রসুন ১৩০-১৫০ টাকা এবং দেশী রসুন ১৪০-২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। পাশাপাশি শুকনো মরিচের মূল্য কেজিতে বেড়েছে ৩০ টাকা। গত ডিসেম্বরে যেখানে প্রতিকেজি শুকনো মরিচের মূল্য ছিল ২০০ টাকা থেকে ৩২০ টাকা। এখন ওই মরিচের মূল্য ২২০ থেকে ৩৫০ টাকা। অর্থাৎ প্রতিকেজিতে বেড়েছে ২০ থেকে ৩০ টাকা। একইভাবে দারুচিনির মূল্য বেড়েছে ২০ টাকা। ৪০০ টাকা কেজি দারুচিনি এখন বিক্রি হচ্ছে ৪২০ টাকা। আর গত এক মাসের ব্যবধানে এক কেজি এলাচের মূল্য বেড়েছে ১ হাজার ৪শ’ টাকা। টিসিবি’র হিসাবে গত এক মাসে এলাচের মূল্য ৩৫ দশমিক ২৯ শতাংশ বেড়েছে। ডিসেম্বরে প্রতিকেজি এলাচ বিক্রি হয়েছে ৩ হাজার ৬শ’ টাকা। এখন ওই এলাচ বিক্রি হচ্ছে ৫ হাজার টাকা দরে। যদিও এক সপ্তাহ আগে এলাচের মূল্য আরো বেড়ে ৬ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। তাছাড়া প্রতিকেজি আদা বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১৫০ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে এ পণ্যটির মূল্য বেড়েছে ২২ শতাংশ।
এদিকে আগামী এপ্রিলের শেষের দিকে শুরু হচ্ছে পবিত্র রমজান। আর ওই রমজানে পণ্যের দাম সহনীয় রাখতে তিন মাস আগেই সরকারের ১০ সংস্থাকে মাঠে নামানো হয়েছে। সংস্থাগুলো হলো- বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেল, র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর, ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি), কৃষি বিপণন অধিদফতর, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, সিটি কর্পোরেশন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মনিরিং টিম। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেলের সদস্যরা খুচরা বাজার থেকে শুরু করে পাইকারি ও মোকামে অভিযান চালাবে; যাতে রমজানকে পুঁজি করে কারসাজির মাধ্যমে কেউ অতি মুনাফা লুটে ভোক্তাকে ঠকাতে না পারে। ওই সময় কোনো ধরনের অনিয়ম পেলে কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হবে। তবে এসব পদক্ষেপের পরও ভোক্তা পর্যায়ে নিত্যপণ্যের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে চলেছে। আর প্রতিবছরই একটি চক্র রমজানকে টার্গেট করে পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে ভোক্তাদের পকেট কাটে। এবারও একই চিত্র হলে বরাবরের মতো হিমশিম খেতে হবে। তবে সঠিকভাবে তদারকি হলে সুফল আসবে। আর লোক দেখানো হলে এই তদারকি কোনো কাজে আসবে না।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান জানান, রমজানে খাদ্যপণ্যের বাড়তি চাহিদা সৃষ্টি হয়। ওই সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। এবার যাতে তা না হয় সেজন্য সংশ্লিষ্টদের আগে থেকেই সজাগ থাকতে হবে। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও সচেষ্ট ভূমিকা পালন করতে হবে। যাতে ব্যবসায়ীরা পণ্য আনতে গিয়ে রাস্তায় চাঁদাবাজির শিকার না হন। তা বন্ধ করা গেলে সারা বছরই পণ্যের দাম সহনীয় থাকবে।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, রমজানের চাহিদা মেটাতে দুই লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করা হবে। তাছাড়া ভোজ্যতেল, সোলা, আদা রসুন, খেজুরসহ সব নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা, উৎপাদন, আমদানি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় মজুদ সৃষ্টি করা হচ্ছে। বিগত দিনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আগামী দিনের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে। রমজানে মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের যেন সংকট না হয়, সেজন্য সরকারের একাধিক সংস্থা কঠোর মনিটরিং করছে। ইতিমধ্যে দেশের মানুষের প্রত্যাশা পূরণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ গ্রহণ করছে।