জমির দালালদের মতোই নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলায় গ্রাম্য মাতবর তথা সালিশকারীদের উৎপাত বৃদ্ধি পেয়েছে। তথাকথিত এ সকল মাতাব্বরদেরকে স্থানীয়ভাবে বলা হয় “পরধাইন্না”। পুরো উপজেলার ২টি পৌরসভা ও ১০টি ইউনিয়নের ৩১৬টি গ্রাম জুড়ে পরধাইন্না তথা সালিশকারীদের অপতৎপরতায় সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের অন্ত নেই। এখানে সালিশকারীদের ব্যবসা জমজমাট। দিনে দিনে তারা হয়ে উঠছে অপ্রতিরোধ্য।
সালিশকারী যারা:
আড়াইহাজার উপজেলায় ২টি পৌরসভা ও ১০টি ইউনিয়নের ৩১৬টি গ্রামের বিভিন্ন এলাকা চষে বেড়াচ্ছে প্রায় ৫’শ সালিশকারী। গ্রামের প্রভাবশালী ব্যক্তিরাই পরধাইন্না বা মাতাব্বর হিসাবে পরিচিত। মূলত:প্রধান শব্দটিকে অপভ্রংশ করে গ্রামের লোকজন “পরধাইন্না” বলে ডাকে। সালিশ বসানোর মাধ্যমে পরধাইন্নারাই গ্রামের সকল বিচার আচার করে থাকে। সালিশ ব্যতিত তারা মূলত: বেকার। তাদের কোন কাজ- কর্ম থাকেনা। গ্রামে গ্রামে ঘুরে সালিশ করেই তারা সংসার চালায়।
সালিশকারীদের কর্মকান্ড:
গ্রামের জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধ বা হামলা মামলার ঘটনাগুলোই তাদের মূল পুঁজি। গ্রামে জায়গা জমি নিয়ে কোন ঝামেলা অইলে পরধাইন্নারাই সমাধান দেয়। যে পক্ষ উৎকোচ বেশী দেয় পরধাইন্নারা তার পক্ষেই রায় দেয়। সুষ্ঠু বিচার না পেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ রায় মানতে না চাইলে পরধাইন্নারা উল্টো তাদের হয়রানি করে। একজনের যায়গা অন্যজনরে বুঝাইয়া দেয়। কাউরে থানায় যাইতে দেয়না। কেউ থানায় যাইতে চাইলে পরধাইন্নারা তারে রাস্তায় আটকাইয়া মারপিট করে একঘইরা করার হুমকি দেয়। পরধাইন্নাগো জ¦ালায় আমরা অনেক কষ্টে আছি। তানিরা অনেক কাল (অত্যাচার) করে। এইত্তা লেইক্কা কি অইবো?” এই সকল অভিযোগ স্থানীয় নিরহ গ্রাম বাসীর।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বয়ান :
এ ব্যাপারে আলাপকালে কয়েকজন ইউপি চেয়ারম্যান সালিশকারীদের উৎপাত ও বিচার বানিজ্যের কথা স্বীকার করেন। বিশনন্দী ইউপি চেয়ারম্যান ভিপি সিরাজুল ইসলাম জানান, আড়াইহাজারে এখনো সভ্যতার পুরোপুরি বিকাশ ঘটেছে- এ কথা বলা যাবেনা। গ্রাম পর্যায়ে শিক্ষার হার ইদানীং বাড়লেও পূর্বের অজ্ঞানতার অন্ধকার কাটেনি। যার দরুন গ্রাম্য সমাজ ব্যবস্থায় কোন ঘটনা ঘটলে তার সমাধানের জন্য অনেকটা অনিবার্য ভাবেই সালিশ বসে। সালিশ মানেই বিবাদমান দুটি পক্ষ। সালিশরাও কাজ করেন দুটি পক্ষের হয়ে। যে কোন একটি পক্ষে বেশি পক্ষপাতিত্ব করার ফলে অধিকাংশ সময়ে সমস্যার সুষ্ঠুসমাধান সম্ভব হয়ে উঠেনা। সালিশকারীদের বিরুদ্ধে প্রায়শ টাকা খাওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায় বেশ মোটা দাগে। টাকা দিয়ে কি না হয়! যাদের টাকার জোর বেশী তারা টাকা দিয়ে সালিশ বা পরধাইন্নাদের হাত করে নেয়। বিচারে জিতার জন্য টাকা দিয়ে সালিশকারীদের টাকা দিয়ে ভাড়া করা একটি অসভ্য রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। বিচার বসলেই টাকা দিতে হয় মাতাব্বরদের তাই মিমাংষা না করে ঝসড়া লাগিয়ে রাখেন এক শ্রেনীর গাষ্ট্রম্যামাতাব্ব্র গণ।
সালিশকারীরা অপ্রতিরোধ্য:
গ্রামের সালিশকারীরা এখন জড়িত হয়ে পড়েছে রাজনৈতিক দলবাজির সাথে। সব সময় ক্ষমতাসীন দলের সালিশকারীদের চাহিদা বেশী। তাদের রেটও বেশী। কেউ পৈতৃক সুত্রে পরধাইন্না বা সালিশকারী, কেউবা দলবাজির কারণে আবার কেউ ন্যায় বিচারক হিসেবেই গ্রামে সর্বজনবিদিত পরধাইন্না। ফলে সালিশ নিয়ে আজকে হরহামেশাই বাণিজ্য হচ্ছে। দলবাজির সাথে জড়িত পরধাইন্নারা টাকা হজম করতে না পারলে সালিশটি নিয়ে আসে আড়াইহাজার থানায়। থানায় মিমাংসা না হলে বিষয়টি শেষ পর্যন্ত কোর্ট অবধি গড়ায়। এভাবেই দিন দিন বাড়ছে মামলার সংখ্যা। বছরের পর বছর নিভৃতে কাঁদছে বিচারের বাণী। থানার গোল চত্বরে ভাড়ার আসে মাতাব্বরগণ।
কাগজ বেশী বুঝলে রেট বেশী
মাতাব্বরদের মধ্যে যারা দলিল, পর্চা, নকশা বেশী বুঝেন এদের রেট একটু বেশী। আবার তাদের বিচারে পাওয়া যেন সোনার হনিণ। যদি কেউ বিচারের জন্য ডাকেন তাদের অগ্রিম টাকা দিতে হয়। এরপর ও যদি অন্য কেই বেশী টাকা দেয় চলে যায় তার কাছে। এই ভাবে হয়রানি হচ্ছে নিরীহ জনগণ।
এ ব্যাপারে আড়াইহাজার থানার ওসি নজরুল ইসলাম বলেন, সালিশ নিয়ে মাঝে মধ্যে আমাদের কাছে অভিযোগ আসে। তখন আমরা সমস্যার সমাধান করে দেই। সালিশের নামে কাউকে ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত করার অধিকার কারো নেই। এমন সুনির্দিস্ট অভিযোগ পেলে আমরা আইনি পদক্ষেপ নিয়ে থাকি। তবে প্রতিটি গ্রামে মাতাব্বর আছেন বলে স্বীকার করেন ওসি।