১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ১০ তারিখের দিনটি ছিল বুধবার। একাত্তরের অগ্নিঝরা ১০ মার্চে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এক ইশতেহারে বাঙালি সৈন্য, ইপিআর ও পুলিশ সদস্যদের পাকিস্তানি প্রশাসনের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার আহ্বান জানায়। নির্দেশ বাস্তবায়নে তৎপর হন জিয়াউর রহমানসহ বাঙালি অফিসারেরা। ওই ইশতেহারে দেশের সব বাসাবাড়ি ও যানবাহনে কালো পতাকা উত্তোলনের নির্দেশ জারি করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের প্রবাসী ছাত্ররা নিউ ইয়র্কে জাতিসঙ্ঘ সদর দফতরের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এ দিকে কয়েকদিনের আন্দোলন বিক্ষোভে নিহতদের স্মরণে এবং নির্যাতনের প্রতিবাদে সারা দেশে সরকারি ও বেসরকারি ভবনে কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়। সেই সাথে উত্তোলন করা হয় বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা।
বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ৭ই মার্চে সূচিত পূর্ব ঘোষিত অসহযোগ আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ের তৃতীয় দিবস ১০ মার্চ। দেশব্যাপী সর্বাত্মক অসহযোগে কার্যত পুরো দেশ অচল হয়ে পড়েছিল। রাজধানী ঢাকায় সব সরকারি-আধা সরকারি বিভাগের কর্মচারীরা অফিসে যোগদানে বিরত থাকেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী বেসরকারি অফিস, ব্যবসা কেন্দ্র খোলা থাকে। স্টেট ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক এবং সরকারি ট্রেজারিসহ বিভিন্ন ব্যাংক বঙ্গবন্ধু ঘোষিত সময়সূচি অনুযায়ী খোলা থাকে। স্বাধিকার আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে ঢাকা নগরীর সব বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি অফিস, বাসভবন এমনকি হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির বাসভবন এবং রাজারবাগে অবস্থিত পুলিশ বিভাগের অফিসগুলোর শীর্ষেও কালো পতাকা উত্তোলিত ছিল। নগরীর বিভিন্ন সড়কে সব যানবাহনের সম্মুখে শোকের স্মারক কালো পতাকা ছিল। পুরো ঢাকা নগরী যেন কালো পতাকার শহরে পরিণত হয়েছিল।
ওইদিন সামরিক কর্তৃপক্ষ এক নির্দেশ জারি করে। এতে বলা হয়, কেউ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সরকারি সম্পত্তি বিনাশ বা সেনাবাহিনীর চলাচল কিংবা সেনাবাহিনী সংরক্ষণে বাধার সৃষ্টি করতে পারে এভাবে সড়ক, রেল ও বিদ্যুৎ, পানি সরবরাহে অন্তরায় সৃষ্টি করলে তাদের তৎপরতা হামলার সমতুল্য এবং সামরিক বিধিতে দ-নীয় বলে গণ্য করা হবে।
জাতীয় লীগ প্রধান আতাউর রহমান খান পল্টন ময়দানের জনসভায় ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি অবিলম্বে দেশে একটি জাতীয় সরকার ঘোষণার আহ্বান জানান শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি। দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায় ‘আর দেরি নয়’ শিরোনামে সম্পাদকীয়তে বলা হয়, ‘বল প্রয়োগ করিয়া জনগণকে দমানো যাইবে না। জন-প্রতিনিধিদের হাতে অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তর করিতে হইবে।’
অপরদিকে, অগ্নিঝরা মার্চ মাসের ওই দশম দিবস রক্তভেজা হিসেবেও বাঙালি জাতির নিকট পরিচিত। একাত্তরের এদিনে স্বাধীনতার অক্তিম টকটকে লাল সূর্য ছিনিয়ে আনতে জেগে উঠেছিলো মুক্তিকামী জনতা। ডাক দিয়েছিলো স্বৈরাচারী পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের। বাঙালিদের আন্দোলনের তোপেরমুখে পড়েন পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসক। আন্দোলনের ফলে সৃষ্টি হয় পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্রজোড়ে অচলাবস্থা। স্বৈরাচারী পাকিস্তান শাসক গোষ্ঠীর সঙ্গে বাঙালিদের শুরু হয় পাল্টা-পাল্টি হামলা-সংঘর্ষ। বাঙালিদের অধিকারকে ধাবিয়ে রাখতে পাকিস্তানি বাহিনী হামলা চালায়। এতে উভয় গ্রুফের অনেকেই আহত-নিহত হন। কিন্তু বাঙালিরা তাদের অবস্থান থেকে বিন্দু মাত্রও সরে দাঁড়াতে রাজি হননি। বরং দৃঢ়ভাবে পাকিস্তানি শত্রুদের মোকাবেলা করতে সক্ষম হন। ফলে ক্রমেই বাড়তে থাকে বাঙালিদের স্বাধীনতার আকাঙ্খা। ১০ই মার্চ ঢাকায় কয়েকটি ছাত্র সংগঠন এবং লেখক শিল্পী মুক্তি সংগ্রাম পরিষদের মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
ওইদিন মুক্তিকামী জনতারা সবাই যার যার অবস্থান থেকে স্বাধীনতা আদায়ের সংগ্রাম চালায়। স্বাধীনতার অধিকার প্রতিষ্ঠায় ভবিষ্যত প্রস্তুতি নেন। কবিতা ও সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে।
সারা দেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে দেশবাসীকে ওয়াকিবহাল করার অভিপ্রায়ে বঙ্গবন্ধু এক বিবৃতি প্রদান করেন। বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছাই আজ শেষ কথা। বাংলাদেশের জনগণের নামে আমরা যে নির্দেশ দিয়েছি সেক্রেটারিয়েটসহ সরকারি ও আধা সরকারি অফিস-আদালত, রেলওয়ে, স্থল এবং নৌবন্দরসমূহে তা পালিত হচ্ছে। যারা মনে করেছিলেন, শক্তির দাপটে আমাদের ওপর তাদের মত চাপিয়ে দেবেন বিশ্বের কাছে আজ তাদের চেহারা নগ্নভাবে ধরা পড়েছে। বিশ্ব জনমতের কাছে তারা বাংলার নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষের ওপর শক্তির নগ্ন প্রয়োগের যৌক্তিকতা প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছেন। এতদসত্ত্বেও বিবেক বর্জিত সেই গণবিরোধী শক্তি তাদের সশস্ত্র পথই অনুসরণ করে চলছে।’
আগের দিন ৯ই মার্চ বিদেশী কর্মচারীদের প্রত্যাহার প্রসঙ্গে জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের উদ্দেশে ১০ মার্চে বঙ্গবন্ধু সংবাদপত্রে এক বিবৃতিতে বলেন, ‘শুধুমাত্র জাতিসংঘ কর্মচারীদের ঢাকা থেকে সরিয়ে নিলেই তাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। কারণ, আজকে যে, হুমকি দেখা দিয়েছ তা হচ্ছে গণহত্যার হুমকি, জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী স্বীকৃত বাংলাদেশের জনগণ মুক্তির লক্ষ্য অর্জনের জন্য যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে এবং স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে বসবাসের অধিকার আদায়ের জন্য শেষ পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যেতে দৃঢ় সংকল্প। বাংদেশের জনগণ জানে যে ইতিহাস তাদের পক্ষে আছে এবং ধ্বংসকারী অস্ত্র যতই সংগ্রহ করা হোক না কেনো, কোনো শক্তিই তাদের চূড়ান্ত বিজয় রূখতে পারবে না।’
বঙ্গবন্ধুর আরো বলেন ‘জনবিরোধী চক্র উন্মত্ত আচরণ করে চলেছে। সমরসজ্জা ও সৈন্য অব্যাহতভাবে আনা হচ্ছে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সামরিক বাহিনীর লোকজন ও অস্ত্রশস্ত্র আসছে। রাজশাহী ও রংপুরে সান্ধ্য আইন জারি করা হয়েছে। বিনাশী শক্তির এই সমাবেশ ঘটিয়েও মনোবাঞ্ছা তাদের পূরণ হয়নি। তাই ক্ষমতাসীন চক্র এখন বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর আঘাত হানার চক্রান্তে মেতে উঠেছে। জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট বাংলাদেশ থেকে জাতিসংঘের কর্মচারীদের অপসারণের অনুমতি দিয়েছেন। সামরিক বাহিনীর লোকজন বাংলাদেশে বসবাসরত বিদেশীদের জীবন ও ধন-সম্পত্তি কতটা বিপন্ন করে তুলেছেন মহাসচিবের এমন উদ্যোগে তারই স্বীকৃতি মেলে।
উল্লেখ্য, আগের দিন অর্থাৎ ৯ই মার্চ জাতিসংঘ মহাসচিব মি. উ থান্ট এক দাফতরিক আদেশে ঢাকাস্থ উপআবাসিক প্রধান হের কার্লফিৎজ উলফের কাছে প্রেরিত তারবার্তায় বলেন, প্রয়োজন মনে করলে পূর্ব পাকিস্তান থেকে জাতিসংঘের স্টাফ ও তাদের পরিবারের সদস্যদের অন্যত্র স্থানান্তরের ক্ষমতা প্রদান করেন। অপরদিকে জাপান সরকার ঢাকায় অবস্থিত তাদের ১৫০ জন নাগরিককে স্বদেশে ফেরত নেয়া এবং জার্মান সরকার তাদের নাগরিকদের ব্যাংককে সরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করে। এদিন বঙ্গবন্ধু বিদেশী সাংবাদিকদের প্রতি প্রকৃত ঘটনা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরার উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে ধানমন্ডির বাসভবনে লন্ডন টাইমস পত্রিকার সাংবাদিককে বলেন, ‘সাত কোটি বাঙালি আজ তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন এবং যেকোনো মূল্যে এ অধিকার আদায়ে তারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এ পর্যন্ত বাঙালিরা বহু রক্ত দিয়েছে। এবার বাঙালিরা এ রক্ত দেয়ার পালা শেষ করতে চায়।’
ন্যাপ প্রধান ওয়ালী খান ১৩ই মার্চ ঢাকা এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করবেন বলে ঘোষণা করা হয়। জহুর আহমেদ চৌধুরী, এম.আর.সিদ্দিকী, এম.এ.হান্নান, এম.এ.মান্নান, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, মৌলভী সৈয়দ আহমেদ, এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী প্রমূখের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে আসা যে কোনো সিদ্ধান্ত চট্টগ্রামে বাস্তবায়নে বদ্ধ পরিকর চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদ। স্বাধীনতার চূড়ান্ত সংগ্রামের জন্য সর্বাক্তক প্রস্তুতি নিতে থাকে চট্টগ্রামবাসী।
অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন লিখিত ‘এবারের সংগ্রাম’ নাটকের মহড়া দেয় চট্টগ্রাম শিল্প-সাহিত্য পরিষদ-এর শিল্পীরা। অপরদিকে, ওইদিন নারায়ণগঞ্জের সাব-জেলের ২২৩ জন কয়েদি পলায়নকালে পুলিশের গুলিতে ২ জন নিহত ও ২৫ জন আহত হয়। বিগত ৩ ও ৪ মার্চে চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণে যারা আহত হয়েছিল আজ তাদের মধ্যে এক কিশোর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে।
আইন শৃঙ্খলার চরম পরিস্থিতিতে পুর্ব পাকিস্তানের প্রশাসনের ওপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কর্তৃত্ব আরো সুসংহত হয়। পূর্ব ঘোষিত অনুযায়ী এদিন দেশব্যাপী হরতাল পালিত হয়। দেশের অর্থনৈতিক চাকা সচল রাখতে হরতাল, অসযোগ আন্দোলনের মধ্যেও এদিন আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদ তাজউদ্দিন আহমেদ সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ব্যাংক লেনদেন করার ঘোষণা দেন।
বাংালাদেশের প্রকৃত অবস্থা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরার জন্য বঙ্গবন্ধু বিদেশী সাংবাদিকদের প্রতি আহ্বান জানান।
এদিকে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর সাবেক প্রধান ও তাহরিখ-ই-ইশতিকলাল পার্টির প্রধান এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান ওইদিন করাচির উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন। এর আগে তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তিনবার দেখা করেন এবং উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে একান্তে আলোচনা করেন। ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘শেখ মুজিবের ওপর কোনোরূপ দোষ দেয়ার আমি কোনো কারণ দেখি না। তিনি সঠিক এবং ন্যায্য ভূমিকা গ্রহণ করেছেন। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এ ছাড়া তার পক্ষে অন্য কোনো ভূমিকা গ্রহণ করা সম্ভব নয়। আমি তার এ অবস্থানকে সমর্থন করি।’ বঙ্গবন্ধুর কর্মসূচির প্রতি আসগর খানের সমর্থনসূচক উক্তিতে পশ্চিম পাকিস্তানের অন্য নেতারাও তাদের মনোভাব প্রকাশ করতে শুরু করেন। পরে ন্যাপপ্রধান ওয়ালী খান উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য আগামী ১৩ই মার্চ ঢাকা আসার ঘোষণা দেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনাকালে তিনি বলেন, ‘যদি আমরা পরিষদে না যাই, তবে বুঝতে হবে যে, আমরা পরোক্ষভাবে ওই সব শক্তিকেই সমর্থন করছি, যারা নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চায় না।’
এ সময়ে তিনি আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেন যে, ‘ক্ষমতা যাতে হস্তান্তর করা যায়, সে জন্য প্রথমেই আমাদের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের চেষ্টা করতে হবে।’
অপরদিকে একই দলের নেতা জনাব মীর গাউস বখস বেজেঞ্জো জাতীয় পরিষদ অধিবেশনের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত ৪টি শর্ত মেনে নেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
ওইদিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে, পূর্ব রাতে ঘোষিত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সিদ্ধান্তক্রমে বেলুচিস্তানের কসাই খ্যাত জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিয়োগ দেয়া হয়। নবনিযুক্ত গভর্নর জেনারেল টিক্কা খানের শপথ গ্রহণের জন্য সরকার কড়া নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করে। বিকাল ৪টায় গভর্নর হাউসে (বর্তমানে বঙ্গভবন) টিক্কা খানের শপথ নেয়ার কথা থাকলেও শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি বদরুদ্দীন আহমদ সিদ্দিকীকে আনতে লোক পাঠানো হয়। কিন্তু বিচারপতি বিএ সিদ্দিকী সাহেব জেনারেল টিক্কাকে শপথ পাঠ করাতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। এতে টিক্কা খানের শপথ অনুষ্ঠান ভেস্তে যায়। ১০ মার্চের দিনটি দেশবাসীর জন্য এটি ছিল একটি বিজয়ের বার্তা। জনসাধারণ এ ঘটনায় ব্যাপকভাবে উল্লোসিত হয়েছিল।
পরিস্থিতি ক্রমেই এমন উত্তপ্ত হয়ে উঠছিল যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী যাতে বাজার থেকে কোনো নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী ক্রয় করতে না পারে সে জন্যও জনতা সতর্ক পাহারা বসিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত প্রতিদিনের নির্দেশ সংগ্রামী জনতা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। বঙ্গবন্ধু ধীরস্থিরভাবে সবার সঙ্গে আলোচনা করে প্রতিটি নির্দেশ প্রদান করতেন। তিনি যুব সমাজকে সংগঠিত করার জন্য শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক এবং তোফায়েল আহমেদকে দায়িত্ব দেন। ছাত্র সমাজকে সংগঠিত করার দায়িত্ব দেন স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের- নূরে আলম সিদ্দিকী, আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ এবং আবদুল কুদ্দুস মাখনকে। আর জাতীয় রাজনৈতিক বিষয়, অসহযোগ আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচির বিষয়ে আলোচনা করতেন জাতীয় চার নেতা- সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এইচএম কামরুজ্জামানের সঙ্গে। আইনগত ও সাংবিধানিক বিষয়ে আলোচনা করতেন ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম প্রমুখের সঙ্গে। প্রশাসনিক বিষয়ে আলোচনা করতেন আগরতলা মামলার যারা আসামি সিএসপি আহমেদ ফজলুর রহমান, শামসুর রহমান খান, রুহুল কুদ্দুস ছাড়াও সাংবাদিক এবিএম মুসা, একেএম আহসানসহ আরও অনেকের সঙ্গে। এ ছাড়া জাতীয় অর্থনৈতিক বিষয়ে আলোচনা করতেন রেহমান সোবহান, আনিসুর রহমানসহ অন্যদের সঙ্গে।
এভাবেই একটি পরিপূর্ণ টিম ওয়ার্কের মধ্য দিয়ে ১৯৭১-এর অসহযোগ আন্দোলনের সংকটকালীন সময়কে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সফলভাবে অতিক্রম করে মুক্তিকামী জনগণ। বঙ্গবন্ধু সর্বদাই ছিলেন নীতির প্রশ্নে অটল-অবিচল এবং নীতি বা কৌশল প্রণয়নে সবার সঙ্গে আলোচনা করে তবেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন।
১০ মার্চে তৎকালীন পূর্ব পাকিন্তানের প্রভাবশালী পত্রিকা ‘দৈনিক পাকিস্তান’ অবিলম্বে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হন্তান্তরের আহ্বান জানিয়ে সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। কালক্ষেপন না করে জনগণের দাবিও মেনে নেয়ার কথা বলা হয়। ইংরেজি দৈনিক ‘দ্যা পিপলস পাকিস্তÍান’ পত্রিকায় পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভট্টোর নিন্দা সূচক সমালোচনা করে সম্পাদকীয় প্রকাশ পায়।
(লেখক : এম. কে. দোলন বিশ্বাস, দৈনিক সংবাদের সাবেক সহ-সম্পাদক)