রফতানিনমুখী শিল্পের প্রসারে সরকার বন্ডের মাধ্যমে শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানির সুবিধা দেয়। তবে শর্ত থাকে বন্ড সুবিধায় আমদানি করা ওসব কাঁচামাল পণ্য উৎপাদনে ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী কারখানায় ব্যবহারের কথা বলে শুল্কমুক্ত কাঁচামাল এনে উৎপাদনে ব্যবহার না করে তা খোলাবাজারে বিক্রি করে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। এমনকি বন্ড সুবিধায় আমদানিকৃত পণ্য চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছার আগেই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। আর বন্দরে পণ্য পৌঁছার পর সিন্ডিকেটের সদস্যরা ওই কাঁচামাল খালাস করে যার যার মতো নিজেদের তত্ত্বাবধানে নিয়ে যায়। পরে সুবিধামতো সময়ে ওই কাঁচামাল খোলাবাজারে নির্দিষ্ট দোকানে পৌঁছে দেয়। সেজন্য দেশে একাধিক চক্রও গড়ে উঠেছে। তারা জাল কাগজপত্র ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানির মাধ্যমে খোলাবাজারে বিক্রি করে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বন্ড দুর্নীতির কারণে বছরে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি প্রায় এক লাখ কোটি টাকা। গত ছয় মাসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আওতাধীন কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের কর্মকর্তারা সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে বন্ড দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগে এক হাজার ২৪১টি প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করেছে। কিন্তু বন্ড দুর্নীতির মূল হোতারা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছে। তবে কেউ কেউ গেস্খফতার হলেও কিছুদিনের মধ্যে জামিনে বেরিয়ে একই কারবার অব্যাহত রেখেছে।
সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট শিল্প উৎপাদনের নামে বন্ড দুর্নীতি করেছে এমন ৮৮৩টি প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করেছে। ইতিমধ্যে ওসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১১৫টির আমদানি-রপ্তানি স্থগিত করা হয়েছে। আর ২০৯টি প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা চিহ্নিতকরণ নম্বর (বিআইএন) বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বন্ড কর্মকর্তারা একসময় উৎপাদনে থাকলেও এখন আর নেই এমন ৩৫৮টি প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে হাজার হাজার কোটি টাকার আর্থিক অনিয়ম করার প্রমাণ পাওয়া পেয়েছে। বন্ড সুবিধায় আনা কাঁচামাল রাজধানীর গুলিস্তান, সদরঘাট, উর্দু রোড, নয়াবাজার ও নারায়ণগঞ্জ এবং চট্টগ্রামের রিয়াজ উদ্দিন বাজার, টেরিবাজারে বিক্রি করা হয়। তাছাড়া বন্দর থেকে পণ্য ছাড়িয়ে নিয়ে চট্টগ্রামের বিভিন্ন আবাসিক এলাকার বাসাবাড়িতে গুদামজাত করে সুবিধামতো সময়ে দেশের বিভিন্ন খোলাবাজারে এসব কাঁচামাল বিক্রি করে দিচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা।
সূত্র আরো জানায়, দেশের প্রায় ৯ হাজার রফতানিমুখী প্রতিষ্ঠানকে বন্ড সুবিধার আওতায় শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানির সুবিধা দেয়া হয়েছে। তার মধ্যে প্রায় ৩ হাজার প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারেটের আওতায় রয়েছে। ওসব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ তৈরি পোশাক ও এর সহযোগী শিল্পের। বন্ড সুবিধায় আমদানি করা কাঁচামালের অধিকাংশ আর্ট বোর্ড, ডুপ্লেক্স বোর্ড, প্রিন্টিং পেপারসহ বিভিন্ন কাগজ ও কাগজজাতীয় পণ্য। তাছাড়া বন্ড সুবিধায় প্লাস্টিক, ইলেকট্রিক পণ্য, রাসায়নিক, রডসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্যও আমদানি করা হয়। আর কূটনীতিবিদদের ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন পণ্য বন্ড সুবিধায় বিনা শুল্কে আমদানির সুবিধা দেয়া হয়েছে।
এদিকে এ বিষয়ে চট্টগ্রাম কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের উপ-কর কমিশনার সাইফুর রহমান জানান, বন্ড দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর এবং আশপাশের এলাকায়ও নজর রাখা হচ্ছে। তাছাড়া খোলাবাজারেও খোঁজ রাখা হচ্ছে কারা ওসব কাঁচামাল আমদানি করে বিক্রি করছে। ইতিমধ্যে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের বন্ড দুর্নীতির খোঁজ মিলেছে।
অন্যদিকে একই প্রসঙ্গে ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের উপ-কর কমিশনার আল আমিন জানান, বন্ড সুবিধাপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান নিজেরাই কাঁচামাল আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করছে। অনেকে আবার কাঁচামাল আমদানি করে খোলাবাজারে পৌঁছানোর ঝামেলায় যায় না। কিছু অসাধু ব্যক্তি আছে, যারা ওসব কাঁচামাল বন্দর থেকে সংগ্রহ করে বিভিন্ন কৌশলে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়ে অবৈধ কারবার করছে। এনবিআর তাদের ওপর কঠোর নজরদারি রাখছে।