১৯৭১ সালের ৯ই মার্চ একটি গুরুত্বপূর্ণ তাপর্য্যর দিন। একাত্তরের ৯ মার্চ দিনটি ছিল মঙ্গলবার। উত্তাল-অগ্নিগর্ভ দিনগুলোর একটি। ওইদিন ন্যাপ প্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। বিকালে বাঙালির মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসনী ঢাকার পল্টন ময়দানে ন্যাপের বিশাল জনসভায় তাঁর ভাষণে ১৪ দফা ঘোষণা করেন। এসময় তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে সাত কোটি বাঙালিকে স্বাধীনতা দানের আলর্টিমেটাম দেন। ২৫শে মার্চের মধ্যে স্বাধীনতা দেওয়া না হলে তিনি ও শেখ মুজিবুর রহমান এক যোগে বাঙালির স্বাধীনতার অর্জনের জন্য সর্বাত্মক সংগ্রাম শুরু করার হুঁশিয়ারী দেন। তুমুল করতালির মধ্যে সবার উদ্দেশ্যে ভাসানী আরো বলেন, ‘আমরা প্রধান মন্ত্রী হতে যাবো না। কারো বাপের শক্তি নাই স্বাধীনতা ঠেকায়। পূর্ব বাংলাকে পৃথক রাষ্ট্র বলে স্বীকৃতি দেয়ার মাধ্যমেই দেশের দু’ অঞ্চলের তিক্ততার অবসান হতে পারে। সংহতি এখন অতীতের স্মৃতি এবং কোনো শক্তিই স্বাধীনতার অধিকারকে ন্যাসাৎ করতে পারবে না। শেখ মুজিবুর রহমান বা বঙ্গবন্ধু বা যে বন্ধুই হোক না কেনো, পাকিস্তানিদের সঙ্গে ‘আপোস’ করতে গেলে পিঠের চামড়া খুলে ফেলবো। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকেও তাই বলি অনেক হয়েছে আর নয়। তিক্ততা বাড়াইয়া আর লাভ নাই। লা কুম দ্বীনুকুম ওয়ালইয়া দ্বীন। অর্থ্যাৎ ‘তোমার ধর্ম তোমার, আমার ধর্ম আমার’ এ নিয়মে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা স্বীকার করিয়া লও।’
বর্ষীয়ান মজলুম নেতা ভাসানী দ্ব্যর্থকণ্ঠে আরো বলেন, ‘শেখ মুজিব নির্দেশিত মার্চের মধ্যে কিছু না হলে আমি ‘শেখ মুজিবের সাথে মিলে ১৯৫২ সালের মতো তুমুল আন্দোলন শুরু করবো। খামাকা কেহ মজিবকে অবিশ্বাস করিবেন না। মুজিবকে আমি ভালো করিয়া চিনি।’ পল্টনের জনসভায় মওলানা ভাসানীর এই বক্তব্যের পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরবর্তী কর্মপন্থা নিয়ে তাদের দীর্ঘ টেলিফোন আলাপ হয়। সভায় বাংলা লীগের প্রধান আতাউর রহমান খান বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আপনি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা। আপনি স্বাধীন বাংলার জাতীয় সরকার ঘোষণা করুন।’
অগ্নিঝরা মার্চ মাসের নবম দিবসে স্বাধীনতার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী দেশব্যাপী সর্বদলীয় হরতাল পালন করা হয়। ওইদিন ঢাকা ছিল মিছিল-সমাবেশে উত্তাল এক নগরী। এছাড়াও দিনটি মিছিলে মিছিলে উত্তাল ছিল সারাদেশ। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সর্বাত্মক অসহযোগে সমগ্র প্রশাসন ছিল স্থবির। বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ঘোষিত আন্দোলনের কর্মসূচি অনুযায়ী সচিবালয়সহ সারাদেশে সকল সরকারি ও আধা-সরকারি অফিস, হাইকোর্ট, জেলাকোর্ট প্রভৃতিতে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। আদালতের কর্মীরাও হরতাল পালনে অংশ নেন। বঙ্গবন্ধু যেসব সরকারি অফিস খুলে রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন কেবল সেসব অফিস চালু থাকে।
শুধুমাত্র ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া বাংলাদেশের আর কোথাও কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না পাকিস্তানের সামরিক জান্তার। যেসব অফিস জরুরি প্রয়োজনে খোলা রাখার অনুমতি প্রদান করা হয়েছিল সেসব অফিস নির্দেশনানুযায়ী খোলা ছিল। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মোতাবেক সরকারি, বেসরকারি, বাসাবাড়িতে কালো পতাকা উডয়ন ছিল। ব্যাংক-বীমা দফতরসমূহ সকাল সাড়ে ৯টা হতে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত খোলা রাখা হয়। এ সময়ে বঙ্গবন্ধুর কড়া নজরদারি ছিল যাতে কোনো টাকা-পয়সা পশ্চিম পাকিস্তানে চালান হতে না পারে।
জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট প্রয়োজনে পূর্ব পাকিস্তান থেকে জাতিসংঘের স্টাফ ও তাদের পরিবারবর্গকে প্রত্যাহারের জন্য ঢাকাস্থ জাতিসংঘের উপ-আবাসিক প্রতিনিধিকে নির্দেশ দেন। জাপানের পররাষ্ট্র দফতর পূর্ববঙ্গে অবস্থিত তার দেশের নাগরিকদেরও প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়। তৎকালীন পশ্চিম জার্মান সরকার তার দেশের নাগরিকদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য সামরিক বিমান পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
সেদিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল ক্যান্টিনে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সংসদের এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সংগঠনের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় অনুষ্ঠিত ছাত্রলীগ ও ডাকসুর নেতৃত্বে গঠিত ‘স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের ছাত্রসভায় গৃহীত ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ ঘোষণার প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদন হয়। সভায় কয়েকদিনের আন্দোলনে নিহতদের, বিশেষ করে ছাত্রলীগ নেতা ফারুক ইকবালসহ অন্যদের স্মরণে এক শোক প্রস্তাব গৃহীত হয়। ৯ মার্চ বঙ্গবন্ধু তার বাসায় কর্মীদের উদ্দেশে বলেন, ‘এখন অনেক খেলা হবে। অনেক ষড়যন্ত্র চলবে। আমাদের প্রত্যেককে সজাগ থাকতে হবে এবং যে কোনো মূল্যে আমাদের কাক্সিক্ষত গন্তব্যে পৌঁছতে হবে।’
৯ই মার্চে অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি সেনা অফিসার-সৈনিকরা গোপনে বিভিন্ন স্থানে সশস্ত্র প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করতে থাকে স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর বাঙালি দামাল ছেলেদের। এরই মধ্যে ঢাকা শহরসহ দেশের প্রায় ৭০টি স্থানে গোপন এবং প্রকাশ্য সশস্ত্র ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়। অন্যদিকে যুবসমাজকে সংগঠিত করতে সারাদেশেই সংগ্রাম কমিটি গঠিত হতে থাকে।
ওইদিন রাত ৯টা থেকে রাজশাহী শহরে ৮ ঘণ্টার জন্য সামরিক কর্তৃপক্ষ কারফিউ জারি করে। রাজশাহীতে অনির্দিষ্টকালের জন্য প্রতিদিন নৈশ কারফিউ জারির পর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, সেনাবাহিনীকে ছাউনিতে ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে বলে ঘোষণার পর রাজশাহীতে হঠাৎ সান্ধ্য আইন জারির কারণ বোধগম্য নয়। বিবৃতিতে অবিলম্বে কারফিউ প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়।
সকালে পিআইএর বাঙালি কর্মচারীরা তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে মিছিল করে ধানমন্ডির বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে এলে তিনি তাদের সঙ্গে আলোচনা করেন। বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলার পতাকা বাতাসে দোল খায় বাংলার ঘরে ঘরে। সরকারি-আধা সরকারি ভবন এবং যানবাহনে ওড়ে কালো পতাকা। বীর বাঙালি স্বাধীনতার দাবিকে সামনে রেখে হয়ে ওঠে উদ্দীপ্ত। যেনো মুক্তি সংগ্রামের উত্তাল সমূদ্রে ভাসে পুরো দেশ। সৃষ্টি হয় স্বাধীনতার জন্য মানুষের মধ্যে এক ব্যাতিক্রম উত্তাল-উদ্দীপনা। সচিবালয়, বিভিন্ন সরকারি অফিস হাইকোর্ট, জেলা আদালতসহ অন্যান্য অফিস-আদালত থাকে বন্ধ।
বঙ্গবন্ধু যে সব অফিস খোলা রাখতে বলেন, সেসব অফিস খোলা রাখা হয়। খোলা রাখা হয় দোকানপাট ও হাট-বাজার। জনসাধারণের চলাচলের জন্য বঙ্গবন্ধুর কথা মত চালু রাখা হয় যানবাহন। পাশাপাশি সারাদেশে ব্যাংকিং কার্যক্রর্মও চলে। তবে অভ্যন্তরীন রুটে বন্ধ থাকে বিমান চলাচল। এদিন সকালে ন্যাপ প্রধান মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ঢাকায় পৌছলে বঙ্গবন্ধু তাঁকে ফোন করেন। টেলিফোনে দুই নেতার স্বাধীনতা অধিকার আলোচনার পর আওয়ামী লীগ ও ন্যাপ কেন্দ্রীয় নেতারা প্রায় আড়াই ঘন্টার বৈঠক করেন। ওইদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাজের্ন্ট জহুরুল হক হল ক্যান্টিনে ছাত্র লীগের কেন্দ্রীয় সংসদের এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়।
এ সভা থেকেও জাতীয় সরকার গঠনের জন্য বঙ্গবন্ধুর প্রতি আহ্বান জানানো হয় এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ওপর দায়িত্ব অর্পন করা হয়। ওদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয় আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসবেন। ওদিকে রাজশাহীতে সামরিক কর্তৃপক্ষ রাত ৯টা থেকে প্রতিদিন ৮ঘন্টার কারফিউ জারি করে। আওয়ামী লীগ কারফিউ জারির প্রতিবাদ জানিয়ে এক বিবৃতিতে বলেন, এর মাধ্যমে সস্পষ্ট হলো সরকার এখনো সেনাবাহিনী কে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়নি।
করাচিতে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ন্যাপ নেতা ওয়ালী খান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার জন্য ঢাকায় আসার ঘোষণা দেন। জামায়াতের ইসলামী প্রাদেশিক আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম এক বিবৃতিতে দেশকে চরম বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের প্রতি আবেদন জানান।
৯ ই মার্চে ইসলামাবাদে পুর্ব পাকিস্তানের গর্ভনর হিসেবে পাকিস্তানি লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানের শপথ গ্রহণের কথা ছিলো। কিন্তু তখন চলছিলো সর্বাত্মক অসহযোগ। পূর্ব পাস্তিানের সবকিছুই চলতো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিদের্শে। পূর্ব পাকিস্তানের হাইকোর্টের বিচারপতি বি. এ. সিদ্দিকী টিক্কা খানকে শপথবাক্য পাঠ করাতে অস্বীকৃতি জানান। ফলে টিক্কা খানকে পাকিস্তানের ‘খ’ অঞ্চলের (পূর্ব পাকিস্তান) সামরিক আইন প্রশাসক (শাসনকর্তা) হিসেবে নিযুক্তির কথা ঘোষণা দেয়া হয়।
একাত্তরের ওইদিনে ঢাকা প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর নিদের্শে তাজউদ্দীন আহমদ এক বিবৃতিতে আন্দোলনের নতুন ১৬টি নির্দেশে জারি করেন। এসময় বিদেশী নাগরিকরাও পরিস্থিতির অবনতি দেখে পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করতে শুরু করেন। জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব জেনারেল মি. উ-থান্ট্ প্রয়োজনে ঢাকা থেকে জাতিসংঘের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং তাদের পরিবারের সদস্যেদের প্রত্যাহার করে নেওয়ার জন্য ঢাকাস্থ জাতিসংঘ উপ-আবাসিক প্রতিনিধিকে নির্দেশ দেন। জাপানের পররাষ্ট দফতরও ঢাকায় তাদের নাগরিকদের দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দেন। পশ্চিম জার্মান সরকার তার দেশের নাগরিকদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য সনদ-প্রাপ্ত (ঈযধৎঃবৎবফ) সামরিক বিমান পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
একাত্তরের ওইদিন হরতাল, অসহযোগ আন্দোলন জোরেসোরে পালন করছিল চট্টগ্রামবাসী। দুপুরের দিকে রেলওয়ে কলোনী ও এ. কে. খান রোডে বাঙালি-বিহার দের মাঝে এক সংঘর্ষের খবর পাওয়া যায়। বিকেলে হালিশহর হতে দেওয়ান হাট হয়ে আগ্রাবাদ পর্যন্ত বিহারীরা ভারী অস্ত্র নিয়ে শোডাউন দেয়। পাকিস্তান আর্মি গোপনে অস্ত্র সরবরাহ করছিল বিহারীদের। পরিস্থিতি ক্রমেই ভয়াবহ হচ্ছিল। অন্যদিকে, ওইদিন চট্টেশ্বরী রোডে চট্টগ্রাম শিল্প-সাহিত্য পরিষদ এর অফিসে গণসঙ্গীতের মহড়া শুরু হয়। ফলে একাত্তরের ওইদিনে বাঙালিদের স্বাধীনতা অর্জনের আন্দোলন বেগবান হয়ে সামনের পথে এগুতে থাকে। এসব ঘটনার খবর পরদিন ১০ মার্চ বিভিন্ন পত্রিকায় সাংবাদিকরা দায়িত্বের সঙ্গে ফলাও করে প্রকাশ করেন।
(লেখক : এম. কে. দোলন বিশ্বাস, দৈনিক সংবাদের সাবেক সহ-সম্পাদক)