কিশোরগঞ্জ জেলায় প্রায় ৩৫ লাখ লোকের বসবাস। এখানে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ক্লিনিক, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। স্বাস্থ্যসেবা নিতে এসে বেসরকারি ক্লিনিকে রোগীরা সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। প্রতিটি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে রয়েছে নিজস্ব দালাল। সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের তুলনায় বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা বেসরকারি ক্লিনিকে ৮ থেকে ১০ গুণ বেশি। ডেলিভারি রোগী এলে নরমাল ডেলিভারি করতে চান না ক্লিনিকের ডাক্তাররা। সিজার করলে রোগীপ্রতি ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা আয় হয়। কিশোরগঞ্জে বেসরকারি উদ্যোগে প্রায় ১৩১টি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ল্যাব রয়েছে।
একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এসব ক্লিনিক ও হাসপাতালের মধ্যে ৯৬টির সরকারি লাইসেন্স রয়েছে। লাইসেন্সের জন্য আবেদিত ২৩টি আর আবেদিত না ১২টি। আর বাকিদের কোনো লাইসেন্সই নেই। ওই সব ক্লিনিকে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা এসে রোগী দেখেন। যেকোনো রোগী ওই ডাক্তারদের দেখালে প্রয়োজন ছাড়াও বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে দেন। নির্দিষ্ট হাসপাতালের ল্যাব ছাড়া অন্য কোথাও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেও ওইসব রিপোর্ট দেখতে চান না ডাক্তাররা। এ ছাড়া রয়েছে ডাক্তারদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ওপর কমিশন বাণিজ্য। বিভিন্ন হাট-বাজারে গ্রাম্য ডাক্তারদের ভিজিট করার জন্য ক্লিনিকের লোকজন তাদের কাছে যান এবং তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ওপর ৩০ থেকে ৫০% কমিশন দেয়া হয়। গ্রাম্য ডাক্তাররা কমিশন পাওয়ার লোভে ওইসব ক্লিনিকে পাঠান। এছাড়াও গর্ভবতী কোনো রোগীদের গ্রাম্য ডাক্তাররা ক্লিনিকে পাঠালে ওইসব রোগীর নরমাল ডেলিভারি করতে চান না ক্লিনিকের ডাক্তাররা। সিজারপ্রতি ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন।
গত বেশকিছু দিন বিভিন্ন ক্লিনিকে সরজমিনে ভুক্তভোগী রোগীদের আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে আলাপ করলে এ তথ্য বেরিয়ে আসে। এইসব ক্লিনিকে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ জন রোগী সিজার করা হয়। সিজার করতে গিয়ে অনেক সময় পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করার কারণে অনেক প্রসূতির সন্তান মেরে ফেলেন। কোনোটির সংবাদ স্থানীয় সাংবাদিকরা জানলে তাদের সঙ্গে আঁতাত করা হয়। গর্ভবতী মহিলাদের সিজার করলে তাদের কমিশন বাণিজ্য অনেক গুণ বেশি। সন্তান-সম্ভবা মহিলাদের স্বাভাবিক ডেলিভারি করতে চান না ক্লিনিকের ডাক্তাররা। এতে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন রোগীরা।
অভিযোগ রয়েছে বেসরকারি ক্লিনিকে নিম্নমানের রিএজেন্ট ব্যবহার করছে। অনেক সময় মেয়াদ উত্তীর্ণ রিএজেন্ট দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার কারণে রক্ত, মলমূত্র পরীক্ষা রিপোর্ট সঠিকভাবে পাওয়া যায় না। গড়ে উঠা বিভিন্ন হাসপাতাল, ক্লিনিক-ল্যাবে রয়েছে এসব অব্যবস্থাপনা। এসব ল্যাবের অধিকাংশেই ডিপ্লোমা টেকনিশিয়ান নেই। এসব ল্যাব থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর বেশিরভাগ সময় সঠিক রিপোর্ট পাওয়া যায় না। ল্যাবের টেকনিশিয়ানে যেসব লোক রয়েছে তাদের বেশিরভাগই কোনো ইউনিফর্ম ও মাক্স পরে থাকে না। ব্যবহার করে না হাতের গ্লাভস। সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এইডস পরীক্ষার জন্য কোনো ফি নেয়া হয় না।
অন্যদিকে বেসরকারি ক্লিনিকে ১২৫০ টাকা নেয়া হয়। সরকারিভাবে টি.সি/ডি.সি.ই.এস.আর/এইচভি একত্রে ১৫০ টাকা, বেসরকারি ক্লিনিকে ৪৩২ টাকা। ভি.ডি.আর.এল টেস্ট সরকারি ৫০ টাকা, বেসরকারি ২১৫ টাকা, এমপি সরকারি ২০ টাকা, বেসরকারি ২১৫ টাকা, ইউরিন ফর আর.আই.এফ সরকারি ২০ টাকা, বেসরকারি ১০০ টাকা, ইউরিন প্রেগন্যান্সি টেস্ট সরকারি ৫০ টাকা, বেসরকারি ২৯০ টাকা, এ.এস.ও টিটার ওআরএ টেস্ট সরকারি ১৬০ টাকা, বেসরকারি ৬১০ টাকা, ক্রস মেথসিন সরকারি ১০০ টাকা, বেসরকারি ৭০০ টাকা। সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন রক্ত, মলমূত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা ৮ থেকে ১০ গুণ বেশি। সরকারি হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা রোগীদের টেস্ট করার জন্য বিভিন্ন ক্লিনিকে পাঠায় কমিশনের কারণে। অনেক সময় হাসপাতালের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট ডাক্তারদের দেখাতে চাইলে তারা ওইসব রিপোর্ট দেখতে চান না। সরকারিভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য যেসব রিএজেন্ট ব্যবহার করে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ট্রেড ওয়ার্ড কোম্পানি জার্মানি ও স্পেন। অপরদিকে বেসরকারি ক্লিনিকগুলো ভারত ও চীনের নিম্নমানের রিএজেন্ট ব্যবহার করে। কয়েকজন রোগী জানান, আমরা জেলা হাসপাতালে সিজার করাতে গিয়ে ইনফেকশনের শিকার হয়েছি। হাসপাতালের অপারেশনের অনেক যন্ত্রাদি পুরনো। তাছাড়া প্রতিদিন অনেক রোগীকে চিকিৎসা নিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। অনেক বিভাগে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকও নেই। ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. সুলতানা রাজিয়া বলেন, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই, তা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের একাধিকবার জানানো হয়েছে। প্রতিদিন বহির্বিভাগে দেড় হাজারসহ অন্য বিভাগে গড়ে সাড়ে পাঁচশ' রোগীকে সামাল দিতে ২৮ জন চিকিৎসককে হিমশিম খেতে হয়। চিকিৎসক সংকট থাকায় বহির্বিভাগে অসংখ্য রোগী চিকিৎসা না নিয়েই চলে যান। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে।
এ বিষয়ে কিশোরগঞ্জের সিভিল সার্জন ডাঃ মোঃ মুজিবুর রহমান এর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, কিশোরগঞ্জে ৮৭টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও বেসরকারী হাসপাতাল এবং ক্লিনিক রয়েছে ৪৪টিসহ সর্ব মোট ১৩১টি। তন্মধ্যে মধ্যে ৯৬টির সরকারি লাইসেন্স রয়েছে। লাইসেন্সের জন্য আবেদিত ২৩টি আর আবেদিত না ১২টি। যেসব ক্লিনিকের লাইসেন্স নেই তাদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে এবং বিভিন্ন টেস্টের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মূল্য তালিকা দেয়ার জন্য তিনি কথা বলবেন বলে জানান। তবে নামসহ তালিকা চাইলে তা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।