দিনে কৃষকদের সহযোগিতা ও রাতে লেখাপড়া শেখানো হয় কাজী এমদাদুল হক নৈশ স্কুলে। ইতোমধ্যে ১১ গ্রামের ১৮টি স্থানে নৈশ স্কুলের মাধ্যমে ৬ শতাধিক অক্ষরজ্ঞানহীন কৃষককে পাঠদান করিয়েছেন তিনি।
কাজী এমদাদুল হক গ্রামের একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। কিন্তু সেখান থেকে কোনো বেতন পান না। বাড়িতে ছাত্রছাত্রীদের পড়িয়ে মাসে ১০ হাজার টাকার মতো উপার্জন করেন।এই টাকা দিয়ে নিজের সংসার ও কৃষকদের মাঝে খরচ করেন তিনি। বছরের পর বছর কৃষকদের রক্ষায় কাজ করছেন তিনি। কাজী এমদাদুল হক ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার দৌলতপুর গ্রামের কাজী আবদুল ওয়াহেদের ছেলে। সার্বক্ষণিক কৃষকদের সুবিধা-অসুবিধায় পাশে থাকায় ইতোমধ্যে পেয়েছেন ‘কৃষকের বন্ধু’ খেতাব।
প্রতিদিন শীতের রাতে উপজেলার পারিয়াট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে জ¦লে আলো। সেখানে গেলে দেখা যায়, প্রায় ২০ জন কৃষকের সামনে সিলেট, চক ও ব্যঞ্জন বর্নের বই। আর তাদের শিক্ষক এমদাদ বলাক বোর্ডে অক্ষর লেখা শেখাচ্ছেন। সেখানেই কথা হয় কাজী এমদাদুল হকের সঙ্গে।
তিনি জানান, ১৯৮৮ সালে কোলাবাজার ইউনাইটেড হাইস্কুল থেকে এসএসসি, ১৯৯০ সালে খুলনা আজম খান কমার্স কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন কাজী এমদাদুল হক। বিএ পরীক্ষা শেষে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে চলে যান জামালপুর। চাকরি ছেড়ে চলে আসেন আবার গ্রামে। নিজে কৃষিকাজের পাশাপাশি গ্রামের একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। সেখানে বেতন না থাকায় বাড়িতে ছাত্র পড়িয়ে মাসে হাজার দশেক টাকা আয় করেন। এর মধ্যে ৬ হাজার টাকা সংসারের পেছনে খরচ করেন। বাকি টাকা কৃষকদের পেছনে ব্যয় করেন। স্ত্রী, দুই মেয়ে আর এক ছেলে নিয়ে তার সংসার।
কৃষকের এই বন্ধু বলেন, কৃষকরাই জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাদের জন্য আমাদের সবারই কিছু করা উচিত। তারা সুস্থ থাকলে দেশ ভালো থাকবে। এই চিন্তা মাথায় নিয়ে কৃষকদের পাশে থাকার চেষ্টা করি।
২০০৪ সাল থেকে এই ইউনিয়নকে নিরক্ষরমুক্ত করার জন্য নৈশ স্কুল চালু করেছেন। ইতোমধ্যে ইউনিয়নের ১১টি গ্রামের ১৮টি স্থানে নৈশ স্কুলের মাধ্যমে ৬ শতাধিক অক্ষরজ্ঞানহীন কৃষককে পাঠদান করিয়েছেন।
বর্তমানে ১৯তম স্থানে নৈশ স্কুলে পাঠদান পরিচালনা চলছে। কেউ যেন আর টিপসই ব্যবহার না করেন। অন্তত নিজের নাম, বাবার নাম, তাদের ঠিকানা লিখতে পারেন এজন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন তিনি।শিক্ষক এমদাদুল হক বলেন, প্রখর রোদে কাজ করার সময় অনেক কৃষকের মাথায় কিছু থাকে না। এমন প্রায় এক কাজার কৃষককে মাথাল সরবরাহ করেছি।
এ ছাড়া জমিতে রাসায়নিক সার বা কীটনাশক ব্যবহার করার কৃষকরা নাকে ও মুখে কিছু ব্যবহার করেন না। তিনি সেসব কৃষকদের মাস্ক প্রদান করেন। এ ছাড়া কাজ শেষে বাড়ি ফিরে সাবান দিয়ে হাত-পা ধোয়ার অভ্যাস করাতে কৃষকদের মাঝে সাবানও তুলে দেন। এসব তিনি কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে দিয়ে থাকেন। ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে কৃষকদের তিন মাস পর পর ফ্রি ব্লাড গ্রুপিং করেন তিনি। এ ছাড়া তিনি গরিব ও দুস্থ কৃষকদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করেন।
কথা হলো কাজী এমদাদুল হকের নৈশ স্কুলে পারিয়াট গ্রামের রাজ্জাক মালিথা (৫৫) নামের এক কৃষকের সঙ্গে। তিনি বলেন, আগে টিপসই দিয়ে কাগজ পত্রের কাজ করতাম। দুই মাস এখানে আসছি। সারাদিন মাঠে কাজ করার পর এশার নামাজের সময় এখানে আসি। এখন নিজের নাম, বাবা ও মায়ের নামসহ ঠিকানা লিখতে পারি। আরেক কৃষক ওসমান আলী সরদার (৬০) বলেন, এমদাদ ভাই আমাদের খুব ভালো বন্ধু। আমাদের অক্ষর লেখা শেখানোর পাশাপাশি তিনি মাথাল, সাবান ও মুখের মাস্ক বিনামূল্যে দেন।
তিনি বলেন, অক্ষরজ্ঞান না থাকায় কৃষি বিভাগ থেকে সচেতনতামূলক যেসব লিফলেট দেয়া হয়, সেগুলো কৃষকরা পড়তে পারেন না। তাই ইউনিয়নের ১১টি গ্রামের বিভিন্ন স্থানে নৈশ বিদ্যালয় প্রতিষ্টার উদ্যোগ নেই।
৩নং কোলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আইয়ুব হোসেন বলেন, এমদাদ যা করছেন, তা জনপ্রতিনিধি হয়েও আমরা করতে পারি না। তিনি যে টাকা উপার্জন করেন, তা পরিবারের পেছনে কম খরচ করে এলাকার মানুষের পেছনে ব্যয় করেন।
কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. জাহিদুল করিম বলেন, এমদাদুল হকের কাজে স্থানীয় কৃষি বিভাগ মুগ্ধ। তাই কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে এমদাদুল হকের বাড়িতে কৃষি পাঠাগার করে দেয়া হয়েছে। সেখানে একটি আলমারিসহ কিছু বইও দেয়া হয়েছে।