‘বারো মাসে তেরো পার্বণ’ কথাটির বিশেষ একটি অর্থ রয়েছে যদি তা একটি বাঙালি জাতির ক্ষেত্রে প্রয়োগ হয়। এর মাঝে মার্চ মাসটি আরো গুরুত্ব বহন করে কারণ এ মাসে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিন রয়েছে। মার্চ আমাদের কাছে মিশ্র অনুভূতি আনে। মার্চ মাসের জাঁতাকলে পিষ্ট হওয়ার অনুভতিই একমাত্র অভিজ্ঞতা নয় যা ক্যালেন্ডারের আর বাকি এগারো মাসগুলোকে জাঁতি হিসেবে আমরা চিহ্নিত করবো। মার্চে আমাদের দু’টো মহান জন্মদিন রয়েছে যা আমরা উদযাপন করি। মার্চের ১৭ তারিখে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টুঙ্গিপাড়ায় ১৯২০ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। অন্যদিনটি হচ্ছে ২৬ মার্চ, যেদিন বঙ্গবন্ধু নতুন একটি দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। আরো একটি দিন রয়েছে ৭ই মার্চ যেদিন বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন যেখানে তিনি একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের পথচলার নির্দেশনা দিয়েছিলেন।
বাস্তবতঃ এ দিনটিই হতে পারত স্বাধীনতা দিবস যদি না বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চকে স্বাধীনতা দিবস ঘোষণা করতেন যা ২৫ মার্চের কালোরাত্রি ‘অপারেশান সার্চলাইট’ নামে বাঙালি জাতির ওপর পরিচালিত এক ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের পর পরই ঘোষিত। এ হত্যাযজ্ঞ সারা দেশের ওপর পরিচালিত হলেও ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইন এলাকা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মিলে গোটা ঢাকাতেই সীমিত ছিল, যে স্থানগুলোতে বাঙালি জাতির একটি স্বাধীন ভূমির চেতনা ও স্বপ্নের বাস্তব চিন্তাধারার উচ্ছ্বাস বয়ে গিয়েছিল। ২৫ মার্চের কালোরাত্রিতে বাঙালি জাঁতি পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর নির্মম এক নিষ্ঠুরতা ও পাশবিকতার অমানবিক হত্যাযজ্ঞের শিকার হয় সে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার আজো হয়নি। আমরা একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য দায়ী কিছু অপরাধীর বিচার করেছি কিন্তু পাকিস্তানী অপরাধীরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। তাদের কারোরই পৃথিবীর কোনো আদালতে বিচার হয়নি, সাজা হয়নি। বিস্ময়ের কিছু নেই, বঙ্গবন্ধুর সেই ৭ই মার্চের দিক-নির্দেশনামূলক ভাষণটি ইউনেসকো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে অনুমোদনলাভ করেছে।
আকর্ষণীয়ভাবে মার্চের সব তারিখগুলোই বাঙালি জাতির কাছে তাৎপর্যময় যা বঙ্গবন্ধুর সাথে সম্পৃক্ত। এতেও কোন সন্দেহ নেই যে বাঙালি জাঁতি তার স্বাধীনতার জন্য প্রতিটি মুহূর্ত এই মহামানবের কাছে ঋণী। ইতিহাস সাক্ষী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই হচ্ছেন বাঙালি জাতির পিতা এবং সর্বকালের সেরা বাঙালি যিনি ইতিহাসের একমাত্র মহান নেতা হিসেবে বাঙালি জাতির একটি স্বদেশভূমির স্বপ্ন দেখেছিলেন। শুধু তা-ই নয়, তিনি তাঁর স্বল্পকালীন মানবীয় মরণশীল জীবনে এ সত্যই উপলব্ধি করেছিলেন। আনন্দ সরকার রায়ের এক বর্ণনা থেকে আমার জানতে পারি যে, যখন তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, তিনি কবে এই বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন; তখন বঙ্গবন্ধু সামান্যক্ষণ নীরব থেকে অবশেষে মুচকি হেসে বলেছিলেন, ১৯৪৭ সালে। ভেবে দেখুন, ১৯৪৭ সাল মানে যখন তিনি মাত্র ২৭ বর্ষের এক যুবক ছিলেন!
এবারের এই মার্চ মাসটি একটি বিশেষ তাৎপর্য বহন করে নিয়ে আসছে, এই মার্চ মাসেই বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী এসেছে। জাঁতি ১৭ মার্চ ২০২০ সাল থেকে ২৬ মার্চ ২০২১ সাল পর্যন্ত মুজিব বর্ষ পালন করবে। বৃহদাকার কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর অর্জনগুলো নিয়ে সবচেয়ে উপযুক্ত অনুষ্ঠানাদির মাধ্যমে এই মুজিববর্ষ পালন করার কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। ইউনেস্কো-ও এই ধারণাকে সমর্থন করেছে এবং জাতিসংঘের সব সদস্য রাষ্ট্রে তা পালন করা হবে। বিশ্বের নেতৃবৃন্দকে বাংলাদেশ সরকার মুজিববর্ষ পালনের জন্য নিমন্ত্রণ করেছে। সরকার ভারতের সম্মানীয় প্রধানমন্ত্রীকে ঢাকায় আসার জন্য নিমন্ত্রণ করেছেন যা তিনি সদয় অনুমতির সাথে গ্রহণ করেছেন। এটি বাংলাদেশ সরকারের একটি কৃতজ্ঞ আচরণের বহিপ্রকাশ আর যদি আমরা তা না করি তাহলে ১৯৭১ সালের নয় মাস ভারত ও ভারতীয় জনগণ আমাদের যে সহযোগিতা করেছে তা অস্বীকার করা হয়। তারা শুধু মুক্তিবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে সামনে এগুতেই সহযোগিতা করেনি বরং তারা অত্যন্ত উদারতার সাথে ১০ মিলিয়ন শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে, খাবার দিয়েছে। তারা এ সময় জানতোও না কবে এসব মানুষ তাদের মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে পারবে যে দেশপাকিস্তানী ও তাদের দোসর এ মাটিরই বেঈমানদের দ্বারা আক্রান্ত। ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে মুজিববর্ষের উদ্বোধনী দিনে নিমন্ত্রণ জানিয়ে বাংলাদেশ মুখ্যতঃ এটিই প্রকাশ করতে চাচ্ছে যে, ৪৯ বছর আগে ভারত সরকার এবং ভারতীয়রা আমাদের প্রতি যে উদার আচরণ করেছিল, তার প্রতিই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হচ্ছে।
সুতরাং আজ যারা ভার্চুয়াল পৃথিবীতে অপপ্রচার যুদ্ধ চালিয়ে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে বাংলাদেশ সরকারের উদার প্রচেষ্টার বিভ্রান্তি ঘটানোর চেষ্টা করছে, তারা মূলতঃ বঙ্গবন্ধুর দর্শন ও শিক্ষারই বিরোধীতা করছে। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি পাবার পর লন্ডন থেকে ঢাকা আসার পথে ভারতের রাজধানীতে একটি সৌজন্য সফর করেন। এর সাথে তিনি ১৯৭২ সালে কলকাতাতেও বাংলাদেশ সরকারপ্রধান হিসেবে তাঁর প্রথম রাষ্ট্রীয় সফর করেন যেখানের মানুষগুলো কয়েক মাস আগে বাংলার মানুষকে দয়া ও ভালবাসা দেখিয়েছিল।
এ নিবন্ধের সমাপ্তি টানার আগে আরো একটি বিষয়ে কথা বলা দরকার। পাকিস্তানী প্রধানমন্ত্রীকেও বাংলাদেশে মুজিববর্ষে ঢাকায় আমন্ত্রণ জানানো আমাদের দরকার। এ সময়ে আমরা ঢাকায় জি-৮-এর শীর্ষ সম্মেলন করতে যাচ্ছি। এই সংগঠনটি মুসলমানপ্রধান আটটি দেশ যেমন বাংলাদেশ, ইরান, মিশর, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, নাইজেরিয়া, তুরস্ক নিয়ে গঠিত। শোনা গেছে ইমাম খান নিয়াজি বাংলাদেশী মানুষদের প্রতি যে অন্যায় আচরণ করেছিলেন তার জন্য ক্ষমা চাইবেন। একজন বাংলাদেশ পাসপোর্ট বাহক হিসেবে আমার কাছে এটি অগ্রহনযোগ্য। কারণ আমি দেখেছি, একজন শহীদ পিতাকে পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী ধরে নিয়ে যাবার সময় থেকে তার শেষনিশ্বাস অবধি কী নির্মম অত্যাচার করেছিল এবং আমি একজন শহীদ বুদ্ধিজীবীর মেয়েকে অসীম শূণ্যতায় ভুগতে দেখেছি যার সন্তান বঙ্গবন্ধুর আদর্শে চালিত। আমরা পাকিস্তানী সৈন্যদের যুদ্ধাপরাধী হিসেবে তাদের বিচার চাই, অন্য কিছু নয়। সিমলা চুক্তিতে লোকান্তরিত ভুট্টো এটি করতে সম্মত হয়েছিলেন। পরিশেষে আমি পাকিস্তানের ৪২ বছরের ঔপনিবেশিক শাসনামলের ক্ষতিপূরণ দাবী করি এবং ১৯৭১ সালের নয় মাসের যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ পাকিস্তানীদের কাছে দাবী করি।
লেখক : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের লিভার বিভাগের চেয়ারম্যান এবং সম্প্রীতি বাংলাদেশ-এর সম্পাদক।