মুজিব বর্ষের ক্ষণ গণনা শুরু হয়েছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন ছিল সোনার বাংলা গড়ে তোলা। তার হিমালয়সম দৃঢ় চেতনায় আর সুদক্ষ নেতৃত্বে বাংলার নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবাই মুক্তিযুেেদ্ধ ঝাঁপিয়ে পরে। দেশকে হানাদার মুক্ত করে। হানাদারের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করার চেতনা ছিল। আজকের প্রজন্মকে সেই চেতনায় দেশ গড়তে হবে। এগিয়ে যেতে হবে। কিন্তু আমরা সেই চেতনা বাস্তবায়নে অগ্রসর হয়েও নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পরছি। স্বাধীনতার এতগুলো বছর পেরিয়ে গেলেও দুর্নীতিমুক্ত হতে পারিনি। আজও দুর্নীতি আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পরেছে। আমাদের নতুন প্রজন্মকে এই বিষাক্ত ছোবল থেকে মুক্ত করতে হবে। ওরা জন্মের পরেই বড় হওয়ার সাথে সাথে আমাদের চারপাশের ঘটা অন্যায় আর দুর্নীতি দেখছে। দেখছে এখানে চাকরি পেতে ঘুষ দিতে হয়, এখানে ক্ষমতার বড় অহংকার করা হয়। এখানে ধনী গরীবে বৈষম্য, এখানে সর্বত্র ভেদাভেদ গড়ে উঠেছে। অথচ আমাদের দেশটাতো এমন হওয়ার কথা ছিল না। এত কষ্টে পাওয়া এই দেশটার আরও এগিয়ে চলার কথা ছিল। কিন্তু বার বার থমকে দাড়িয়েছে। সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখা জাতির জনককে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। তবে তার স্বপ্নকে তো খুনিরা মারতে পারেনি। আজ জন্ম নেওয়া প্রতিটি শিশুর চোখে সোনার বাংলার স্বপ্ন। তাদের চোখে সে স্বপ্ন ফোটাতে আমাদের কাজ করতে হবে। বলতে হবে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস। আমাদের বীরদের রক্তের কথা, স্বপ্নের কথা। তাদের স্বপ্নই আজকের এই বাংলাদেশ। পাশাপাশি এই দেশের যারা বিরোধীতা করেছিল তাদেরও চেনাতে হবে। আর এর উপায় হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়ার অঙ্গীকার করা। আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা জানাতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে। এই দেশ সোনার বাংলা গড়তে চেয়েছিলেন আমাদের জাতির জনক। তোমরা তার আদর্শ বুকে নিয়ে দেশ গঠনে একত্রিত হও। আমরা আজও মুক্তিযুদ্ধের সঠিক চেতনা তরুণ সমাজের কাছে পৌছাতে পারিনি। এটা আমাদের ব্যর্থতা। এই ব্যর্থতাই স্বাধীনতার এত বছর পরেও কাঙ্খিত উন্নয়ন পাইনি। ত্রিশ লাখ বাঙালির রক্ত আর লক্ষ লক্ষ নারীর ইজ্জতের বিনিময়ে পাওয়া এই স্বাধীনতার সঠিক ব্যাবহার আমরা আজও করতে পারিনি অথবা পারছি না।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় শুরু থেকেই বিভিন্ন শ্রেণিতে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ঘটনা বর্ণনা করে সাজানো হয়েছে। এসব পড়ে ছাত্রছাত্রীরা মুক্তিযুদ্ধের সম্পর্কে কিছুটা জানতে পারছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে মুক্তিযুদ্ধ কর্ণার স্থাপন করা হয়েছে। এতে নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধকে জানার,বোঝার সুযোগ পাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের মত একটি বিষয়কে কেবল একটি অধ্যায়ে বোঝানো সম্ভব নয়। আবার পাঠ্যবইয়ের সূচীও সীমাবদ্ধ। পাঠ্যবইয়ের ইতিহাসও বহুবার পাল্টানোর চেষ্টা করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তথ্য ঢেকে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে লাভের লাভ কিছুই হয়নি। সত্যি কখনো চাপা থাকে না। তা ঠিক বেরিয়ে এসেছে। সেসব কথাই তাদের বলতে হবে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা প্রতিটি ছাত্রছাত্রীকে বিস্তৃতভাবে জানাতে হবে। সঠিক তথ্যটা তাদের দিতে হবে। কোন বিভ্রান্তি রাখা যাবে না। সেটা পারিবারিকভাবে না হলে ভিন্ন উদ্যেগে জানাতে হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের আতœত্যাগ আর যুদ্ধের লক্ষ, স্বাধীন দেশের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য এসব বোঝাতে হবে। কোনটা স্বাধীনতার চেতনা আর কোনটা স্বাধীনতার চেতনা নয় তার মধ্যে পার্থক্য স্পষ্ট করে তুলে ধরতে হবে। কারণ আজকের শিশু, তরুণ যুবারাই আগামীর ভবিষ্যত। তারাই আমাদের নতুন দিনের পথ দেখাবে। তাদের দেখা পথটা যেন সঠিক হয়, তাদের সিদ্ধান্তের ওপর যেন আমরা ভরসা করতে পারি সেভাবে গড়ে তুলতে হবে। প্রতি বছর জাতীয় দিবসগুলোতে শিক্ষার্থীদের নিয়ে দিবস পালন করা হয়। দিবস পালনের উদ্দেশ্য কিন্তু কেবল সেই দিনটা পালন করা নয়। সেই দিন সম্পর্কে স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের ভালোভাবে জানাতে হবে। বিশেষ করে যারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের লেখাপড়া করে তাদের সুন্দর করে দিবসটির তাৎপর্য বোঝাতে হবে। কেন দিবসটি পালন করছি তা জানাতে হবে। দায়সারা গোছের দিবস পালন করলে মূল উদ্দেশ্য অধরা থেকে যাবে। তাদের কাছে স্বাধীনতার গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে। সঠিক ইতিহাস জানাতে হবে এবং আরও জানতে আগ্রহী করে তুলতে হবে। সেক্ষেত্রে শিক্ষক যদি মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ঘটনাকে ছোট ছোট কোমলমতি শিশুদের শোনাতে পারে, এ জাতির বীরত্বের ইতিহাস বলতে পারে তাহলে সবচেয়ে ভালো হয়। এর ফলে ক্লাসের মনোযোগও বৃদ্ধি পাবে আবার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানাতে পারবে। কারণ ছোট থেকেই যদি তাদের মুক্তিযুদ্ধ চেতনা, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া যায় তাহলে বড় হয়ে তারা কোন অন্যায় করতে গেলে অন্তত ক্লাসে বলা শিক্ষকের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা মনে পরবে। সবার যদি মনে নাও পরে সমস্যা নেই, কয়েকজনেরও যদি মানসিকতায় পরিবর্তন আনা যায় তাহইে আমাদের স্বার্থকতা। পরিবর্তন একদিনে আনা সম্ভব নয়।
আমরা বিভিন অনুষ্ঠানে প্রায়ই মুক্তিযুদ্ধর চেতনায় দেশ গড়ার অঙ্গীকার করি, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের কথা বলি কিন্ত নতুন প্রজন্ম কে বোঝাতে হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়া কি? কেমন হবে সেই দেশ? বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য আমাদের করণীয় কি। কারণ দেশটা গড়ে তুলবে এই প্রজন্ম। তাদের বোঝাতে হবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ ছিল একটা দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়া। অসাম্প্রদায়িক চেতনা গড়া। একটা বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোল। সবার মুখের অন্নের যোগান নিশ্চিত করা। মুক্তিযোদ্ধারা একটি স্বাধীন দেশের জন্য ঝাঁপিয়ে পরেছিল একটি বিদ্বেষমুক্ত দেশ গড়ে তোলার জন্য। এসব কিছুই তাদের বোঝাতে হবে, জানাতে হবে। আমরা যদি তাদের এসব না বোঝাই তাহলে দেশ কোনদিন কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌছাবে না। সবচেয়ে ভালো হয় যদি এমন কোন ব্যবস্থা করা যায় যা আমাদের কঁচিকাচা ছেলেমেয়েরা মুক্তিযোদ্ধাদের মুখ তাদের বীরত্বের কাহিনী শুনতে পায়। অন্ততপক্ষে সপ্তাহে একদিন যদি তারা স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের সব ঘটনা যদি ছাত্রছাত্রীরা শুনতে পায় তাহলে আমি নিশ্চিত তারা মুক্তিযুদ্ধকে নতুন ভাবে জনত পারবে। বইয়ে পড়া ঘটনা অন্তরে বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। কিন্তু যদি কেউ গল্পের মাধ্যমে সেই ঘটনাগুলোকে বর্ণনা করে আর সেই মানুষটি যদি হয় সেই ঘটনার সমসাময়িক তাহলে বিষয়টি অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহ্য হবে সন্দেহ নেই। এটা ছাত্রছাত্রীদের বিদ্যালয়ে অবনস্থানকালীনও হতে পারে আবার নির্দিষ্ট এলাকায়ও হতে পারে বা অন্যকোন নির্ধারিত স্থানে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, মুক্তিযোদ্ধাদের চেতনা এসব কোমলমতিদের হৃদয় গেঁথে দিতে হবে। এদের হাত ধরেই এদেশ একদিন দুর্নীতিমুক্ত,হিংসামুক্ত,বৈষম্যহীন বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে উঠবে। নতুন বছরে আমরা যে চেতনা নিয়ে অগ্রসর হয়েছি সেই চেতনা নতুন বাংলাদেশ গড়ার। সেই চেতনা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার প্রত্যয়ের।
অলোক আচার্য
শিক্ষক ও কলামিষ্ট