বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহর বিরুদ্ধে একাডেমিক, প্রশাসনিক ও আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির অর্ধশতাধিক অভিযোগ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। অধিকার সুরক্ষা পরিষদের উদ্যোগে বুধবার ক্যাফেটেরিয়ায় আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব অভিযোগ করা হয়।
গংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন অধিকার সুরক্ষা পরিষদের আহ্বায়ক ও বিজনেস স্টাডিজ অনুষদের সাবেক ডিন প্রফেসর ড. মতিউর রহমান। এ সময় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের সভাপতি প্রফেসর ড. আবু কালাম মোঃ ফরিদ উল ইসলাম, সাবেক সভাপতি প্রফেসর ড. গাজী মাজহারুল আনোয়ার, ড. তুহিন ওয়াদুদ, সাবেক সাধারণ সম্মাদক ও অধিকার সুরক্ষা পরিষদের সদস্য সচিব খায়রুল কবির সুমন, বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি ড. কমলেশ চন্দ্র রায়, সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান, নীল দলের সভাপতি ড. নিত্য ঘোষ, সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান মন্ডল প্রমুখ।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদালয়ের অ্যাকাডেমিক এবং প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। রাষ্ট্রপতি কর্তৃক দেওয়া নিয়োগের শর্ত লঙ্ঘন করে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ ক্যাম্পাসে দিনের পর দিন অনুপস্থিত থাকছেন। তিনি নিজেই অবৈধভাবে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্টাডিজ অনুষদ, সামজিক বিজ্ঞান অনুষদ এবং প্রকৌশল ও প্রযুক্তি অনুষদের ডিন, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান। কোষাধ্যক্ষ এবং ড. ওয়াজেদ টেনিং এ- রিসার্চ ইনস্টিটিউট এর পরিচালক পদেও তিনি দায়িত্বে আছেন। তিনি অনুপস্থিত থাকার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত কাজে স্থবিরতা সৃষ্টি হয়েছে। তিনি একাই অর্ধ শতাধিক কোর্স পড়ানোর জন্য দায়িত্ব নিলেও কোনে কোর্সেই তিনি পড়াননি। কিন্তু কোর্স পড়ানো বাবদ লাখ লাখ টাকা গ্রহণ করছেন। অনার্স-মাস্টার্স কোর্সের ধারাবাহিক মূল্যায়ন কোর্সের পরীক্ষা গ্রহণ করান কর্মচারীদের মাধ্যমে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি এবং এমফিল পর্যায়ে তিনি একটি সেশনেই ১৪ জনের তত্ত্বাবধায়ক হয়েছেন। চলতি সেশনে আরও ১৪জনকে নিয়ে থাকলে সংখ্যা প্রায় ২৮জন হবে। বাংলাদেশে এককভাবে এতজন গবেষককে একই সাথে গবেষণা তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে কারও থাকার নজির নেই। অবৈধভাবে বিশ্ববিদ্যালয়েলর আইন লঙ্ঘন করে ৭টি বিভাগের প্লানিং কমিটির সদস্য হয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক কর্মকাণ্ডে তিনি স্মরণকালের ভয়াবহ দুর্নীতি করে চলেছেন।
উপাচার্য ক্যাম্পাসে থাকেন না হেতু রেজিস্ট্রার ক্যাম্পাসে থাকেন না। পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগে লে.ক (অব) প্রকৌশলী মনোয়ারুল ইসলামকে পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাকে এ বিশ্বাবদ্যালয়ের প্রকল্প পরিচালকও করা হয়েছে। কিন্তু আজ অব্দি তিনি ক্যাম্পাসে থাকতে শুরু করেননি। কিন্তু লক্ষাধিক টাকা বেতন নিচ্ছেন। উল্লেখ্য, রেজিস্ট্রার এবং ওই পরিচালক নিয়োগের প্রক্রিয়াও যথাযথ হয়নি।
নিয়োগেও তিনি সীমাহহীন দুর্নীতি-অনিয়ম করেই চলেছেন। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে তিনি একটি পদ্ধতি চালু করেছেন। এই পদ্ধতিতে ৬০ নম্বরের একটি লিখিত পরীক্ষা তিনি গ্রহণ করেন। এই পরীক্ষার প্রশ্ন তিনি নিজেই করেন। তার পছন্দের প্রার্থীকে অনেক নম্বর দেন। পরে সাক্ষাৎকারে তাকে চাকুরি দেওয়াটা তার পক্ষে সহজ হয়। এমনও হয়েছে যতজনকে নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছ ততজনই আবেদন করেছেন, ততজনকেই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ইউনিভার্সিটি অব প্রফেসনালস এর উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. আবুল কাশেম মজুমদারকে প্রায় ৯টি নিয়োগ বোর্ডে রাখা হয়েছে। উপাচার্যের মাকে একাধিক নিয়োগ বোর্ডের সদস্য করা হয়েছে। উল্লেখ্য উপাচার্যের মা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকও নন। নিয়োগের শর্ত শিথিল করেও নিয়োগ দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। নন একাডেমিশিয়ান বেশ কয়েকজনকে নিয়োগ বোর্ডের সদস্য করা হয়েছে। ৫ম গ্রেডের কর্মকর্তা নিয়োগে সর্বোচ্চ বয়স চাওয়া হয়েছিল ৪০ বছর। কিন্তু একই গ্রেডের উপপ্রকৌশলী নিয়োগে বয়স চাওয়া হয়েছে ৫৮ বছর। যাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তার বয়স ৫৮ বছর। উপাচার্য তার ব্যক্তিগত সচিবকে আহ্বায়ক এবং ব্যক্তিগতসহকারীকে সদস্যসচিব করে নিয়োগ বোর্ড গঠন করে কর্মচারী নিয়োগ দিচ্ছেন।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ ক্ষমতার চরম অপব্যবার করছেন। ঢাকার লিয়াজো অফিসে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভা, নিয়োগ বোর্ড, আপগ্রেডেশন বোর্ডসহ অসংখ্য সভা করেন। এতে করে বিশ্ববিদ্যায়ের লাখ লাখ টাকা শুধু যাতায়ত বাবদ ব্যয় হচ্ছে। প্রাধিকারভুক্ত একটি গাড়ি তার পাওয়ার কথা থাকলেও তিনি ঢাকায় কয়েকটি গাড়ি ব্যবহার করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি ব্যক্তিগত সংস্থা জানিপপের কাজ নিয়মিত ব্যবহার করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীকে তিনি নিজের বাসায় রেখেছেন। তার জন্য নির্ধারিত রংপুরের বাসায় তিনি না থাকলেও সেখানে ১৭ জন কমকর্তা-কর্মচারী নিয়মিত বেতন পাচ্ছেন।
উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ম কানুনের তোয়াক্কা না করে চরম স্বেচ্ছাচারিতার পরিচয় দিচ্ছেন। জাতীয় সংসদ থেকে পাশ হওয়া ২০০৯ সালের ২৯ নং আইনের স্পষ্টত লঙ্ঘন করে চলেছেন। পাশকৃত আইন অনুযাীয় যাকে ডিন কিংবা বিভাগীয় প্রধান করার কথা তাকে না করে নিজেই পদ আকড়ে ধরে আছেন। বিভাগীয় প্রধান যাকে করার কথা তাকে না করে কোথাও নিজেই কোথাও আস্থাভাজনকে বসিয়েছেন। পদোন্নতির জন্য আবেদন করলেও সবাই সমানভাবে মূল্যায়ন পান না। আস্থাভাজনরা দ্রুতই পদোন্নতি পেলেও বাকিদের পদোন্নতি ঝুলে থাকে মাসের পর মাস। অনেক শিক্ষকের চাকুরি স্থায়ী করা হচ্ছেনা। অনেকের ছুটি বিষয়ক জটিলতা সৃষ্টি করা হয়েছে। পে-প্রোটেকশন কাউকে দেয়া হয়েছে কাউকে দেয়া হচ্ছে না।
সদ্য নিয়্গে পাওয়া শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনিয়মতান্ত্রিকভাবে বুনিয়াদী কোর্সে নিয়ে যান। সেখানে তার স্ত্রীর কাছে শাড়ি এবং পাঞ্জাবি কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে। জনশ্রুতি আছে, তিনি প্রশিক্ষণরত শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুবেলা করে পা ধরে সালাম করতে বাধ্য করেন। দু-চার জন ব্যক্তি নিয়মিত সেই বুনিয়াদী কোর্সে ক্লাস নেওয়ার নাম করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। এই প্রশিক্ষণের কোর্স কারিকুলামও নেই। ইউজিসিও বলছে এই অনুনমোদিত ফাউন্ডেশন কোর্স বন্ধ করতে এক কথায় এটি অবৈধ কোর্স। তিনি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য অভিন্ন ব্লেজার-প্যান্ট-শার্ট-টাই-জুতা চালু করেছেন। তার নির্ধারিত সেলুন থেকে অনেককে চুল কাটাতে হয়। জার্নাল বিক্রির অসৎ পথ বেছে নিয়েছেন। একেকজন কর্মচরীকে একই জার্নালের শত শত কপি কিনতে অনেকটাই বাধ্য করেছেন। অনেক শিক্ষকের কাছে অনেকটা জোর করেই হাজার হাজার টাকায় একই জার্নাল কিনতে বাধ্য করেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সাবের আহেমদ চৌধুরী। তাকে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য কাজে যুক্ত করা হয়েছে। তিনি বুনিয়াদী কোর্স থেকে প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক না হয়েও তিনি ফাউন্ডেশন কোর্সের সমন্বয়ক হয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের গবেষণা কাজে তাকে বিশেষজ্ঞ করা হয়। এমনকি শান্তি ও সংঘর্ষ বিভাগের সাথে না মিললেও তিনি বিশেষজ্ঞ হন। কেবল তিনি যাতে ক্লাস নিতে পারেন সেজন্য বুনিয়াদী কোর্স চলছে ঢাকায়।
২০১৯-২০২০ শিক্ষাবর্ষে উপাচার্যের একজন ঘনিষ্টজনকে স্পষ্টত দুর্নীতি করে ভর্তি করানোর মতো জালিয়াতির ঘটনাও ঘটেছে। কোন অনুষদে ওই প্রার্থী পেয়েছে প্রায় সর্বনিম্ন নম্বর, আর সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের পরীক্ষায় ওই পরীক্ষার্থী পেয়ে সর্বোচ্চ নম্বর। উল্লেখ্য ওই অনুষদের ডিন উপাচার্য নিজেই। প্রশ্ন প্রণয়ন হয়েছে তার বাসাস্থ কার্যালয়ে। ওই শিক্ষার্থীর বড় বোন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। ওই শিক্ষক উপাচার্যের আস্থাভাজন। ওই শিক্ষক ঢাকায় যখন প্রশিক্ষণরত তখনি একটি হলের সহকারী প্রাধ্যক্ষ হয়েছিলেন। ওই শিক্ষকের বাসায় তার যাতায়তও আছে। এই জালিয়াতির ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে।
উপাচার্য ঢাকাণ্ডযাওয়া আসা করার সময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে টিএ/ডিও নেন। অর্ধশতাধিক কোর্সশিক্ষক হলেও তিনি কোর্সগুলো পড়ান না, পরীক্ষাও নেননা। কিন্তু এ বিষয়ক পারিতোষক তিনি গ্রহণ করেন। যেসমস্ত কাজে সিটিং এলাউন্স নেই সেসব সভাতেও তিনি সিটিং এলাউন্স গ্রহণ করেন। লোকপ্রশাসন বিভাগের লাখ লাখ টাকা তিনি কোথায় ব্যয় করেছেন তা লিখিতভাবে বিভাগে দেননি। বিভাগের শিক্ষক লিখিত জানতে চাইলেও তা তিনি দেননি।
শেখ হাসিনা হল এবং ড. ওয়াজেদ ট্রেনিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট এর কাজ দীর্ঘদিন বন্ধ করে রেখেছিলেন। শেখ হাসিনা হলের কাজ সম্পন্ন হলে এতদিন আরও সহস্রাধিক ছাত্রী সে হলে থাকতে পারত। উপাচার্য নিয়মিত ক্যাম্পাসে থাকলে তিনি শিক্ষা ও গবেষার কাজে মনোযোগ দিলে কোন বিভাগে সেশনজট থাকত না। অনেক ক্ষেত্রে তিনি নিজেই সেশনজটরে কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন।
সিটি করপোরেশন থেকে তিনি ড. ওয়াজেদ রিাসার্চ এ- ট্রেনিং ইনস্টিটিউট এর পরিচালক হিসেবে নিজের নামে দুটি ট্রেড লাইসেন্স নিয়েছেন।
এমন পরিস্থিতিতে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘অধিকার সুরক্ষা পরিষদ’ গঠন করা হয়েছে। এই সংগঠনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোন কারো অধিকার প্রতিষ্ঠায় সবসময় সচেষ্ট থাকবে। এমনকি মুজিববর্ষে এ বিশ্ববিদালয়ে ন্যায় প্রতিষ্ঠা ও স্বচ্ছতা আনয়নের কাজে নিবেদিত থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়।