গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার সুস্বাদু ও মিষ্টি লিচুর পরিচিতি রয়েছে দেশব্যাপী। গ্রামের ভিতর দিয়ে ঘন ঘন লিচু বাগান। চারদিকে মিষ্টি মৌ মৌ গন্ধ। লিচুর উৎপাদন বাড়াতে বাগানে বাগানে চাষিরা মৌমাছির ’মৌ বাক্স’ বসিয়েছে। পাশেই নিজেদের তৈরি ছোট মাচায় থেকে বাক্সের তদারকি করছে মৌ চাষিরা। গাছের নিচে সারি সারি করে সাজিয়ে রেখেছেন কাঠের তৈরি বাক্সগুলো। সেখান থেকে দলে দলে মৌমাছির ঝাঁক বসছে লিচুর মুকুলে। মুকুল থেকে মধু সংগ্রহ করে মৌমাছির দল নিজ নিজ কলোলিতে মৌচাকে মধু এনে জমা করছে। ৭-৮ দিন অন্তর অন্তর প্রতিটি বাক্স থেকে চাষিরা মধু সংগ্রহ করছেন।
প্রতিটি বাক্সে একটি রানী মৌমাছি, একটি পুরুষ মৌমাছিসহ অসংখ্য এপিচ জাতের কর্মী মৌমাছি রয়েছে। কর্মী মৌমাছিরা ঝাঁকে ঝাঁকে লিচুর মুকুলে ছুটে গিয়ে মধু সংগ্রহ করে বলে জানান মৌ চাষিরা। মৌমাছির মাধ্যমে মুকুলের পরাগায়ণ ঘটানোর মাধ্যমে লিচুর ফলন ভাল হয়। ফলে যে গাছে মৌমাছির বেশি আগমন ঘটে সে গাছে লিচুর যেমন বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা থাকে, তেমনই মৌ চাষিরা বেশি মধু সংগ্রহ করে বানিজ্যিকভাবে বিপুল পরিমান অর্থ উপার্জন করতে সক্ষম হয়। বাগানে মৌমাছি চাষে লিচুচাষি ও মৌ খামারি দু’পক্ষই লাভবান হচ্ছেন। এতে বেকারত্ব দূরের সাথে লিচুর ফলনও বৃদ্ধি পায়। লিচুর বাগান থেকে সংগ্রহ করা মধু যেমন খাঁটি তেমনই সুস্বাদু। মানের দিক থেকে ভাল হওয়ায় এর চাহিদা অনেক বেশি। প্রতি বছর দেশের নানান প্রান্ত থেকে মৌচাষিরা মধু সংগ্রহ করতে কাপাসিয়ার বিভিন্ন বাগানে আসে।
গাছে থোকা থোকা লিচুর মুকুল আগমনই বলে দিচ্ছে এবার ভাল লিচুর ফলন হবে। মৌ মৌ গন্ধে গাছে গাছে দোলা খাচ্ছে লিচুর মুকুল। লিচু চাষিরাও ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে গাছের পরিচর্চায়। অন্যদিকে মৌচাষিরা মধু সংগ্রহে শ্রম ব্যয় করছে দিনরাত।
সম্প্রতি সরেজমিনে উপজেলার দূর্গাপুর ইউনিয়নের চাঁটারবাগ, বাড়ৈগাঁও, একডালা, দূর্গাপুর, বড়চালা, রাওনাট এলাকায় দেখা গেছে, ৬-৭টি স্থানে ৮-৯শ ’মৌ বাক্স’ বসিয়ে মধু সংগ্রহ করছে মৌ চাষিরা। মার্চ মাসের শুরু থেকে মধু সংগ্রহ করার ধুম পড়ে। দূর থেকে আসা মৌ চাষিরা বিভিন্ন স্থানীয় বাগান মালিকদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে মৌ চাষ শুরু করে। একটি বাগানে মধু সংগ্রহ করার কাজে ২-৩ জন শ্রমিক কাজ করে। এক মাস সময় নিয়ে এখানে এসেছেন মৌ চাষিরা। মাসে ৩-৪ বার মধু সংগ্রহ করতে পারে। আবহাওয়ার উপর নির্ভর করে আরো বেশিও সংগ্রহ করা যায়। কয়েক’শ মন মধু সংগ্রহ করা সম্ভব হয়। প্রতি কেজি মধু ৩শ টাকা কেজি ধরে বিক্রি হয়। মধু সংগ্রহ করা শেষ হলে চাষিরা তাদের সাথে করে শিকারী মৌমাছিদেরও নিয়ে যায় বলে জানান মৌ চাষিরা।
চাষিরা জানান, মধু সংগ্রহের সময় সাবধান না থাকলে রাণী মৌমাছি মারা যেতে পারে। বৃষ্টি ও মেঘলা দিনে যখন মৌমাছিদের খাবারের অভাব হয় তখন চিনির সাথে পরিমাণমতো পানি মিশিয়ে চিনি গোলা খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। বৃষ্টির দিনে মৌমাছিরা যাতে বাইরে যেতে না পারে সেজন্য কুইনগেট বন্ধ করে দিতে হয়। রাণী মৌমাছির ডিম দেয়ার জন্য বাইরে যাবার চেষ্টা করে। পালন করা মৌমাছির চাক থেকে যান্ত্রিক উপায়ে নিষ্কাশিত মধু যেমন বিশুদ্ধ, তেমনি নিষ্কাশনও হয় পুরোপুরি। চাক নষ্ট না করে মৌমাছি উৎপাদনে সহায়ক : সাধারণ নিয়মে মধু সংগ্রহের সময় চাকটিকে নষ্ট করে ফেলা হয়। এ কাজের সময় অনেক ক্ষেত্রে বিপুলসংখ্যক মৌমাছিও মারা পড়েন। এ ছাড়াও চাকে অবস্থিত ডিম ও বাচ্চা নষ্ট হয়। এর ফলে দিন দিন মৌমাছির সংখ্যা কমতে থাকে।
চাটারবাগ এলাকার আনোয়ার হোসেন, বাড়ৈগাঁও এলাকার রবিউল ও নুরুল ইসলাম বলেন, প্রতি মণ মধু ৭-৮ হাজার টাকা দরে বিক্রি করি। দেশের বিভিন্ন কোম্পানি আমাদের কাছ থেকে মধু কিনে নিয়ে যায়। স্থানীয় অনেক লোক আসে মধু ক্রয় করতে। এ মধুতে কোন ভেজাল নেই, একদম খাঁটি মধু।
কাপাসিয়া কৃষি অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকতা মোখলেসুর রহমান বলেন, উপজেলায় লিচু চাষ হয়েছে ২৭৫ হেক্টর জমিতে। নদীর দক্ষিণ পাশের তিনটি ইউনিয়নেই বেশি চাষ হয়েছে। তবে কতোটি লিচু বাগান আছে সে হিসাব আমাদের কাছে নেই। মৌ চাষিরা আসা শুরু করেছে মাত্র। মধু সংগ্রহ করতে আসা চাষিদের তালিকাও আমরা প্রস্তুত করছি।
কৃষি কর্মকর্তা সুমন কুমার বসাক বলেন, লিচুর মুকুলে মৌমাছি বসলে পরাগায়ন ভালো হয়। ফলে ওই গাছে বা বাগানে লিচুর বাম্পার ফলন হওয়ার সম্ভাবনা বেশী থাকে।
উল্লেখ, মৌমাছি চাষের ইতিহাস অনেক প্রাচীন হলেও পদ্ধতিগতভাবে সর্বপ্রথম ১৬৩৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মৌমাছি চাষ শুরু হয়। পরবর্তীতে ১৮৪০ সালে মোসেস কুইনবি নামক বৈজ্ঞানিক মৌচাষ শুরু করেন। ১৮৫৩ সালে আধুনিক পদ্ধতিতে মৌচাষ শুরু করেন ল্যাংষ্ট্রোথ নামক বৈজ্ঞানিক যাকে আধুনিক মৌচাষের জনক বলা হয়। ১৮৮৪ সালে সর্বপ্রথম ডকলাস নামক একজন ইংরেজ ভারতীয় উপমহাদেশে মৌচাষের প্রবর্তন করেন। নিউটন নামক একজন ব্রিটিশ নাগরিক ১৯১১ সালে মৌবাক্সকে বর্তমান পর্যায়ে নিয়ে আসেন। পরবর্তীতে কুমিল্লা পল্লি উন্নয়ন একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা ড. আক্তার হামিদ খান ১৯৫৮ সালে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম মৌচাষের সূচনা করেন। পরবর্তীতে ১৯৬৩ সালে বাংলাদশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন ( বিসিক ) বাগেরহাট জেলার যাত্রাপুরে সর্বপ্রথম জনগণকে মৌমাছি পালনের প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করেন।