নওগাঁর আত্রাইয়ে ফসলি জমিতে অবাধে চলছে পুকুর খনন। প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এক শ্রেনীর অসাধুরা পুকুর খনন উৎসবে মেতে উঠেছে। পুকুর খননের জন্য জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদন করার পরই অনুমোদনের অপেক্ষায় না থেকে তরিঘরি করে খনন কাজ করা হচ্ছে। ফসলি জমিতে পুকুর খনন করা হলে একসময় খাদ্য ঘাটতির আশঙ্কা করছেন কৃষি বিভাগ।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এবং আত্রাই উপজেলা কৃষি ও মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, গত ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে জেলায় আবাদি জমির পরিমান ছিল ২ লাখ ৭২ হাজার ২৭৬ হেক্টর। ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে ছিল একই পরিমাণ। ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে ছিল ২ লাখ ৭৩ হাজার ৬১২ হেক্টর এবং ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে ছিল ২ লাখ ৭৩ হাজার ৯৯৮ হেক্টর। গত ৫ বছরে আবাদি জমির পরিমাণ কমেছে ১ হাজার ৭২২ হেক্টর। আত্রাই উপজেলায় বর্তমানে ফসলি জমির পরিমাণ ২৪ হাজার ১০০ হেক্টর। গত ৫ বছরের ব্যবধানে ২০০ হেক্টর আবাদি জমি কমেছে। অপরদিকে, বর্তমানে সরকারি পুকুর রয়েছে ২২৪ টি এবং ব্যক্তিগত পুকুর রয়েছে ২ হাজার ৮৩৭টি। গত ৫ বছরের ব্যবধানে ব্যক্তিগত পুকুর বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ২৫০টি।
‘জমির প্রকৃতি পরিবর্তন করা যাবে না’Ñএমন সরকারি নীতিমালা থাকলেও এ উপজেলায় ফসলি জমিগুলোকে পরিণত করা হচ্ছে পুকুরে। এক শ্রেণির অসাধু পুকুর ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন মহলকে নিয়ন্ত্রন করে পুকুর খনন করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এতে করে পুকুর ব্যবসায়ীরা আঙুল ফুলে কলা গাছ বনে যাচ্ছেন। পুকুর ব্যবসায়ীদের পুকুর খনন করতে টাকা খরচ করতে হয়না। ইটভাটার মালিকরা তাদের প্রয়োজনে ইচ্ছেমত মাটি কেটে ভাটাই নিচ্ছেন। এতে করে পুকুর মালিকরা তাদের পুকুর খনন করতে যেমন টাকা খরচ করতে হচ্ছে না। তেমনি ভাটায় মাটি পেয়ে সুবিধা নিচ্ছেন ইটভাটার মালিকরা। জমির মালিকরা না বুঝে কয়েক বছরের জন্য সামান্য টাকায় চুক্তিবদ্ধ হয়ে তাদের মূল্যবান ফসলী জমি লিজ দিচ্ছেন।
উপজেলার হাটকালুপাড়া ইউনিয়নের দ্বীপ চাঁদপুর গ্রামে এলজিইডি রাস্তা সংলগ্ন প্রায় ২০ বিঘা এলাকা জুড়ে স্ক্যাবিটর দিয়ে পুকুর খনন করছেন গ্রামের সুমন তালুকদার। ওই জমিতে পুকুর খনন করে সেই মাটি স্থানীয় মেসার্স ভাই ভাই ট্রেডার্সের ইটভাটার মালিক আসাদুজ্জামান টপি মোল্লার ভাটায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
দ্বীপ চাঁদপুর গ্রামের আজাদ হোসেন বলেন, যে জমিতে পুকুর খনন করা হচ্ছে সেখানে একসময় ২/৩ টা ফসল হতো। গত কয়েক বছর থেকে গভীর নলকূপ(ডিপের) পানি দিয়ে মাছ চাষ করা হচ্ছে। এখন সেখানে পুকুর খনন করা হচ্ছে। চাচা আতাবর তার ৮ শতাংশ জমি লিজ দিয়েছেন। এভাবে যদি আবাদি জমিতে পুকুর খনন করা হয় তাহলে একসময় আবাদি জমি কমে যাবে এবং খাদ্য ঘাটতি হবে বলে মনে করেন তিনি।
দ্বীপ চাঁদপুর গ্রামের পুকুর খনন মালিক সুমন তালুকদার বলেন, প্রতি বছর ২৮ হাজার টাকা হিসেবে ১২ বছরের জন্য বিঘা প্রতি ৩ লাখ ৩৬ হাজার টাকা হিসেবে ১৫ বিঘা জমি ইজারা নিয়েছি। পুকুর খননের জন্য জেলা প্রশাসক বরাবর একটা আবেদন করেছি। এরপর তিনি কৃষি ও মৎস্য কর্মকর্তা বরাবর তাদেরকে প্রতিবেদন পাঠাতে বলা হয়। তবে অনুমোতি না পেয়ে পুকুর খনন করা হচ্ছে। সপ্তাহ খানেকের মধ্যে পুকুর খনন কাজ শেষ হয়ে যাবে।
আত্রাই উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কেএম কাওছার হোসেন বলেন, ফসলি জমির পরিমাণ কমছে। গত দেড় মাসে পুকুর খনন বিষয়ে প্রায় ৪৪ টির মতো প্রতিবেদন জেলা প্রশাসক বরাবর দিয়েছি। যেগুলোতে প্রায় এক ফসলের আবাদ হয়ে থাকে।
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা পলাশ চন্দ্র দেবনাথ বলেন, দ্বীপ চাঁদপুর গ্রামে সুমন তালুকদারের যে পুকুর খনন করা হচ্ছে তার পাশে আলু ও গমের ক্ষেত আছে। পুকুর খনন করার বিষয়ে জেলা প্রশাসক বরাবর একটা প্রতিবেদন দিয়েছি। তবে পুকুর খনন করা হলে লাভ বেশি হবে।
সহকারী কমিশনার (ভূমি) আরিফ মুর্শেদ মিশু বলেন, ডিসি স্যার যদি পুকুর খননের জন্য অনুমোতি দেয় তাহলে খনন করতে পারবে। দ্বীপ চাঁদপুর গ্রামের পুকুর খননের প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। তবে কি প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে তা বলা যাবে না।
এ ব্যাপারে আত্রাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ছানাউল ইসলামের সাথে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে তিনি মোবাইল ফোনে রিসিভি না করায় কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
নওগাঁ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো: সিরাজুল ইসলাম বলেন, ঘরবাড়ি, ইটভাটা ও পুকুর খননের কারণে প্রতি বছরই কমছে আবাদি জমির পরিমাণ। অপরিকল্পিত ভাবে পুকুর খনন করা হচ্ছে। এটি একটি জাতীয় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জেলা প্রশাসন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও ভূমি মন্ত্রনালয় উদ্যোগ নিলে আবাদি জমি রক্ষা করা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।