দুর্নীতি! দুর্নীতি!! দুর্নীতি!!! শুধু দুর্নীতি আর দুর্নীতি। আওয়ামীবাদী উন্নয়ন মুখরিত ডিজিটাল কিংবা এগিয়ে যাওয়ার বাংলাদেশের চতুর্দিকে দুর্নীতি। বাণীচিরন্তনী ‘যে যতো বেশি কথা বলে, তার কথায় ততো ভুল।’ অর্থাৎ কাজ করলে ভুল হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তাই বলে ডিজিটালের এই আওয়ামীবাদী বিপুল উন্নয়ন প্লাবনের ফল ‘দুর্নীতি’ হবে? এমনটি মোটেও কাম্য নয়। দুর্নীতি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা না থাকায় দুর্নীতি গণতন্ত্রের ক্লাব খ্যাত জাতীয় সংসদ থেকে উৎপত্তি হয়ে আদালতপাড়া ভায়া পুলিশপাড়া দিয়ে সরকারি-বেসরকারি অফিসপাড়া শেষ অবধি একেবারে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দানা বাঁধছে। এতে দিন দিন বাঁধ সাধছে লোভ আর অসদাচরণ।
বলাবাহুল্য যে, স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম থেকে ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ জলাঞ্জলিপ্রদত্ত, এমন কী আইন বানানো কারখানা জাতীয় সংসদের আইনপ্রণেতাদের গাড়ি থেকেও দুর্নীতির গন্ধ বের হওয়ার নজির যে নেই, তা কিন্তু নয়। বরং ইট, খোয়া, পাথর, টাইলস, আর কংক্রিটে নির্মিত রাজধানীর আলিশান বাসা-বাড়ি আর অগণিত অলি-গলি কিংবা বিভিন্ন অফিস-আদালত থেকে শুরু করে দেশের অজ পাড়াগুলোতেও আজ অবধি সহসাই গন্ধ ছড়াচ্ছে আইনপ্রণেতাদের সৃষ্ট নির্ভেজাল দুর্নীতি। এতে ভাসছে আওয়ামী উন্নয়ন ফেরি স্তাবকদের বাহারি-রকমারির গাল-গল্প।
আজ যারা রাজনৈতিক কিংবা অন্য কোনোভাবে ক্ষমতাহীন ব্যক্তিরা দুর্নীতির দাপটে বড়ই বিচলিত কিংবা কাহিল। কালের বিবর্তনে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় কিংবা ভাগ্যক্রমে ক্ষমতায় আসীন হয়ে তারা যখন প্রশাসনের হর্তা-কর্তাব্যক্তি বনে যান, তখন দুর্নীতির কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে উন্নয়নের ঢালাও সাফাই গাওয়াই যেনো তাদের একমাত্র দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়! মনে হয়, যেনো দেশ তথা জনগণের স্বার্থেই অযথা ‘উন্নয়ন নাটক’ মঞ্চায়ন করে থাকেন ক্ষমতান্ধ ক্ষমতাসীনরা।
যারা ক্ষমতার বাইরে থাকেন, তারা দুর্নীতি নিয়ে এমন ভাবে বিচলিত হন যা বলাই বাহুল্য। কিন্তু ক্ষমতার রাজ্যে পদার্পণ সত্ত্বেও নিয়ম-নীতির গান না গেয়ে দুর্নীতির তরী বেয়ে পার পেতে চান শান্তির নিকেতন। ভুলে যান অনিয়ম-দুর্নীতির প্রতিবাদ। আবার ক্ষমতা হাত ছাড়া হয়ে গেলে নীতিতে মেতে উঠেন। এ ব্যাধিটি বাংলায় নতুন নয়। বরং ওই অপ্রত্যাশিত ব্যাধিটি অতি পুরাতনই বটে। এ রোগ এক দিনের নয়, অনেক দিন ধরে তা আক্রমণ করেছে।
ভারতীয় প্রখ্যাত লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর দিনলিপি ‘স্মৃতির রেখা’-তে একস্থানে লিখে ছিলেন, ‘এখন যেখানে মহানগরী, আজ হতে কয়েক শত বছর পরে সেই স্থান দিয়ে জলধারা প্রবাহিত হবে।’ প্রকৃতিদর্শী বিভূতিভূষণ বুঝে ছিলেন, নীতি প্রকৃতির সাথে বৈরী সম্পর্ক স্থাপন করেছে। প্রকৃতিকে পদানত করে জয়ধ্বজা উড়িয়ে দেওয়ার স্বপ্ন নবজাগ্রত মানব একদা দেখত। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অহংকারে প্রকৃতিকে জয় করার বাসনা। সমস্যার মূল এমন অপ্রত্যাশিত বাসনাতেই। প্রকৃতি বিপুল ও বৃহৎ। মানুষ সেই প্রকৃতিরই অংশ। এই বোধ থাকলে মানুষ প্রকৃতিকে জয় করতে চাইতো না, প্রকৃতির সাথে সহবাস করতে চাইতো। প্রকৃতির সাথে সহবাসের অর্থ এ ক্ষেত্রে আদিম মানুষের ন্যায় অসহায় দশায় প্রকৃতির হাতের পুতুল হয়ে থাকা নয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে প্রকৃতির অনুকূলে প্রয়োগ করে সহবাস করতে হবে। যে উন্নয়নের ফলে দুর্নীতির হচ্ছে, তার কারণ পরিকল্পনার অভাব। একদিকে, নগর নগরে যত্রতত্র নির্মাণ হচ্ছে। সুবিশাল আকাশচুম্বী ইমারত, বাণিজ্যবিপণি, আবাসস্থল, ওভারফ্লাই, ইট, খোয়া, পিচ আর কংক্রিটের বাহারি ঢালাই দেখে মনে হবে, আহা! কী যে উন্নয়ন! নির্মিত রাস্তা ঘাট, দালান কোটা, ব্রিজ, টেকসই না করলেও বিগ বাজেট বরাদ্দের কমতি নেই। যেখানে নির্মাণ কাজে বাঙালির ঐতিহ্যবাহী বাঁশের গন্ধ বের হওয়ার গণমাধ্যমে খবরের শিরোনাম চাউর।
অপরদিকে ইন্টারনেট, স্মার্টফোন, ফোর-জি নেটওয়ার্ক, ফেইসবুক, অ্যাপস, ইউটিউব, ওয়েবফেইজ। আহা! বিজ্ঞানের কী মহিমা! মাটিতে পদস্পর্শ করলেই টের পাওয়া যাবে উন্নয়ন আর বিজ্ঞানের মহিমা দুর্নীতি কাদালাঞ্ছিত। কোথাও হাঁটু অবধি, কোথাও তার চেয়েও বেশি। শত শত কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়লেও উন্নয়নের প্লাবনে ভেঙ্গে পড়ে নির্মাণকালীন ফ্লাইওভার! এগিয়ে যাওয়ার শিক্ষাখাতে শুধু বারোটা নয় বরং এখন আর সাড়ে তেরোটা বাজার বাকি নেই। আর ইন্টারনেটের আগ্রাসীতে নির্বাক মানবতা, অচল বিবেক। কর্মনাশা দিন।
উপায় কী? প্রথমেই স্বীকার করতে হবে দোষ প্রশাসনের কর্ত্যাব্যাক্তিদের নয়, স্বভাবেরও নয়। দোষ আমাদের। ঢেঁকি স্বর্গ গেলেও ধানই বানবে। ঢেঁকিকে তার কাজ করার সুযোগ না দিলে ঢেঁকি তো আর ঢেঁকির মর্যাদা পাবে না। প্রতিটি কর্তার নিজস্ব চরিত্র আছে। কর্তার চরিত্র বুঝে দায়িত্ব দিতে হয়। যে হর্ম্য আমেরিকায় দেখতে ভালো সেইরূপ হর্ম্য বাংলাদেশের বক্ষে বানাইলে সেই অঞ্চলের প্রকৃতি কোথাও বিনষ্ট হবে কি-না তা বুঝতে হবে। আঞ্চলিক ভূমির প্রকৃতি, বর্ষাকালে জলধারা প্রবাহিত হবার গতি, ভূভাগের ঢাল ইত্যাদি বিচার করে নির্মাণ করতে হয়। আবার দেখতে হয়, যা নির্মাণ করলাম তা সুরক্ষিত, কিন্তু পার্শ্ববর্তী জনগোষ্ঠী ও পরিবেশের উপর তার প্রভাব কী? মাথাটি তুলে বাড়িটি আকাশ স্পর্শ করল বটে, কিন্তু তার বিরাজমানতার ফলে এ পাশ হতে ও পাশে জল যাবার উপায় গেলো বন্ধ হয়ে। ফলে বর্ষাকালে হর্ম্যবাসীগণ আকাশের দিকে চেয়ে বসে রইলেন আর নীচের মানুষ জলে ডুবে অহোরাত্র তাঁদের শাপশাপান্ত করতে লাগলেন। সামাজিক ও প্রাকৃতিক উভয় পরিবেশের পক্ষেই এমনাবস্থা নিতান্তই ক্ষতিকর। যা হয়েছে তা তো সব ধূলিসাৎ করা যাবে না। অবাঞ্ছিত নির্মাণ বিষয়ে সচেতন হতে হবে সকলকেই। নগর ভাসলে শেষ অবধি আপনার বাড়িটিও বাঁচবে না। এ ক্ষেত্রে ধর্মবিশ্বাস কার্যকর দাওয়া হতে পারে।
ধর্মবিশ্বাস হলো নিজের জীবনকে ঐশ্বরিক শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ। ইসলামসহ পৃথিবীতে অপর যেসব ধর্ম ঐশ্বরিক হিসেবে স্বীকৃত সেসব ধর্মেও সত্য ও ন্যায়ের প্রতি অবিচল থাকার কথা বলা হয়েছে। আমাদের দেশের বিচারব্যবস্থা যেমন ধর্মীয় অনুশাসনভিত্তিক নয়, অনুরূপ পাশ্চাত্যের দেশগুলোর বিচারব্যবস্থাও ধর্মীয় অনুশাসনভিত্তিক নয়। কিন্তু পাশ্চাত্যের দেশগুলোর সাথে আদালত অবমাননা বিষয়ে আমাদের দেশের পার্থক্য হলো, সেসব দেশে আদালত অবমাননাকে সংজ্ঞায়িত করে এর ব্যাপ্তি নির্ধারণ করে দেয়ায় ‘সত্য সুরক্ষা নয়’ এ ধরনের যুক্তি কখনো গ্রহণীয় নয়।
যেকোনো আইনের সাথে নীতি, নৈতিকতা ও জনস্বার্থের বিষয়টি সম্পর্কিত। ধর্মবিশ্বাস একজন মানুষকে নীতি, নৈতিকতা, নিজ অধিকার ও অপরের অধিকার বিষয়ে শিক্ষা দেয়। ধর্মবিশ্বাস একজন মানুষকে শিশু অবস্থায় পারিবারিক অঙ্গনে নীতি ও নৈতিকতার দিকে আকৃষ্ট করে নীতিবান, সত্যবাদী ও ন্যায়ের প্রতি একনিষ্ঠ থাকার প্রেরণা জোগায়।
পৃথিবীর কোনো দেশের আইন সে দেশের নাগরিকদের সত্য ও ন্যায়ের বিপক্ষে অবস্থানের কথা ব্যক্ত করে না। আমাদের দেশেও এমন কোনো আইন নেই যা একজন ব্যক্তিকে সত্য ও ন্যায়ের বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণে উৎসাহিত করে। আদালতে মিথ্যা বলা মিথ্যা স্বাক্ষ্য দেয়া আমাদের দেশের মূল দ-বিধি অনুযায়ী দ-নীয় অপরাধ। আমাদের সর্বোচ্চ আইন সংবিধান। সংবিধানে সুস্পষ্টরূপে উল্লেখ রয়েছে, সংবিধান ও আইন মেনে চলা প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য। ইসলাম ধর্মে সত্য ও ন্যায়ের যে অবস্থান তা থেকে আমাদের সংবিধান ও দেশের অপরাপর আইন বিচ্যুত নয়। আদালতে স্বাক্ষ্য দেয়ার সময় একজন ব্যক্তিকে শপথবাক্য পাঠপূর্বক বলতে হয় তিনি আদালতে যা বলবেন তা সত্য বলবেন ও কোনো কিছু গোপন করবেন না এবং মিথ্যা বলবেন না। আদালতে মামলা দায়েরকালীন বাদিকে হলফনামা দাখিলপূর্বক বলতে হয় তিনি মামলার আরজি বা দরখাস্তে যেসব বিষয় উল্লেখ করেছেন তা তার জ্ঞান ও বিশ্বাসমতে সত্য। আদালতে বিবাদি যখন তার জবাব দাখিল করে তাকেও জবাবের সাথে হলফনামা প্রদানপূর্বক বলতে হয় তার দাখিলি জবাব তার জ্ঞান ও বিশ্বাসমতে সত্য।
আমাদের দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মবিশ্বাস এবং সংবিধানসহ অপরাপর আইনের অবস্থান সত্য ও ন্যায়ের স্বপক্ষে হওয়ায় আদালত অবমাননা মামলায় কোনো কোনো বিচারকের পক্ষ থেকে সত্য সুরক্ষা নয়- এমন অবস্থান গ্রহণ করা হলে, তা এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মগ্রন্থ, ধর্মবিশ্বাস, দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধান ও অপরাপর আইনকে অবমাননা করার সামিলই বটে। সুতরাং এসব সংকট উত্তোরণে ধর্মবিশ্বাসের বিকল্প নেই।
(লেখক : এম. কে. দোলন বিশ্বাস, দৈনিক সংবাদের সাবেক সহ-সম্পাদক)