বঙ্গবন্ধুর প্রতি অন্ধ ভক্তের একজন মানুষ আবদুস সোবাহান। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষন শুনতে ভালো বাসেন। বয়স নব্বইয়ের কোঠায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের জন্য এখনও কেঁদে বুক ভাসান তিনি। বঙ্গবন্ধুর জন্য, বঙ্গবন্ধুর পরিবারের জন্য এবং বঙ্গবন্ধুর মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য এখনও আবদুস সোবাহান দুই রাকাত করে নফল নামাজ আদায় করে কান্নাকাটি করেন। প্রতি ওয়াক্ত নামাজ আদায়ের পর তিনি দু’হাত তুলে আল্লাহর কাছে দোয়া করেন বঙ্গবন্ধুকে জান্নাতবাসি করার জন্য। দোয়া করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দীর্ঘ দিন বেঁচে থাকার জন্য এবং কেউ যেন তার ক্ষতি করতে পারে না-এর জন্য। এর আগে বঙ্গবন্ধুকে বাঁচানোর জন্য সোবাহান একটানা ১২ মাস রোজাও করেন। বঙ্গবন্ধু প্রেমিক ওই সোবাহানের বাড়ি কুড়িগ্রামের রাজিবপুর উপজেলার ব্রহ্মপুত্র নদ বিচ্ছিন্ন দুর্গম চরে।
সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু পাগল ওই সোবাহানের কাহিনি জানতে সরেজমিনে বাড়িতে গিয়ে কথা হয় তার সঙ্গে। রাজিবপুর উপজেলা শহর থেকে প্রায় ১০/১২ কিলোমিটার দূরে মোহনগঞ্জ ইউনিয়নের ব্রহ্মপুত্র বিচ্ছিন্ন বড়বেড় চরে আবদুস সোবাহানের বাড়ি। মটরসাইকেল যোগে ৬ কিলোমিটার যাওয়ার পর শ্যালো মেশিন চালিত নৌকায় ৩০ মিনিট সময় লাগে। এরপর পায়ে হেটে বালুচর পাড়ি দিয়ে সময় লাগে ৩০/৪০ মিনিট। বাড়ি খুঁজে দুপুরের দিকে দেখা মিলল আবদুস সোবাহানের। তার স্ত্রী জয়গন বেওয়া মারা গেছেন ২বছর আগে। ৬ মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। ২ ছেলের মধ্যে একজন গাজীপুরের কোনাবাড়িতে থাকেন। আরেক ছেলে চরেই বসবাস করেন। এই ছেলের ঘরেই সোবাহানের খাবার দাবার হয়। বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ঘটনাবলী জানতে চাইলে তার প্রতিবেশি স্কুল শিক্ষক শহীদুল্লাহ হক মাষ্টারের বাড়িতে বসতে দেয়া হয়।
আব্দুস সোবাহান বলতে শুরু করেন তার জীবনের ঘটনাবলী। আমি লেহাপড়া (লেখা পড়া)জানি না। বাবার সংসারের ক্ষেতখামারে কাজ করতাম। যুদ্ধের সময় আমার বয়স ৩০’র মতো হবে। তখন আমি নিয়মিত রেডিও শুনতাম। ক্ষেতখামারে গেলেও সঙ্গে রেডিও নিয়ে যেতাম। রেডিও’তে বঙ্গবন্ধুর ভাষন শুনতাম। তাঁর ভাষন আমার খুব ভালো লাগত। ৬৯’র নির্বাচনে শেখ মজিবুর রহমান নিরংকুশ ভাবে বিজয়ী হলেও পাকিস্তানারী ক্ষমতা দেয়নি। দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর যে ভালোবাসা দেখিয়েছেন তা শুনে আমি মুগ্ধ হই। দেশের মানুষের অধিকার আদায়ে বঙ্গবন্ধু যে ভাবে সংগ্রাম করেছেন, দেশের মানুষের নির্যাতনের প্রতিবাদ করেছেন। তা শোনার পর আমার ভিতরটা কেমন যেন হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু স্বচক্ষে না দেখেও তার প্রতি আমার ভালোবাস, শ্রদ্ধাবোধ জন্মে ছিল গভীর ভাবে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি আমার ভালোবাস আর শুদ্ধাবোধ হৃদয়ে গেঁথে গেল যখন পূর্ব পাকিস্তানীদের হাতে বার বার নির্যাতনের শিকার হলো, জেল খাটল বঙ্গবন্ধু। মানুষটা নিজের জন্য না ভেবে দেশ ও দেশের মানুষকে মুক্ত করতে হাজারো নির্যাতন সহ্য করেছেন। বঙ্গবন্ধুর নাম শুনলেই আমার ভিতরটা কেমন যেন হয়ে ওঠে।
আব্দুস সোবাহান বলেন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালো রাতে পাকবাহিনীরা বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুরকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়ার খবর সর্ব প্রথম রেডিও’তে শুনতে পাই। এ খবর শোনার পর আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলাম না। ঘরে গিয়ে শুয়ে পরলাম। যোহরের নামাজ আদায় করে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করে আল্লাহর দরবারে হাত উঠালাম দোয়া করলাম ‘পাক হায়েনাদের হাতে বন্দি বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের কোনো ক্ষতি তুমি হতে দিও না। তাদের হাত থেকে বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করো, তাঁকে সুস্থ অবস্থায় দেশে ফেরার ব্যবস্থা করো। এরজন্য তোমার কাছে আমি ওয়াদা করছি পুরো এক বছর রোজা করব আমি।’ আল্লাহর দরবারে ওয়াদা করার পরের দিন থেকে আমি রোজা থাকা শুরু করলাম। দিন তারিখ মনে নাই। তখন ছিল চৈত্র মাস। আবার চৈত্র মাস আসলে আমি রোজা থাকা বন্ধ করি। মাঝে দুই ঈদে রোজা থাকা হয়নি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান দেশে ফেরার পর আমি এত খুশি হয়েছিলাম যা আমি প্রকাশ করতে পারব না। মনে মনে ভাবছিলাম মহান আল্লাহ আমার কথা শুনেছেন। বঙ্গবন্ধু যখন দেশে ফেরে তখন আমার রোজা এক বছর পূরণ হয়নি। তারপরও আমি রোজা করে বছর পূর্ন করি। কেননা এক বছর রোজা থাকার ওয়াদা করেছিলাম আল্লাহর কাছে। এই দীর্ঘ ১২ মাস রোজা করতে আমার সমস্যাও হয়েছিল অনেক। আমার বউ রোজা থাকতে দিতে চাইত না। এ কারণে অনেক শেষ রাতের সেহরি খাবার থাকত না। সেহরি না খেয়েই আমি রোজা থাকছি। শেষ রাতে না খেয়ে যে কতদিন রোজা ছিলাম তা আমি বলতে পারব না।
দেশে তো তখন মুক্তিযুদ্ধ চলছিল, আপনি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি কেন-এমন বিষয়ে তিনি বলেন, আমি তখন অসুস্থ ছিলাম। তাছাড়া আমার বাবা মা আমাকে যুদ্ধে যেতে দিত না। যুদ্ধে না গেলেও আমি মুক্তিবাহিনীদের জন্য আমি অনেক সহযোগিতা করেছি, রান্না করে খাবার নিয়ে দিয়েছি। আমাদের চরে মুক্তিবাহিনীদের ৭টি ক্যাম্প ছিল। তার মধ্যে ৩টি ক্যাম্পে মুক্তিবাহিনীদের নিয়মিত খাবার দিয়েছি আমি। বড়বেড় চরের ইসহাক সরকারের বাড়িতে, সন্নাসীকান্দি কাচারি স্কুলে ও আবদুল হাইর বাড়িতে মুক্তি বাহিনীদের ক্যাম্প ছিল। আমি বাড়িতে রান্না করে ওই তিনটি ক্যাম্প খাবার নিয়ে দিয়ে আসতামভ। ওই সময়ে আমাদের অবস্থা স্বচ্ছল ছিল। নিজেদের পুকুরের মাছ ধরে মুক্তি বাহিনীদের জন্য রান্না করেছি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরের দিন বাবাকে বলে কইয়ে গোয়ালের একটা গরু জবাই দিয়ে চরের মানুষকে খাইয়েছি। এ সময় বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের জন্য মিলাত মাহফিলের আয়োজন করা হয়।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে তার পরিবারের সদস্যদের নির্মম ভাবে হত্যার খবর প্রথমে শুনতে পাই রেডিও’তে। এ খবর শোনার পর আমি অসুস্থ হয়ে পরি। দুইদন বিছানা থেকে উঠতে পারিনি। যে মানুষটা নিজের জন্য না ভেবে, নিজের পরিবারের কথা চিন্তা না করে সারাক্ষন দেশের মানুষের জন্য হাজারো জুলুম নির্যাতন সহ্য করেছেন। জেল খেটেছেন। পাকিস্তানে বন্দি থাকার পরও হায়নারা তাঁকে মারতে পারেনি। সেখানে আমার দেশের কিছু লোভী বিশ্বাস ঘাতক বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারকে নির্মম ভাবে খুন করল। বঙ্গবন্ধুকে, তার পরিবারকে মেরে ফেলার পর শোক সহ্য করতে না পেরে আমি এক ধরনের পাগল হয়ে যাই। কোনো কামকাজে মন বসে না আমার। বার বার ব্রহ্মপুত্রের ভাঙ্গনের ফলে জমাজমি, ভিটেমাটি হারিয়ে নি:স্ব হয়ে যাই। আগের মতো আর্থিক অবস্থা এখন আর নেই। তারপরও প্রতিবছর ১৫ আগস্ট আমি বাড়িতে মিলাত মাহফিলের আয়োজন করে বঙ্গবন্ধুর জন্য, তার পরিবারের জন্য এবং বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া মোনাজাত করি। যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন বঙ্গবন্ধুর জন্য আমি ১৫ আগস্ট দোয়া ও মিলাত মাহফিলের আয়োজন করেই যাবো।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে যে হায়নারা হত্যা করেছে সেই একই চক্রের হায়নারা শেখের বেটি আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও হত্যার চেষ্টা করছে। এর আগে তাঁর ওপর কয়েক বার হামলা হয়েছে। কিন্তু তাঁকে মারতে পারেনি। কেননা আল্লাহতায়ালা শেখের বেটির সঙ্গে রয়েছেন। তারপরও আশংকায় থাকি। বঙ্গবন্ধুর খুনী হায়নাদের বিচার করে ফাঁসির রায় কার্যকর করায় ওই একই চক্রের খুনীরা চক্রান্ত করছে। মাঝে মাঝে খবর আসে আমাদের মা, দেশের মা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হয়েছে। এমন খবর পাওয়ার পর আমি অস্থির হয়ে উঠি। আল্লাহতায়ালা সকল ষড়যন্ত্র থেকে শেখ হাসিনাকে যেন রক্ষা করেন-এজন্য আমি প্রতি ওয়াক্ত নামাজ আদায়ের পর দুই রাকাত করে নফল নামাজ আদায় করে আল্লাহর দরবারে দোয়া ও মোনাজাত করি। বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে হত্যার পর থেকে ৪৫ বছার ধরেই আমি নফল নামাজ আদায় করি। এখন আমার বয়স হয়েছে। কখন যেন দুনিয়া থেকে চলে যাই। বঙ্গবন্ধুকে তো কাছ থেকে দেখতে পারিনি। কিন্তুর তার কন্যা আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে খুব কাছ থেকে যদি একবার দেখতে পারতাম, তাহলে শান্তি পেতাম। এটা আমার ইচ্ছে ও আশা।
কুড়িগ্রামের রাজিবপুর উপজেলার দুর্গম ব্রহ্মপুত্র চরাঞ্চলের দক্ষিন বড়বেড় চরের মৃত আফাজ উদ্দিন ব্যাপারির পুত্র আবদুস সোবাহান। সংসার জীবনে সোবাহানের দুই ছেলে ও ৬ মেয়ে। ছেলেমেয়েদের সবাইকে বিয়ে দিয়েছেন। বার বার ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙ্গনের শিকার হয়ে সব কিছু হারিয়ে সোবাহান এখন নিঃস্ব। এক ছেলে থাকেন এলাকায় আরেক ছেলে বাড়ি করেছেন নীলফামারীর ডোমার উপজেলায় নওদাপাড়া নামক গ্রামে। দুই ছেলে আর মেয়েদের বাড়িতে জীবন কাটে সোবাহানের।
এলাকাবাসি যা বলেন
বড়চরের বাসিন্দা নুর হোসেন (৬৮) বলেন, ‘সোবাহান বঙ্গবন্ধুকে বাঁচানোর জন্য ১২ মাস রোজা করেছেন-এটা আমরা সবাই জানি।’ মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেম (৭৪), মমতাজুর রহমান (৭৯) জানান, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরের দিন সোবাহানের বাড়িতে চরের সব মানুষকে দাওয়াত খাইয়ে মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করে বঙ্গবন্ধুর সুস্থতা কামনা করে দোয়াও করা হয়েছিল। চরের ইউপি মেম্বার নুরুল হক বলেন, ‘আমরাও সোবাহানের ঘটনার গল্প শুনেছি বড়দের কাছ থেকে। ওই চরের মুক্তিযোদ্ধা নুরন্নবী হোসেন বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর জন্য সোবাহান ১২ মাস শুধু রোজাই থাকেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে খাবারও দিতেন। আমরা তাকে ভাত খাইতে বললে তিনি ভাত না খেয়ে বলতেন আমি রোজা আছি। বড়বেড় ৮টি মুক্তিবাহিনীদের ক্যাম্প ছিল। আমাদের পশ্চিমেই গাইবান্ধার কামারজানিতে পাকবাহিনীদের অবস্থান ছিল। আমরা কোনো ভাবে পাকদের ব্রহ্মপুত্র পার হতে দেইনি।’
রাজিবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগ সাধারন সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শফিউল আলম বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর প্রতি সোবাহানের ওই বিরল ভালোবাসার গল্পটি জানতে পারি দুই বছর আগে। ওই সময়ে দলেল ওয়ার্ড সম্মেলনে অংশ নেয়ার জন্য বিচ্ছিন্ন দ্বীপচর বড়বেড় গিয়ে জানতে পারি গল্পটি।’ চরনেওয়াজী উচ্চবিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষক শহীদুল্লাহ হক বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি রংপুর কালমাইকেল কলেজে লেখাপড়া করি। ওই সময়েই জানতাম বঙ্গবন্ধুর জন্য সোবাহান রোজা করছেন। যেহেতু আমি আ.লীগের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত তাই বিভিন্ন সভায় সোবাহানের বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালোবাসার চিত্রটি তুলে ধরি।’