কক্সবাজারের সীমান্ত পথ দিয়ে মরণ নেশা ইয়াবার সাথে পাল্লা দিয়ে সম্প্রতি সময়ে বেড়েছে মানবপাচার। পাচারের নামে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে রোহিঙ্গাসহ এদেশের সহজ-সরল মানুষকে। সোনার হরিণের আশায় কেউবা প্রলোভনে পা রাখছেন অন্ধকারের জগতে। তাই সবকিছু উপেক্ষা করে হাতের মুঠোয় জীবন নিয়ে অন্ধকারে পাড়ি জমায় সমুদ্রযাত্রায়। মানব পাচারে নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে কক্সবাজার সদর, উখিয়া, টেকনাফ ও মহেশখালীসহ জেলার সমুদ্র তীরবর্তী এলাকাকে। তবে সম্প্রতি সময়ে যারা পাচারে পা রাখছেন তাদের সিংহভাগই রোহিঙ্গা। সূত্রমতে, স্থানীয় প্রভাবশালী গোষ্ঠী মূলত মানব পাচারের মূল হোতা। তারা দালালচক্রের ছায়া হিসেবে কাজ করে। এর সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় অসাধু সদস্যের জড়িত থাকারও অভিযোগ আছে। পাশাপাশি অতীতের মানবপাচার মামলা গুলি দীর্ঘ সময় ধরে ঝুলে থাকায় রোধ হচ্ছে না মানব পাচারের মতো জঘন্যতম অপরাধ। খোঁজ খবর নিয়ে জানা যায়, কক্সবাজার বিশেষ আদালতে বিচারাধীন বেশির ভাগ মানবপাচার মামলার কোনও ধরনের অগ্রগতি নেই। রয়েছে সাক্ষী ও ভিকটিমের জবানবন্দির অভাব। পাশাপাশি থেমে নেই বিচারক সংকটসহ নানা আইনি জটিলতা। যেকারনে বছরের পর বছর ঝুলে রয়েছে চার শতাধিক মানবপাচার মামলা। কক্সবাজার জেলা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত জেলার বিভিন্ন থানায় মানবপাচার আইনে মামলা হয়েছে ৪২২টি। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে দুই হাজার ৮৯ জনকে। গ্রেফতার করা হয়েছে ৭৫০ জনকে। পাচারের সময় উদ্ধার করা হয়েছে তিন হাজার ২২৩ জন নারী, পুরুষ ও শিশুকে। থানার রেকর্ড অনুযায়ী, ৩৩টি মামলা ছাড়া সবকটি মালমায় চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত মানবপাচার আইনে মামলা হয়েছে ৪৬টির অধিক। মৎমধ্যে পতিতা সংক্রান্ত মানবপাচার মামলা ছিল ১৬টি। এতে আসামি করা হয় ১২০ জন। সাগর পথে মালয়েশিয়া পাড়ি দেয়ার সময় উদ্ধার করা হয়েছে প্রায় ৯৭৭ জনকে। তবে উদ্ধারকৃত সকলেই ছিল মিয়ানমার নাগরিক। এ সময় পাচারকাজে জড়িত প্রায় ৭৭ জন দালালকে গ্রেফতার করা হয়। এসব মামলা এখনও তদন্তাধীন রয়েছে বলে জানা গেছে। এদিকে আদালত সূত্রে জানা যায়, মানবপাচারের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার কারণে ২০১২ সালে কক্সবাজারে গঠিত হয় আলাদা ট্রাইব্যুনাল (বিশেষ আদালত)। কিন্তু গত ৭ বছরে মানবপাচার আইনের কোনও মামলা নিষ্পত্তি হয়নি। অথচ, জামিনে গিয়ে পাচারকারী সিন্ডিকেটের সদস্যরা আবারও ফিরে গেছে পাচারের মতো অনৈতিক জঘণ্য কাজে। কক্সবাজারসহ দেশের অন্যান্য এলাকার সংঘবদ্ধ পাচারকারীরা রোহিঙ্গা শিবিরের পাচারকারীদের সঙ্গে সিন্ডিকেট করে উপকূলীয় ও সীমান্ত এলাকায় রমরমা পাচার কারবার চালিয়ে যাচ্ছে। তারেই বড় প্রমান মিলে মঙ্গলবার (১১ ফেব্রুয়ারি) সাগর পথে মালয়েশিয়া যাত্রকালে সেন্টমার্টিনের চেরাদ্বীপে ট্রলার ডুবির ঘটনায় ১৫ জন নিহত ও ৭৭ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। এদিকে মানবপাচার আইনের মামলার অগ্রগতি নিয়ে কক্সবাজার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিশেষ পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) নুরুল ইসলাম বলেন, মানবপাচার মামলাগুলোর কোনও অগ্রগতি নেই। এগুলো অনেকটাই থমকে আছে। কারণ, স্পেশাল আদালতের প্রথম বিচারকের পদটি খালি রয়েছে গত এক বছর ধরে। বিশেষ করে মামলার ভিকটিম, বাদী, সাক্ষী ও আসামিরা একেকজন একেক এলাকার বাসিন্দা। এ কারণেও একটি নির্দিষ্ট তারিখে মামলার পক্ষভুক্ত সবাইকে আদালতে উপস্থিত করা সম্ভব হয় না। এসব কারণেই মামলা নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না। এছাড়া, মামলার তদন্তে পুলিশের সীমাহীন দুর্বলতাও মামলা নিষ্পত্তি করতে না পারার অন্যতম প্রধান কারণ। কক্সবাজার পুলিশ সুপার মো. এবিএম মাসুদ হোসেন বিপিএম বলেন, প্রতি বছর শীতকাল আসলেই মানবপাচার বেড়ে যায়। কারণ দালালরা এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে মানবপাচার শুরু করে। তবে সম্প্রতি সময়ে যারা এই কাজে পা দিয়েছে তারা সিংহভাগেই রোহিঙ্গা। মূলত স্থানীয় দালালরা নানা প্রলোভন দিয়ে রোহিঙ্গাদের পাচার করছে। পুলিশ সুপার আরো বলেন, ১১ ফেব্রুয়ারি পাচারের সময় যেসকল রোহিঙ্গা ট্রলার ডুবিতে মারা গেছে তাদেরকে টেকনাফের বাহারছড়া ও উখিয়া-টেকনাফের মাঝামাঝি সীমান্ত পয়েটে দিয়ে বোটে তুলা হয়েছিল। এই পাচারের সাথে যারা জড়িত ছিল ইতোমধ্যে তাদের তিন দালালকে গ্রেফতারকরা হয়েছে। তারা হল টেকনাফের বাহারছড়া আইয়ুব, রফিক ও সাদ্দাম। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ২০১০ সালের দিকে সর্বপ্রথম কক্সবাজারের টেকনাফ পয়েন্ট দিয়ে সাগরপথে মালয়েশিয়ায় মানবপাচারের সূচনা হয়। এরপর ২০১২ সালের পর থেকে মানবপাচারের প্রবণতা ভয়াবহ আকার ধারণ করে। পরবর্তীতে টেকনাফ ছাড়াও জেলার উখিয়া, রামু, চকরিয়া, কুতুবদিয়া, কক্সবাজার সদর ও মহেশখালীসহ বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে অন্ধকারে সাগরপথে মালয়েশিয়া পাচারের ঘটনা বেড়ে যায়।