কৃষক সুফল ঘোষের রয়েছে এক দাগে ৩৩ শতক জমি, যার সাড়ে ৩১ শতকে ধানের চাষ। জমির এক কোনে বাকি মাত্র দেড় শতকে রয়েছে মিনি পুকুর। যে পুকুরে করা হয়েছে মাছের চাষ, পুকুর পাড়ে আছে নানা রকমের শাক-সবজি। সবচে বড় বিষয় এই পুকুরের পানি দিয়ে কৃষক তার ধান ক্ষেতে সেচ দিচ্ছেন। এই পানি দিয়ে তার ধানের ক্ষেতের সেচ কাজ চলে। বৃষ্টির পানি ধরে রেখে সেই পানি সারা বছর সেচে ব্যবহার করছেন।
সুফল ঘোষ একা নয়, ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার সুন্দরপুর-দূর্গাপুর ও নিয়ামতপুর ইউনিয়নে এ রকম একশত মিনি পুকুর রয়েছে। যেগুলো ধানের জমির এক কোনে কাটা হয়েছে। এই পুকুর কাটতে কৃষককে সহযোগিতা করেছেন স্থানীয় সেচ্চাসেবী সংগঠন সোনার বাংলা ফাউন্ডেশন।
ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শিবুপদ বিশ^াস জানান, ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমানোর জন্য তারা এই পুকুর খনন কার্যক্রম শুরু করেছেন। জাপানের শেয়ার দ্যাপনেট এ্যাসোসিয়েশন এর সহযোগিতায়, জাপান ফান্ড ফর গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট জেএফজে) এর অর্থায়নে পানি সাশ্রয়ী কার্যকরী কৃষি অনুশীলন প্রকল্পটির বাস্তবায় করা হচ্ছে। প্রথম দফায় তারা কালীগঞ্জের দুইটি ইউনিয়নে ১শত কৃষকের ধানের জমিতে ১শত টি পুকুর খনন করে দিয়েছেন। ২০১৯ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্প বর্তমানে চলমান রয়েছে। শিবুপদ বিশ^াস আরো জানান, প্রায় ১০ হাজার টাকা ব্যয় করে প্রতিটি পুকুর কেটে দিয়েছেন।
সেই সঙ্গে পুকুরের পানি কিভাবে ক্ষেতে ব্যবহার করবেন, কিভাবে পুকুরের মাছ চাষের পাশাপাশি পাড়ে সবজি চাষ করবেন তা নিয়মিত পরমর্শ দিয়ে যাচ্ছেন।
প্রকল্পের সমন্বয়কারী তোফায়েল হোসেন জানান, তারা সুন্দরপুর-দূর্গাপুর ইউনিয়নের সুন্দরপুর, দূর্গাপুর, মহাদেবপুর, আলাইপুর, কমলাপুর, ইছাপুর, পাইকপাড়া, ভাটপাড়া ও বেজপাড়া এবং নিয়ামতপুর ইউনিয়নের কুড়লিয়া, বারোপাখিয়া, নরেন্দ্রপর, নিয়ামতপুর, মহিষাডেরা, দাপনা, হরিগোবিন্দপুর ও আড়–য়াশলুয়া গ্রামের মাঠে এই প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করছেন। কৃষকের ৩৩ শতক জমির মাত্র দেড় শতক জমিতে পুকুর হচ্ছে। একে তার ফসলের খুব বেশি ক্ষতি হচ্ছে না। বাকি জমিতে ধান চাষ করতে পারছেন। এতে তাদের সেচ খরচ খুবই কম হচ্ছে। সেই সঙ্গে পুকুরে মাছের চাষ করছেন। যে মাছ তার সংসারের প্রয়োজন মিটিয়ে বিক্রিও করছেন। আরো রয়েছে পুকুর পাড়ে সবজি চাষ। কলা, কচু, লাউ, লালশাক, বেগুন সহ নানা সবজি চাষ করছেন কৃষকরা। তোফায়েল হোসেন জানান, এ সকল পুকুর থেকে তারা এক মৌসুমে প্রায় ৬ হাজার টাকার সবজি, ২ লাখ টাকার মাছ পেয়েছেন। যেগুলো কৃষকরা বিক্রি করে নিয়েছেন। এছাড়া তারা সংসারে খাওয়ার জন্যও এগুলো ব্যবহার করেছেন।
সোনার বাংলা ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শিবুপদ বিশ^াস আরো জানান, তারা পানি সাশ্রয়ী পুকুর খননের পাশাপাশি কৃষকদের নিয়ে বিষমুক্ত রবিশয্য চাষ নিয়ে কাজ করছেন। কৃষকরা যেন ভার্মি কম্পোষ্ট ও বালাই নাশক দিয়ে চাষ করতে পারেন সে বিষয়েও প্রশিক্ষনরত নানা কর্মসুচি পালন করে আসছেন।
বেজপাড়া গ্রামের সুফল ঘোষ জানান, তার জমিতে বছরে দুইটি ধানের চাষ হয়। বোরো ও আমন মৌমুমে তারা ধান চাষ করে থাকেন। ৩৩ শতকের এক বিঘায় বোরো মৌসুমে ২২ মন ধান হয়। এই ধান চাষ করতে কমপক্ষে ২ হাজার টাকা সেচ খরচ হয়। ২২ মন ধান বিক্রি করে পান ১৪ হাজার টাকা। আর আমন মৌসুমে এক বিঘায় ধান হয় ১৬ মন। এই ধান উৎপাদনে কমপক্ষে ৭ শত টাকা সেচ ব্যয় হয়। এই মৌসুমে ধান বিক্রি করে পাম ১০ হাজারের কিছু বেশি। হিসাব অনুযায়ী দুই আবাদে তিনি প্রায় ৩ হাজার টাকা সেচ ব্যয় করেন। আর শতকে ধান পান মাত্র ৭ শত টাকার। সেই হিসাবে দুই আবাদে ১ হাজারের কিছু বেশি টাকার ধান পাওয়া যেতো পুকুর কাটা ওই দেড় শতক জমিতে। কিন্তু সেখানে সেচ ব্যয় কম হয় ৩ হাজার টাকার। পাশাপাশি এক বছরে পুকুরে ৬শত টাকার সবজি আর ২ হাজার টাকার মাছ পেয়েছেন।
কৃষক আব্দুস সাত্তার জানান, তিনিও একটি পুকুর খনন করেছেন। একটি সংগঠনের পক্ষ থেকে পুকুর কেটে দেওয়া হয়েছে। তিনি জানান, এখন আর জমিতে পানির জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। এক বিঘা জমির এক কোনে পুকুর থাকায় সবসময় মাটি পানিযুক্ত থাকে। মাঝে মধ্যে তারা স্যালো মেশিন বসিয়ে সেচ দিয়ে দেন। বোরো মৌসুমে অনেক সময় বৃষ্টির পানি পুকুরে শুকিয়ে যায়, তখন স্যালো মেশিন দিয়ে পুকুর ভরে রাখেন। বছরের বেশির ভাগ সময় বৃষ্টির পানি পুকুরে থাকায় সেচ নিয়ে কোনো চিন্তা করতে হয় না।
এ বিষয়ে কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ জাহিদুল করিম জানান, এই পদ্ধতিতে চাষাবাদ অবশ্যই ভালো তবে এটা বারো মাস কিভাবে দেওয়া যায় সে বিষয়ে ভাবতে হবে। তিনি বলেন, ক্ষেতের আইলে মিনি পুকুর কৃষকরা যেমন মাছ পাচ্ছেন তেমনি সবজি পাচ্ছেন। এতে তারা উপকৃত হচ্ছেন।