করোনার ধাক্কায় কাঁপছে গোটা বিশ্ব। এর আগে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক কোন সঙ্কটই বিশ্বজুড়ে এতটা আতঙ্ক সৃষ্টি করেনি। ধারণা করা হচ্ছে করোনা ধাক্কায় ১ ট্রিলিয়ন ডলার ক্ষতির মুখে পড়তে পারে বৈশ্বিক জিডিপি। বিশ্ব অর্থনৈতিক মান্দায় আক্রান্ত হতে পারে বাংলাদেশও। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া নভেল করোনাভাইরাসের এ মহামারীর সময় সুখবর পেল দেশের তৈরি পোশাক খাত। ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশের জিএসপি (জেনারেলাইজড সিস্টেম অফ প্রিফারেন্সেস) বা অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্যিক সুবিধা প্রত্যাহারের আবেদন নাকচ করে দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ন্যায়পাল কার্যালয়। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতসহ সার্বিক অর্থনীতির জন্য দেশের এই সঙ্কটময় মুহূর্তে ন্যায়পাল কার্যালয়ের আদেশটি আমাদের জন্য অত্যন্ত বড় একটি সুসংবাদ। ইতোমধ্যে এ সুখবরকে স্বাগত জানিয়েছেন দেশের গার্মেন্টস উদ্যোক্তারা। বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে চাইলে জিএসপি-সুবিধা ফেরত পাওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। এখন বিশ্বায়নের যুগ। কোনো দেশ বা জাতির পক্ষে বিচ্ছিন্ন হয়ে বা একা একা থেকে উন্নয়ন করার সুযোগ নেই।
২০১৬ সালে ইইউ ন্যায়পাল অফিসে শ্রম অধিকার নিয়ে কাজ করা চারটি সংগঠন বাংলাদেশের শ্রমমান নিয়ে প্রশ্ন তুলে জিএসপি সুবিধা বাতিলের আবেদন করে। গত ২৪ মার্চ জিএসপি সুবিধা প্রত্যাহারের আবেদন নাকচ করে দিয়ে ন্যায়পাল কার্যালয় জানায়, ‘শ্রম পরিবেশ ইস্যুতে ন্যায়পাল কার্যালয়ের তদন্তে বাংলাদেশের তেমন কোনো ত্রুটি পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশের শ্রমমান উন্নয়নে ইউরোপীয় কমিশন যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে এবং যেভাবে যোগাযোগ রক্ষা করছে, তা ঠিক আছে। আগামীতে এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে ইউরোপীয় কমিশন নেবে।’
জিএসপি সুবিধা
পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বে শুল্কমূক্ত অগ্রাধিকারমূলক সুবিধা পাওয়াকেই জিএসপি বলে। শুল্কমুক্ত অগ্রাধিকার থাকলে, বাংলাদেশের পণ্য যে দেশে যাবে, সে দেশকে কোন প্রকার ভ্যাট, ট্যাক্স দিতে হয় না। এ জন্য বায়ারদের টাকা কম খরচ হয়, তাতে তারা বেশি দামে বাংলাদেশ হতে পণ্য কিনতে পারে। এতে বাংলাদেশি মালিকদের বেশি লাভ হয়। সাধারণত বিদেশি বায়াররা ওই সব দেশ হতেই পোশাক কিনে থাকে, যে দেশে জিএসপি সুবিধা থাকে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (বিবাস) একটি সাধারণ নিয়ম হলো, বাণিজ্যে অংশগ্রহণকারী সংস্থাভুক্ত দেশগুলোকে সমভাবে বিবেচনা করা। অর্থাৎ কোনো দেশ অন্য একটিকে আলাদাভাবে বিশেষ কোনো বাণিজ্য বা শুল্কসুবিধা দিতে পারবে না, যদি সেই সুবিধা সবার জন্য প্রযোজ্য না করা হয়। বিবাসের এ নীতিমালাটির অধীনেই মোস্ট ফেভার্ড নেশন (এমএফএন) বা সবচেয়ে সুবিধাপ্রাপ্ত দেশের ধারণা। তবে বিশেষ বিবেচনায় কোনো দেশের জন্য এই ধারাটিকে শিথিল করার কিংবা এটি থেকে ছাড় দেওয়ার আনুষ্ঠানিক পদ্ধতিকেই বলা হয় জিএসপি। এই নীতির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো কিছু নির্দিষ্ট উন্নয়নশীল এবং স্বল্পোন্নত দেশ থেকে সুনির্দিষ্ট কোনো বিশেষ পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে প্রতিদানহীনভাবে শুল্কমুক্ত বা শুল্কহ্রাস সুবিধা দিয়ে থাকে।
ন্যায়পালের কার্যালয় জানায়, তারা তাদের তদন্তে বাংলাদেশের প্রতি সন্তুষ্ট। বাংলাদেশের শ্রমমান উন্নয়ন ও শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ইউরোপীয় কমিশন দেশটির সরকার, মালিক, শ্রমিক ও সুশীল সমাজের সঙ্গে যেভাবে কাজ করছে তা সন্তোষজনক। সার্বিক খবর হলোÑ বাংলাদেশে শ্রমমান, কারখানার পরিবেশ উন্নয়নে সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের পদক্ষেপকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
জিএসপি সুবিধার পূর্বশর্ত
এ ছাড়া জিএসপির সুবিধার বাধ্যতামূলক পূর্বশর্ত হচ্ছে, সুবিধাপ্রাপ্তির জন্য দেশটিকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শ্রম অধিকার (ট্রেড ইউনিয়ন, নি¤œতম আয়সহ উপযুক্ত কর্মপরিবেশ, নির্ধারিত কর্মঘণ্টা, স্বাস্থ্যসেবা) প্রদানের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া এবং নিকৃষ্টতম শিশুশ্রম বন্ধের জন্য তাদের অঙ্গীকার পূরণ করা। এসব পূর্বশর্ত পরিপালনক্ষম যেসব দেশের মাথাপিছু আয় একটা নির্দিষ্ট পরিমাণের কম, সেসব দেশকেই জিএসপি সুবিধা দেওয়া হয়। এমনিভাবে কেবল জিএসপির অধীনেই যুক্তরাষ্ট্র ১৭০টি দেশ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দিয়ে থাকে।
জিএসপি স্থগিতের সূচনা যেভাবে
সাভারে রানা প্লাজা ধস। ১ হাজার ১৩৫ জন শ্রমিকের প্রাণহানির পর বিশ্বব্যাপী নিন্দা-সমালোচনার ঝড় ওঠার প্রেক্ষাপটে শ্রমিক নিরাপত্তা ও কারখানায় কর্মপরিবেশের নি¤œমানের কারণ দেখিয়ে ২০১৩ সালে জিএসপি স্থগিত করে আমেরিকা। এরপর কেটে গেছে দীর্ঘ বছর। আমেরিকার প্রশাসনেও এসেছে বদল। সেই সময় মার্কিন প্রশাসনের দেওয়া বিভিন্ন শর্ত পূরণ হয়েছে মর্মে বাংলাদেশ সরকার জিএসপি সুবিধা পুনর্বহালের অনুরোধ জানিয়ে একাধিক চিঠি দিলেও জিএসপি-সুবিধা পুনর্বহালে কার্যত কোনো অগ্রগতি হয়নি।
প্রসঙ্গত, শ্রম অধিকার নিয়ে কাজ করা চারটি সংগঠন ২০১৬ সালে ইইউর ন্যায়পাল অফিসে অভিযোগ জানায়, বাংলাদেশে সঠিক শ্রম পরিবেশ নেই এবং শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। বিষয়টি আমলে নিয়ে তদন্ত করে ইইউ’তে পাওয়া বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বাতিল করার দাবিতে মামলাটি করা হয়েছিল। যাই হোক, বাংলাদেশে বেসরকারি বিনিয়োগের গতি বেগবান করা বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও আকৃষ্ট করার পরিবেশ তৈরিতে সরকারকেই মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। আইনের শাসন, দুর্নীতি দমন, লাল ফিতার দৌরাত্ম্য এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার হুমকি কমাতে পারলে ব্যাপক বিনিয়োগ-সহায়ক পরিবেশ তৈরি হবে। এ ছাড়া তৈরি পোশাক কারখানাগুলোর কর্মপরিবেশ আরো উন্নত করে শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করতে সরকারকে প্রধান ভূমিকা রাখতে হবে বলে আমরা মনে করি।
বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার
পোশাক কারখানার কর্মপরিবেশের নি¤œমানের কথা বলে জিএসপি স্থগিত করা হলেও সেই পোশাকশিল্প কখনোই ছিল না জিএসপি-সুবিধার আওতায়। বাংলাদেশ থেকে আমেরিকায় রপ্তানি হওয়া বিভিন্ন অপ্রচলিত পণ্য, যা এই সুবিধা বাতিলের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রত্যক্ষভাবে। আর পরোক্ষ ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবটি হলো বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের সম্মান ও ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের। আর এই দ্বিতীয় বিবেচনাতেই বাংলাদেশের জন্য জিএসপি সুবিধা ফিরে পাওয়াটা বিশেষভাবে জরুরি ছিলো। এখন জিএসপি ফিরে পাওয়ায় বাংলাদেশকে তাদের ইতিবাচক ভাবমূর্তি ধরে রাখার ব্যাপারে শতভাগ উদ্যোগী হতে হবে।
ইতোপূর্বে নিউইয়র্কে কুইন্স-ব্রঙ্কস নিয়ে গঠিত কংগ্রেস ডিস্ট্রিক্ট-১৪-এর ডেমোক্রেটিক প্রার্থী জোসেফ ক্রাউলি নির্বাচিত হলে জিএসপি পুনর্বহালে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তবে এর সঙ্গে তিনি অবধারিতভাবেই জুড়ে দিয়েছিলেন শ্রমিক অধিকার নিশ্চিত করার শর্ত। এটি স্বাভাবিকও। কারণ ২০০৭ সাল থেকেই বাংলাদেশের শ্রম পরিবেশ ও শ্রমিক অধিকার নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে জিএসপি বাতিলের তদবির করে আসছিল আমেরিকার প্রভাবশালী শ্রমিক সংগঠন এএফএল-সিআইও। যা রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর গুরুত্বের সঙ্গে নেয় মার্কিন প্রশাসন।
জিএসপি সুবিধা অব্যাহত রাখতে করণীয়
একটি প্রতিষ্ঠান একটি পরিবারের মতই। পরিবারের সদস্যদের ভরণ-পোষণ, সুবিধা-অসুবিধা যেমন তার অভিভাবক বহন করে থাকে। তেমনি যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা শ্রমিকদেরকে পরিবারের সদস্যের মত না দেখবে ততক্ষণ পর্যন্ত জিএসপি খোয়ানোর মতো সমস্যা চলতেই থাকবে। আর এটা করতে হলে অধিক মুনাফার লালসা ত্যাগ করতে হবে। এমতাবস্থায় রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো শ্রমিকের কল্যাণের দিকে মনোনিবেশ করা। জিএসপি সুবিধা অব্যাহত রাখতে যে বিষয়গুলোর ওপর জোর দিতে হবে, তা হলো সংশোধিত শ্রম আইন প্রয়োগ, শ্রমিকদের কর্মপরিবেশের উন্নতি, নিরাপত্তা এবং ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার নিশ্চিত করাসহ বিভিন্ন কল্যাণমূলক পদক্ষেপ। ইতিপূর্বে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে দেওয়া জিএসপি স্থগিত করার মধ্যে একটি সতর্কবার্তা রয়েছে। বাংলাদেশকে ওই বার্তাকে গুরুত্বসহকারে নিতে হবে।
‘জিএসপি প্লাস’ সুবিধা
জাতিসংঘে অনুমোদিত সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্য (এমডিজি) অর্জনে বাংলাদেশ সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছে। সময় এখন টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জনের। তবে এ অর্জনের পথে মূল সংকট হচ্ছে সম্পদ আহরণ। বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে হলে ইইউভুক্ত দেশগুলোতে ‘জিএসপি প্লাস’ ব্যবস্থার আওতায় বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা পেতে এখন থেকেই উদ্যোগ নিতে হবে। বাংলাদেশের এই সুবিধা পাওয়ার খুব ভালো সম্ভাবনা রয়েছে বলে আমরা মনে করি। তবে এই জিএসপিটি হলো অস্ত্র বাদে সব (ইবিএ) পণ্যে শুল্কমুক্ত বাজারসুবিধা। বর্তমানে শুধু এলডিসিগুলো এ সুবিধা পায়। তবে এলডিসির কাতার থেকে বেরিয়ে গেলে বাংলাদেশ আর এ সুবিধা পাবে না। সে ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য ‘জিএসপি প্লাস’ হিসেবে পরিচিত যে বাজারসুবিধা আছে, সেটি বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য হতে পারে। টেকসই উন্নয়ন ও সুশাসনের জন্য সহায়তা হিসেবে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে জিএসপি প্লাস সুবিধা প্রদান করা হয়, যা ইবিএর মতো সব পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয় না। তৈরি পোশাক কারখানায় কর্মপরিবেশের উন্নয়নে বাংলাদেশ ইতিমধ্যে প্রশংসনীয় অগ্রগতি অর্জন করেছে। তবে পোশাকশিল্পের পাশাপাশি বাংলাদেশকে অন্যান্য শিল্প খাত বৈচিত্র্যকরণ করতে হবে।
গণতন্ত্র, অর্থনীতি ও বাণিজ্য এগুলো একটি অপরটির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। মুক্তবাজার অর্থনীতিও অনেকটা গণতন্ত্রের মতোই। এ ব্যবস্থায় ভোক্তারা নিজেদের ইচ্ছে ও চাহিদামতো পণ্য-সেবা কিনবেন। ভোক্তারা যদি কোনো কোম্পানির পক্ষে ভোট না দেন অর্থাৎ কোনো কোম্পানির পণ্য না কেনেন, তাহলে ওই কোম্পানি আর ব্যবসা করতে পারবে না। বর্তমান পরিস্থিতিতে ইউরোপীয় বাজার ধরে রাখা এবং প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আরও বড় রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে ঢোকার জন্য অবশ্যকরণীয় কাজগুলো সমাধা করতে হবে যথাশিগগির সম্ভব।
পোষাক শিল্প মালিকরা যেমন তাদের পুঁজি, মেধা ও শ্রম দিয়ে একেকটি শিল্প গড়ে তুলেছেন। তাদের উদ্যোগের ফলে দেশে প্রচুর কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে, দেশ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। তেমনি শ্রমিক ভাইয়েরাও তাদের শ্রম ও মেধা দিয়ে পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে মালিকদের লক্ষ্য অর্জনে সাহায্য করছেন। মালিকরা কখনও চিন্তা করেছেন, এই শ্রমিক ব্যতিরেকে আপনারা আপনাদের লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হতেন কী-না? পোষাকশিল্পের মালিকরা বলে থাকেন তাদের আজকাল তেমন লাভ বা আয় হয় না। এ কথাটি কতটুকু সত্য? কারণ তা-ই যদি হবে, তাহলে একই মালিক আরও বৃহত্তর পরিসরে নতুন নতুন কারখানা তৈরি করছেন কিভাবে এবং কেন?