ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলায় হতদরিদ্রদের জন্য নেওয়া চল্লিশ দিনের কর্মসূচিতে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এ দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি, সম্পাদক, তদারক কর্মকর্তা ও প্রকল্প কর্মকর্তা। ২০১৯-২০ অর্থবছরের অতিদরিদ্রদের জন্য ৪০ দিনের কর্মসৃজন (ইজিপিপি) ১ম পর্যায়ের প্রকল্পে উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের ৫টি করে মোট ত্রিশটি প্রকল্পে কম ও তালিকা বর্হিভুত শ্রমিক দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে, তবে খাতা-কলমে শতভাগ তালিকাভুক্ত শ্রমিককে উপস্থিত দেখানো হচ্ছে। জানা গেছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরের অতিদরিদ্রদের জন্য এ প্রকল্পের ১ম পর্যায়ের কাজ গত বছরের ২৩ নভেম্বর থেকে উপজেলার ৬টি ইউনিয়নে শুরু হয়ে যা শেষ হবার কথা ছিলো ৩১ জানুয়ারি ২০২০। বিধিমালা অনুযায়ী প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার বাদে বাকি ৫ দিন সকাল ৭টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত শ্রমিকদের কাজ করার বিধান রয়েছে। একজন শ্রমিক প্রতিদিন কাজের পারিশ্রমিক হিসেবে ২শ’ টাকা হারে মোট ৪০ দিন কাজ করে এ প্রকল্পের একজন শ্রমিক মোট আট হাজার টাকা নিজ ব্যাংক একাউন্টের মাধ্যমে পারিশ্রমিক পাবার কথা থাকলেও তাও আবার পাচ্ছেন মাত্র ছয় হাজার টাকা। এমনকি বিভিন্ন ওয়ার্ডের মেম্বাররা প্রকল্পে তাদের নিজস্ব লোকজনের নাম তালিকাভুক্ত করে ব্যাংক কর্মকর্তার যোগসাজসে ইউপি সদস্যরাই ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন করেন বলে এমনও অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে কিছু শ্রমিক সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির অন্য প্রকল্পের সুবিধাভোগি, এলাকার বাহিরে বসবাসরত ও প্রবাসে থাকা ব্যক্তিদের নাম তালিকায় অন্তরভুক্ত রয়েছে।
অফিস সূত্রে জানা যায়, চলতি বছর ১ম পর্যায়ের কর্মসৃজন প্রকল্পের ৪০ দিনের জন্য মোট ১ কোটি ৩২ লাখ ৭২ হাজার টাকা বরাদ্দ রয়েছে। যাহা উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নে পাঁচটি করে প্রকল্প ভাগ করে দেওয়া হয় এবং ইতোমধ্যে সাতুরিয়া, গালুয়া ও মঠবাড়ি ইউনিয়নের প্রকল্প গুলোর বরাদ্ধ অর্থের পঞ্চাশ শতাংশ পরিশোধ করা হয়েছে।
সরোজমিনে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিটি প্রকল্পের আওতায় লক্ষ লক্ষ টাকা বরাদ্দ থাকলেও বাস্তবে কাজে করেছে নয়ছয়। উপজেলার শুক্তাগড় ইউনিয়নের সোহরাব মেকারের বাড়ির সামনে হইতে মীরা বাড়ি হইয়া সিকদার বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা পুন:নির্মান প্রকল্পে প্রাক্কলিত মাটির কাজের পরিমাণ ছিল ৪৬ হাজার ছয়শত ঘনফুট এবং বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমান ছিল ২ লক্ষ ৭৪ হাজার টাকা এবং এ প্রকল্পের আওতায় উপকারভোগির সংখ্যা ৩৪ জন। কিন্তু সরোজমিনে গিয়ে দেখা যায় আট থেকে দশ হাজার ঘনফুট মাটি এবং স্থানীয়রা বলেন ৫/৭ জন লেবারে ৮/১০ দিন কাজ করেছেন। এদিকে উপজেলার গালুয়া ইউনিয়নের চাড়াখালী ১নং ওয়ার্ড লোকমান মল্লিকের বাড়ির সামনে হইতে হানিফ হাওলাদার এর বাড়ি হইয়া ঝনু হাওলাদার এর বাড়ী পর্যন্ত রাস্তা মেরামত এই প্রকল্পের আওতায় শ্রমিকের সংখ্যা ১শত উনত্রিশ জন এবং বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমান ১০ লক্ষ ৩২ হাজার টাকা। কিন্তুু সরোজমিনে গিয়ে দেখা যায় সর্বোচ্চ ৮% কাজ হয়েছে।
সূত্র জানায়, সরোজমিনে কোন রকম কাজ করেই প্রকল্পের টাকা লুটে নিচ্ছে প্রকল্পে সংশ্লিষ্ট কর্তারা। বিশেষ করে ইউপি চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্য, স্থানীয় প্রভাবশালী, ট্যাগ অফিসার, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ও প্রকল্প দেখভালকারী কর্মকর্তার মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে অনিয়মের মাধ্যমে হাতিয়ে নিচ্ছেন দরিদ্রদের এ অর্থ।
স্থানীয়রা জানান, অফিস ম্যানেজ করে ইউপি চেয়ারম্যান, প্রকল্পের সভাপতি, ইউপি সদস্যরা প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎ করতেই এভাবে খাতা-কলমে শতভাগ শ্রমিক উপস্থিত দেখিয়ে বাস্তবে কম শ্রমিক দিয়ে নাম মাত্র কাজ করিয়ে থাকেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তালিকাভুক্ত একাধিক শ্রমিক জানান, পিআইসিরা তাদের কাছ থেকে আগেই সব চেকে স্বাক্ষর করে নিয়েছেন। তাছাড়া অনেকের নাম আছে যাদের কোনোদিন প্রকল্প এলাকায় দেখা যায়নি।
এ ব্যাপারে কয়েকজন পিআইসি ও ইউপি সদস্য বলেন, বর্তমানে একজন শ্রমিকের মজুরি ৫০০ টাকা। সেখানে মাত্র ২০০ টাকায় কোনো শ্রমিক কাজ করতে আসতে চান না। এ ধরনের অনৈতিক বা দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে কাজ করা যায় কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, পিআইসিসহ এই কাজের সঙ্গে জড়িতদের আর্থিকভাবে ম্যানেজ করেই তালিকা গড়মিল করা হয়। একাধিক ইউপি সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সংশ্লিষ্ট ইউপি’র বরাদ্দ থেকে মোটা অংকের টাকা চলে যায় পিআইও’র পকেটে। আর তালিকায় থাকা ভুয়া শ্রমিক বেশিরভাগ ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের ছত্রছায়ায় হয়ে থাকে।
এ বিষয়ে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মো: মামুনূর রশীদ পিআইসির সভাপতিদের সঙ্গে কন্ঠ মিলিয়ে বলেন বর্তমান বাজারে ২ শত টাকায় কোন শ্রমিক কাজ করতে আগ্রহী নন। তবে স্থানীয়দের অভিযোগ এড়িয়ে গিয়ে বলেন ইতোমধ্যে তিনটি ইউনিয়নের প্রকল্প এলাকায় সরোজমিনে পরিমাফ করে পঞ্চাশ শতাংশ অর্থ ছাড় করা হয়েছে এবং বাকিগুলো একই পদ্ধতিতে ছাড় করা হবে। প্রকল্পে সন্তোষজনক কাজ না হয়ে থাকলে বরাদ্ধের অর্থ ফেরত দেওয়া হবে। তিনি আরও উল্লেখ্য করেন গত অর্থ বছরের ২য় পর্যায়ের প্রকল্পে সন্তোষ জনক কাজ না হওয়ায় প্রায় পঁচিশ শতাংশ অর্থ ফেরত দেওয়া হয়েছিল এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না।