দেশের অধিকাংশ ব্যাংকই এটিএম বুথে এন্টি স্কিমিং ডিভাইস না বসানোয় জালিয়াত চক্রের জন্য তা পোয়াবারো হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনাকে আমলে নেয়া হচ্ছে না। ফলে এটিএম বুথ থেকে জালিয়াত জক্রের অবৈধভাবে টাকা হাতিয়ে নেয়া বন্ধ করা যাচ্ছে না। এটিএম বুথে এন্টি স্কিমিং ডিভাইস না থাকায় ইতিমধ্যে দেশী-বিদেশী চক্র বিভিন্ন ব্যাংকের বুথ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। যাদের অধিকাংশই ধরা ছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছে। ব্যাংকিং খাত এবং কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশের প্রায় সব ব্যাংকের এটিএম সেবা চালু আছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিটি ব্যাংককে যার যার এটিএম বুথে স্ব স্ব ব্যবস্থাপনায় এবং প্রযুক্তিতে এন্টি স্কিমিং ডিভাইস বসানোর লিখিত নির্দেশ দিয়েছে। তারপরেও অধিকাংশ এটিএম বুথে এন্টি স্কিমিং ডিভাইস নেই। এই সুযোগটিকেই কাজে লাগাচ্ছে দেশী-বিদেশী চক্র। তারা কার্ড প্রবেশ করানোর জায়গায় এবং এটিএম বুথের মনিটরের উপরের দিকে সূক্ষ্ম ক্যামেরা বসিয়ে রাখে। ওই ক্যামেরায় ভিডিও হয় গ্রাহকের গোপন পিন নম্বর। আর ওই পিন নম্বর দিয়ে ক্লোন এটিএম কার্ড তৈরি করে এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলে নেয়া হয়।
সূত্র জানায়, এন্টি স্কিমিং ডিভাইস না থাকায় গত প্রায় চার বছরে দেশের অন্তত এক হাজার এটিএম বুথ থেকে ২ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে জালিয়াত চক্র। ধারণা করা হচ্ছে বাস্তবে হাতিয়ে নেয়া টাকার পরিমাণ আরো বেশি। বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সমন্বয় করে দেশে থাকা আন্তর্জাতিক এটিএম বুথ জালিয়াত চক্রের সন্ধান চালাচ্ছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশে এটিএম বুথ জালিয়াতিতে গ্রেফতার হওয়া দেশী-বিদেশী সদস্যদের পর্যায়ক্রমে জিজ্ঞাসাবাদ করে যাচ্ছে সিআইডি ও আন্তর্জাতিক এটিএম বুথ মনিটরিং টিমের সদস্য হিসেবে থাকা বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দারা। বিগত ২০১৬ সালে প্রযুক্তিনির্ভর জালিয়াতির মাধ্যমে বাংলাদেশে এটিএম বুথ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার ঘটনাটি প্রথম ধরা পড়ে। ওই বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি ইস্টার্ন ব্যাংক বনানী মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। ওই মামলার অভিযোগে বলা হয়, কমপক্ষে ২১ জন গ্রাহকের এ্যাকাউন্ট থেকে এটিএম কার্ড ক্লোন করে অন্তত ১০ লাখ টাকা তুলে নেয়ার ঘটনা ঘটেছে। এমন ঘটনার দু’দিন পর ১৪ ফেব্রুয়ারি ইউনাইটেড কর্মাশিয়াল ব্যাংক লিমিটেড (ইউসিবিএল) একই থানায় একই ধরনের অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করে। ওই মামলার অভিযোগে বলা হয়, প্রতারক চক্র নিজেদের ব্যাংকের লোক পরিচয়ে ব্যাংকটির বিভিন্ন এটিএম বুথে স্কিমিং ডিভাইস বসিয়ে গ্রাহকের এটিএম কার্ডের তথ্য চুরি করে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। ইউসিবিএল ছাড়াও ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড ও সিটি ব্যাংকের ৬টি বুথে স্কিমিং ডিভাইস বসিয়ে তথ্য চুরি করে একইভাবে কার্ড বানিয়ে প্রায় ২১ লাখ টাকা তুলে নেয়ার ঘটনা ঘটেছে। স্কিমিং ডিভাইসটি অন্তত ১২শ’ এটিএম কার্ডের তথ্য সংগ্রহ করেছে। তার মধ্যে জালিয়াত চক্রটি ৪০টি কার্ড তৈরি করে টাকা তুলে নিয়েছে। বাকি ১১শ’৬০টি কার্ড বানিয়ে টাকা তুলে নেয়ার প্রস্তুতি চলছিল। এটিএম কার্ড জালিঢয়াত চক্রটি শুধু বাংলাদেশেই সক্রিয় নয়। তারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও সক্রিয়। ওই চক্রের সদস্যরা শুধুমাত্র ২০১৬ সালেই বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থাৎ বাংলাদেশী মুপ্রায় প্রায় ১৬শ’ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। পুরো জালিয়াত চক্রটির সঙ্গে লন্ডনপ্রবাসী পলাতক দুই বাংলাদেশী ছাড়াও চার বিদেশী জড়িত। পলাতকদের গ্রেফতারে ইন্টারপোলের সঙ্গে যোগাযোগ চলছে। পলাতক বিদেশীরা রোমানিয়া, বুলগেরিয়া ও ইউক্রেনের নাগরিক। আর ইতিমধ্যে ফেতারকৃত বিদেশী পিওটর বিশ্বের ৪টি দেশে মোস্টওয়ান্টেড হিসেবে তালিকাভুক্ত। পিওটর মূলত জার্মানির নাগরিক। সে পোল্যান্ডের নাগরিক পরিচয়ে প্রতারণার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিল। তাছাড়া ২০১৭ সালের ১০ মার্চ র্যাব-১০ এর হাতে আন্তর্জাতিক এটিএম কার্ড জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত ১১ জন গ্রেফতার করা হয়। চক্রটির সঙ্গে আমেরিকা, কানাডা, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী আন্তর্জাতিক এটিএম কার্ড জালিয়াতি চক্রের যোগাযোগ রয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, এটিএম বুথ ও এটিএম কার্ডের মাধ্যমে জালিয়াতির ঘটনা শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই হচ্ছে। এমন অপরাধের আদ্যোপান্ত জানতে একটি বিশেষ আন্তর্জাতিক টিম গঠিত হয়েছে। যেসব দেশে এমন প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে, ওসব দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সমন্বয়ে ওই কমিটি গঠিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক প্রতারক চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন দেশে নিজের ভিন্ন নাম ঠিকানা দিয়ে প্রবেশ করে এমন অপরাধমূলক কর্মকা- চালাচ্ছে। সেজন্য বাংলাদেশে এটিএম বুথ ও এটিএম কার্ড জালিয়াতির দায়ে গ্রেফতার হওয়া বিদেশীদের পর্যায়ক্রমে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। আর যেসব দেশের নাগরিকরা গ্রেফতার হয়েছে, সেসব দেশকে ইতোমধ্যেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অবহিত করা হয়েছে। প্রয়োজনে জিজ্ঞাসাবাদের সময় আন্তর্জাতিক টিম বা ওইসব দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদেরও উপস্থিত থাকার সুযোগ রাখা হয়েছে। বিশ্বের কতগুলো দেশে কতটি সিন্ডিকেট এমন প্রতারণার সঙ্গে জড়িত তা নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা চলছে। জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে আদান-প্রদান করা হচ্ছে। শুধু এটিএম কার্ড নয়, বড় বড় চেইন শপে থাকা পজ মেশিনের মাধ্যমেও এমন প্রতারণার ঘটনা ঘটছে। কিন্তু এতোকিছুর পরেও এটিএম কার্ড জালিয়াতি থেমে নেই।
এদিকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সিরিয়াস ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগ এটিএম কার্ড জালিয়াতি করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়া এক নারীকে ধরিয়ে দিতে এক লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে। ওই নারী প্রতারক সাউথ ইস্ট ব্যাংকের এটিএম বুথ থেকে ইতোমধ্যেই বিভিন্ন সময় ১৩ লাখ টাকা তুলে নিয়েছে। এটিএম বুথে থাকা সিসি ক্যামেরায় তার ছবি পাওয়া গেছে। ওই ছবিও প্রকাশ করা হয়েছে। এটিএম বুথগুলোতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা মোতাবেক এন্টি স্কিমিং ডিভাইস লাগানোর কথা। কিন্তু যেসব ব্যাংক তাদের এটিএম বুথে এন্টি স্কিমিং ডিভাইস লাগায়নি, সেসব বুথ থেকে টাকা চুরির ঝুঁকি রয়েছে। এমনকি ক্লোন করা এটিএম কার্ড দিয়ে ওসব এটিএম বুথ থেকেই টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনাগুলো ঘটছে। এমন পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তদারকি করছে। যাতে ভবিষ্যতে আর এ ধরনের ঘটনা না ঘটে।
অন্যদিকে এটিএম কার্ড জালিয়াতির মামলাগুলোর তদন্তকারী সংস্থা পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ডিআইজি মনিরুল ইসলাম জানান, তদন্তের ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি জার্মানির নাগরিক পিওটর স্কেজেফান মাজুরেক (৫০), সিটি ব্যাংকের তিন কর্মকর্তা মোকসেদ আলী মাকসুদ (৪৫), রেজাউল করিম শাহীন (৪০) ও রেফাত আহমেদ রনিকে (৪২) গ্রেফতার করা হয়।