ভুমিকা: বিভ্রান্তির শেষ নেই করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ, আক্রমণ ও করণীয় - অকরনীয় নিয়ে। এর উৎপত্তি নিয়েও পশ্চিমা বিশ্ব ও চীনের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দোষারোপ, পরস্পরকে দায়ী করা, করোনার আগ্রাসন নিয়ে অদৃশ্য শক্তির ক্রিয়া বলে প্রচারনা, করোনা সংক্রান্ত তথ্য নিয়ে বাড়াবাড়ি - এসব নিয়ে মিডিয়া সরগরম। এমনিতেই সারা বিশ্ব প্রায় অচল এবং আতংকগ্রস্ত। তার উপর ফেইসবুক, ইউটিউব, কিছু ভুঁইফোড় অনলাইন নিউজ চ্যানেল বিভিন্ন রকম বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার করে পরিস্থিতিকে আরো ঘোলাটে করে দিচ্ছে। কিছু কিছু ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব কোরআন-হাদিসের বরাত দিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেন এবং পরস্পরের মধ্যে বিতর্কে লিপ্ত হয়ে সাধারন মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন। ওদিকে করোনার উৎপত্তি ও সংক্রমন, লক্ষণ ও চিকিৎসা নিয়েও অব্যবস্থা বা অপর্যাপ্ত ব্যবস্থা, নির্দিষ্ট কোন চিকিৎসা ও টিকা না থাকা, চিকিৎসক - নার্সদের নিরাপত্তার সীমাবদ্ধতা- এসব নিয়েও যথেষ্ট সমস্যা রয়েছে। সবচেয়ে লক্ষনীয় বিষয় হল, বিশ্বের শক্তিমান ও সর্বাধুনিক প্রযুক্তির অধিকারী রাষ্ট্রগুলিতে করোনার আগ্রাসন ভয়াল রূপ লাভ করেছে। কতদিন এই আক্রমন চলবে, কবে এটি নিয়ন্ত্রিত হবে এ নিয়ে কোন নিশ্চয়তা নেই। কোভিড-১৯ এখন বিশ্ব মহামারি এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বেশী দুর্যোগপূর্ণ সময় বলে ঘোষণা করেছেন যথাক্রমে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান তেদ্রোস আধানম ঘেব্রেইয়েসাস (ঞবফৎড়ং অফযধহড়স এযবনৎবুবংঁং) এবং জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস (অহঃড়হরড় এঁঃবৎৎবং)। এছাড়া, সংক্রমন ও মৃত্যু সংখ্যা নিয়ে সরকারী - বেসরকারী তথ্যে গড়মিল, ঔষধ ও টিকা গবেষণা নিয়ে ভিন্ন রকম তথ্য প্রকাশ, করোনা থেকে মুক্তির বা এর নিয়ন্ত্রণ নিয়েও বিভিন্ন রকম মতামত ও ভবিষ্যৎ বাণী করা হচ্ছে। এসব কিছু নিয়ে মানুষ আশা-নিরাশার দোলাচলে নাজুক অবস্থায় রয়েছে।
করোনার উৎস ও বিতর্ক
ডিসেম্বর ২০১৯ এর প্রথম দিকেই চীনের উহানে নতুন করোনা ভাইরাস সংক্রমিত হয়েছে। তবে সনাক্ত হয়েছে প্রথমে ৩১শে ডিসেম্বর ২০১৯। কিছু বুঝার আগেই অর্থাৎ প্রস্তুতি নিতে প্রায় দেড় মাস সময় লেগে যাওয়ায় ইতোমধ্যে সর্বনাশ যা হবার তা জ্যামিতিক গতিতে শুরু হয়েছে। শুধু চীন নয় পুরো পৃথিবী অবাক। এরই মধ্যে আন্ত: দেশীয় ভ্রমন ও যাত্রী পরিবহনের মাধমে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশে। প্রথমে জানা গেল হুবেই প্রদেশের উহানের একটি সামুদ্রিক মাছ ও জীবজন্তুর পাইকারী বাজার হতে ছড়িয়েছে সর্প ও বাদুরের মাধ্যমে। এই ভাইরাস প্রাণী থেকে প্রাণীতে এবং পরে বন্য প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়। এরপর মানুষ থেকে মানুষে। এ-নিয়ে অনেক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ হয়েছে। সর্বশেষ জানা গেল মানুষ থেকে জন্ত্রুতেও সংক্রমন হয়। এটি ছোঁয়াছে কিনা প্রথমে নিশ্চিত ছিলনা, পরে নিশ্চিত হওয়া গেল। চীন দিশেহারা হয়ে গেল। প্রথমে উহান শহর লকডাউন করা হল। পরে সারা দেশেই যাতায়াত বন্ধ করা হল। চীনা নববর্ষের উৎসব বন্ধ করা হল। কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। কারণ এর কোন সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। কমিউনিস্ট নাস্তিক চীন ধর্মের কাছে আতœসমর্পন করল। বন্ধ করা মসজিদ খুলে দেয়া হল। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং নিজেই টুপি মাথায় দিয়ে মসজিদ ও চীনা মুসলমানদের চাল-চলন দেখা শুরু করলেন, দোয়া চাইলেন, চীনাদের অনেকে নামাজ পড়া শুরু করলেন। অনেকে মুসলমান হয়েছেন বলেও জানা যায়। অবশ্য এই সংবাদটি সত্য নয় বলে কোন কোন সূত্র বলেছে। চীনে যে উইঘুর মুসলমানদের নির্যাতন ও ধ্বংস করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল তাদের খাদ্যাভ্যাস ও আচার-কৃষ্টি সম্বন্ধে চীনারা জানল যে তারা বোরকা হিজাব পরে, হালাল খাবার খায়, অজু করে নামাজ পড়ে। তাইতো তারা নিরাপদ রইল। এই সংবাদের কোন কোনটিকে নকল বলে পরে জানানো হয়েছে।
উহান থেকে সুত্রপাত হওয়ায় পাশ্চাত্য ‘উহান ভাইরাস’ আবার কখনো ‘চীনা ভাইরাস’ নাম দিল করোনা ভাইরাসের । চীনাদের ছোট করার জন্য হয়তো এই নামে ডাকা হয়। কিন্তু স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীরা কোন দেশের উপর দোষ না চাপিয়ে এর ধাপে ধাপে নূতন নামকরণ করল ‘নতুন করোনা ভাইরাস’ - ‘২০১৯ এন সিওভি করোনা’ (হ ঈড়া ঈড়ৎড়হধ), ‘কোভিড-১৯’ বা ‘করোনা ভাইরাস ডিজিজ-১৯’। এখন এটি ‘কোভিড -১৯’ নামে পরিচিত হবে। কিন্তু পশ্চিমা দেশ বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্প এখন পর্যন্ত এটিকে ‘চীনা ভাইরাস’ বলে বক্তব্যে উল্লেখ করেন। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল, এবং আরো দু’ একটি দেশ কোভিড-১৯ কে বন্য প্রাণী থেকে নয়, চীনের কেমিক্যাল বা জীবাণু অস্ত্রের গবেষণাগার থেকে অসাবধানবশতঃ ছড়িয়েছে বলে প্রচার করছে। ঐ গবেষণাগারটি উহানেই অবস্থিত। যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ মিত্র ইসরাইল অফিসিয়ালি ঘোষণা দিল যে বিশ্বের উপর নেতৃত্ব দেয়ার এবং তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য এই জীবানু অস্ত্রের উৎপাদন করছে। চীনের বিস্ময়কর অর্থনীতি ও সামরিক শক্তির উত্থান এবং ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ কাজে লাগানোর চেষ্টা বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত আসছে। ইতোমধ্যে করোনা সম্বন্ধে তথ্য গোপন করে বিশ্বময় জান-মালের ক্ষতি করার অভিযোগে চীনের বিরুদ্ধে কোটি কোটি ডলারের ক্ষতিপূরণ চেয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করা হয়েছে । জানা গেছে আদালত তা গ্রহণ করেনি। ওদিকে চীনও একই অভিযোগ করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। আসলে ¯œায়ু যুদ্ধ (পড়ষফ ধিৎ) যে এখনো শেষ হয়নি এটি তার সাক্ষ্য। তবে জাতিসংঘ বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ ধরনের অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগ আমলে নেয়নি।
অন্যদিকে কিছু মুসলিম ধর্মীয় গুরু কোভিড-১৯ কে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে গজব নাজিল হয়েছে বলে বক্তব্য দিয়েছেন। মানুষের উশৃংখল আচরণ ও অনৈতিক জীবন যাপন, সৃষ্টিকর্তার নির্দেশকে উপেক্ষা করা, হালাল হারাম খাওয়া ও মানার ব্যপারে তোয়াক্কা না করা, ক্ষমতাধরদের কর্তৃক বিশ্বকে অশান্ত করে তোলা, প্রকৃতি ও জলবায়ূর ক্ষতিসাধন করা ইত্যাদির কারণে মানুষকে শাস্তি ও শিক্ষা দেয়ার জন্যই এই অদৃশ্য আক্রমণ বলে তাঁরা দাবী করেন এবং এর স্বপক্ষে ধর্মীয় রেফারেন্সও দিয়ে থাকেন। কেয়ামতের বেশী বাকী নেই এবং পৃথিবী ইতোমধ্যে শেষ অধ্যায়ে উপনীত হয়েছে বলা হয়। মজার বিষয় হল, বিশ্বের অমুসলিম রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানগণ এবং সাধারণ মানুষ এতে এই মহাদূর্যোগের দিনে এই ব্যখ্যায় দুর্বল হয়েছেন। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো করোনার অপ্রতিদ্বন্দী আগ্রাসনে হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, ‘আমাদের সব চেষ্টা শেষ, এখন আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার নেই।’ । প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, ফ্রান্স ও স্পেনসহ অন্যান্য দেশ সবাইকে মুসলিম নারীদের মধ্যে হিজাব পরার পরামর্শ দিয়েছেন। স্পেন - ফ্রান্সের মত দেশে যেখানে হিজাব নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, এ নিয়ে অমুসলিমদের হাসি- ঠাট্টা লেগে থাকত, আজ এরাই বোরকা-হিজাবকে ভাইরাস থেকে আতœরক্ষার কৌশল হিসেবে গ্রহণ করেছে। আর মুসলিম গুরুরা বলছেন ‘‘তোমরা মুসলিম নারীদের হিজাব নিষিদ্ধ করেছ আর এখন সারা পৃথিবীর পুরুষ-নারী নির্বিশেষে সবাইকে পিপিই ও মাস্কের মাধ্যমে বোরকা-হিজাব পরাতে বাধ্য হয়েছ। এটিই বিধির খেলা’’। তাঁদের মতে এখন কোরআন হাদিসের উপর গবেষণা করা দরকার। কেননা এতে এ ধরনের অদৃশ্য আক্রমণের ভবিষ্যদ্বাণী করা আছে। এখন মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সৃষ্টিকর্তার কাছে করোনা ভাইরাস থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য দোয়া করছে। কারণ করোনার বিরুদ্ধে সারা বিশ্ব যুদ্ধ করছে কিন্তু শত্রু অদৃশ্য। এ যেন রূপকথার গল্পের মত।
করোনা ভাইরাসের লক্ষণ ও উপসর্গ
কোভিড-১৯ এর লক্ষণ ও উপসর্গ নিয়ে নূতন নূতন কথা আসছে। চীন যখন আক্রান্ত হয়েছিল তখন লক্ষণ ছিল সীমিত শর্দি-কাশি, জ্বর, শ্বাসকষ্ট এবং শেষে নিউমোনিয়া শেষ পরিনতি । এরপর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও চীনের যৌথ মিশন কোভিডের কিছু লক্ষণ ও উপসর্গ চিহ্নিত করেছে। জ্বর ও শুস্ক কাশি-শর্দি দিয়ে শুরু, শ্বাসকষ্ট, গলা ব্যথা পেটে ব্যথা, কাঁপুনি, অবসন্নতা এবং শেষে নিউমোনিয়া চুড়ান্ত পর্যায়। কিন্তু দিন দিনই নূতন উপসর্গ যোগ হচ্ছে। মাথা ব্যথা, ক্ষুধামন্দা, ডাইরিয়া, গন্ধ শুঁকার ক্ষমতা লোপ এমনকি দৃষ্টি শক্তির সীমাবদ্ধতাও দেখা দিতে পারে। প্রতিদিনই খবরের কাগজে নূতন নূতন তথ্য পরিবেশিত হচ্ছে। আবার সব মানুষের এবং সব এলাকায় ও সব বয়সের মানুষের একই উপসর্গ নাও দেখা দিতে পারে। এমনকি উপসর্গ প্রকাশিত হওয়া ছাড়াও ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে কেউ। সবকিছু মিলিয়ে একটা অনিশ্চয়তা ও বিভ্রান্তি লেগেই আছে। আবার কিছু লোক শর্দি-কাশি-শ^াসকষ্ট নিয়েও মারা গিয়েছে। তাদের কারো কারো করোনার সংক্রমন থাকতেও পারে, আবার নাও থাকতে পারে। কারণ সঠিকভাবে চিকিৎসা হয়নি বা বুঝে উঠার আগেই মৃত্যু হয়েছে। প্রথম থেকে শুনা যাচ্ছিল ষাটোর্দ্ধ বয়সের আক্রান্তরা মৃত্যু ঝুঁকিতে বেশী এবং যাদের হাঁপানি, ডায়োবেটিস, হৃদরোগ এসব রয়েছে তাদের। এখন দেখা যাচ্ছে কমবয়সীরাও ঝুঁকির বাইরে নয়। শিশুরাও আক্রান্ত হচ্ছে। তবে যার প্রতিরোধ ক্ষমতা শরীরে যত বেশী সে তত বেশী সুরক্ষিত। বলা যায় যে, ভবিষ্যতে হয়তো নূতন উপসর্গ, নূতন তথ্য প্রকাশিত হতে পারে। মূলত: কোভিডের অনেক কিছুই চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের এখনো জানা যায়নি।
চিকিৎসা ও টীকা সমাচার
আমরা সবাই জেনেছি এখনো করোনার সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা পদ্ধতি ও ব্যবস্থা নিশ্চিত হয়নি। লক্ষণ ও উপসর্গ ভেদে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। এতোদিন কিছু নির্দিষ্ট হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু কিট এবং পিপিই -এর অভাবে ডাক্তাররা ভাইরাস থেকে অরক্ষিত থাকার ভয়ে নিজেরাই হাসপাতাল ত্যাগ করেছে - কেউ ছুটিতে, কেউ নিভৃতে, কেউ চাকরী ছেড়ে। হাসপাতাল থাকলেও রোগী দেখতে পারতেন না। পিপিই বা ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামের জন্য বাংলাদেশে ডাক্তাররা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন ও বক্তব্য প্রদান করছে। এখন শর্দি-কাশি-জ্বর নিয়ে রোগী আসলেও করোনার ভয়ে ভর্তি করা হচ্ছে না। বর্তমানে প্রচুর পরিমাণে পরীক্ষা কিট ও পিপিই চীন ও অন্যান্য সংস্থা থেকে আসাতে একটা গ্রহণযোগ্য অবস্থায় এসেছে। এখনো ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতে সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সবচেয়ে হতাশার বিষয় হল, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রে কিট, পিপিই ও সরঞ্জামের প্রকট অভাব দেখা দিয়েছে। এ বিষয়ে তারা অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছে। পিপিই ও কিট নিশ্চিত হওয়ায় সাম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন যাতে কোন ডাক্তার হাপাতাল থেকে অনুপস্থিত না থাকেন এবং বিনা চিকিৎসায় কোন রোগীকে ফেরত দেয়া না হয়। জনসচেতনতা বাড়ানোর উদ্দেশে সামাজিক দূরত্ব বা জনসমাবেশ নিষিদ্ধ, আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টিন কার্যকর করা, লকডাউন নিশ্চিত করার উপর আইইডিসিআর, স্বাস্থ্যপরিদপ্তর ও সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন সংস্থা রীতিমত প্রেস ব্রিফিং ও গনবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করছে। পুলিশ ও সেনাবাহিনী নিয়োগ করা হয়েছে। আবার এদের কার্যক্রম নিয়ে বাড়াবাড়িও হয়েছে। অযৌক্তিকভাবে লাঠি পেটা করা, কানধরে উঠ-বস করানো ইত্যাদিও হয়েছে। লকডাউন ও কোয়ারেন্টিন যে সফল ব্যবস্থা তা নিশ্চিত ও প্রমানিত। তারপরও মানুষ মানতে চায়না স্বভাবগত ভাবে, বিশেষ করে বাংলাদেশে, বাইরের কোন কোন দেশেও অনিয়ম হচ্ছে। ভারতে এধরনের অযাচিত ঘটনা প্রচুর ঘটেছে।
ইতোমধ্যে করোনার প্রতিষেধক, ঔষধ ও টীকা আবিস্কার নিয়ে গবেষণার জোয়ার ও প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। মোট ২০টি গবেষণা সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের (মতান্তরে ২২ বা ২৩টি) মাধ্যমে ওয়েবসাইটে দেখা যেছে ৩৩৩টি ভ্যাকসিন এপর্যন্ত গবেষণার আওতায় এসেছে। তবে মানুষের উপর দ্বিতীয় ধাপে ৩টি টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলে, যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ডে এবং চীনের হুবেই প্রদেশের সেই উহান শহরে প্রথম ধাপে বানর-ইদুরের উপর প্রয়োগ করে সফলতা পাওয়া গিয়েছে। বর্তমান ট্রায়ালে ৬৫০ জন মানুষকে যুক্ত করা হচ্ছে। অন্যদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, ৪টি ঔষধ ও কয়েকটি ঔষধের সমন্বিত প্রয়োগ নিয়ে কাজ চলছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার টিকা বিষয়ক একজন বিশেষজ্ঞ সদস্য অধ্যাপক ফেরদৌসী কাদরী জানান, উক্ত ৩টি টীকার সফল আবিষ্কার হলেও মানুষের উপর চিকিৎসা উপযোগী হতে আরো এক থেকে দেড় বছর সময় লাগবে। এর উৎপাদন বাংলাদেশে শুরু হতে হয়তো আরো এক-দেড় বছর লেগে যাবে। আবার ইতোমধ্যে চীনের স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত রোগীদের জন্য জাপানে ব্যবহৃত একধরনের ঔষধ করোনা ভাইরাসের আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে চীনে কার্যকর হয়েছে। ভারতেও এধরনের একটি টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে বলে সংবাদে এসেছে। চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়ে ছিলেন যে, জাপানের ফুজি ফিল্ম কোম্পানির সহযোগী প্রতিষ্ঠান টয়াসা কেমিক্যালে তৈরি ঔষধ উহানে ৩৪০ জন করোনা রোগীর উপর প্রয়োগ করে আশাব্যঞ্জক খবর পাওয়া গেছে । তারা ৪ দিনে সেরে উঠেছে। আবার এও বলা হয়েছে যে, যাদের উপর এই ঔষধ প্রয়োগ করা হয়নি তাদের ভাল হতে ১১ দিন লেগেছে। এসব তথ্য কতটুকু সঠিক তা বুঝা মুশকিল। চুড়ান্ত পর্যায়ে টিকা আবিষ্কৃত হলে হয়তো এ-সবের আসান হবে। আবার চীন জানিয়েছে তারা করোনা ভাইরাসকে কাবু করার অস্ত্র বের করেছে। এটি কোন ঔষধ বা টিকা নয়, একটি ন্যানোমেটেরিয়েল এবং ৯৯.৯% কার্যকর। বাংলাদেশের বেক্সিমকো এবং বিকন ফার্মা এই ঔষধটি উৎপাদনে যাচ্ছে।
ইতোমধ্যে আরো কিছু বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। চীনের জনৈক শ্বাসতন্ত্রের রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. জুং নানশান বলেছেন, এপ্রিল ২০২০ পর্যন্ত করোনায় সংক্রমন চলবে এবং এপ্রিলের শেষদিকেই নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হুশিয়ারী জানিয়েছে এশিয় দেশগুলির প্রতি আরো সতর্ক হতে এবং ভারতে আরো লোক ক্ষয় হতে পারে বলে জানিয়েছে। কোন কোন সংবাদে জানিয়েছে ১ কোটি লোক আক্রান্ত হবে। যে ভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোতে মৃত্যু ও সংক্রমনের মিছিল বেড়ে যাচ্ছে তাতে এটা অসম্ভব নয়। ঔষধ আবিষ্কারের ক্ষেত্রে নতুন নতুন বিভ্রান্তিকর খবর প্রকাশিত হচ্ছে। স্বপ্নে দেখা তাবিজ-তুমার , ব্যক্তিগত আবিষ্কার, বিভিন্ন দোয়া ইত্যাদিতেও অনেকে অনন্যোপায় হয়ে আকৃষ্ট হচ্ছে। করোনা প্রতিরোধে খাওয়া-দাওয়া, বিভিন্ন ভেষজ যেমন থানকুনি পাতা , আদা, রসুন, গরম পানি পান ইত্যাদির ব্যপারে নানান উপদেশ আছে। আগে জেনেছি একজন সুস্থ হওয়ার পর দ্বিতীয় বার আক্রান্ত হয়না কিন্তু দেখা গেল, দ্বিতীয় বারও কেউ কেউ আক্রান্ত হয়েছে। ওদিকে এ-ও সংবাদ এসেছে যে, চীন করোনাকে ঠেকালেও আবার সংক্রমনের আশংকা আছে।
সংক্রমন ও মৃত্যুর সংখ্যা বিতর্ক
যে উহানে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছে এবং এক মাসের মধ্যে সমগ্র চীনে ঝড়ের বেগে ছাড়িয়ে গেছে সেই চীনে মাত্র পাঁচ হাজার লোকের মৃত্যু এবং দেড় লাখের সংক্রমণ এটি বিশ্বাস করা কঠিন এবং এর বিরুদ্ধে মানবাধিকার কমিশন ও সাংবাদিকগণ তথ্য প্রদান করেছেন। মৃত্যুর সংখ্যা দুই লাখের কম নয় বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়। চীন তথ্য গোপন করেছে এবং গোপনে মৃতদেহ সরিয়ে ফেলেছে, অগ্নিচুল্লিতে পুড়েছে। এমন কি অনেক আক্রান্ত ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করেছে বলেও সামাজিক মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। ঘটনা যাই হোক চীনা জাতি যে এ ধরনের কর্মকান্ড দ্রুত ও নিষ্ঠুরতার সাথে করতে পারে তা কমিউনিস্ট চীনের চরিত্র থেকে আঁচ করা যায়। মত প্রকাশ ও সংবাদ পত্রের সাধীনতা যেখানে নেই সেখানে এ ধরণের ঘটনা ঘটতে পারে। এদিকে বাংলাদেশে মাত্র ২০ জন মারা গেছে এবং মাত্র শ’দুয়েক শনাক্ত হয়েছে বলে সংবাদে প্রকাশিত হচ্ছে। এ নিয়েও সমালোচনা হয়েছে। বিরোধী শিবিরের জনৈক বুদ্ধিজীবি সম্প্রতি পত্রিকায় বিবৃতি দিয়েছেন যে, আক্রান্তের সংখ্যা ৩৫ হাজার। ইতালী, যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, ও অন্যান্য দেশের তথ্য নির্ভরশীল বলে আমরা জানি। এরপরও যে, সরকারী বা জাতীয় স্বার্থে অনেক কিছুই হতে পারে। তবে সত্য-মিথ্যা যাই হোক তথ্যের যে গড়মিল রয়েছে তা অস্বীকার করা যাবে না। সর্বশেষ জানা গেল সারা বিশ্বে মোট মৃত্যু প্রায় আশি হাজার এবং আক্রান্ত প্রায় চৌদ্দ লাখ (৮ই এপ্রিল ২০২০)
শেষ কথা
কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাস এখন বিশ্বের এক নম্বর আলোচ্য বিষয়। এর আক্রমণে সমগ্র বিশ্ব দিশেহারা। হতাশা ব্যক্ত করেছেন যুক্তরাষ্ট্র, ইতালী, কানাডার রাষ্ট্রপ্রধানগণ। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে কার্যকর ব্যবস্থা যেমন নেয়া হচ্ছে তেমনি প্রার্থনা-দোয়ার মাধ্যমেও সর্বশক্তিমানের সাহায্য চাওয়া হচ্ছে। কোভিড-১৯ শতাব্দীর ভয়াল মহামারী এবং এটিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সবচেয়ে বড় দুর্যোগ বলে বলেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব। এখনো এর ঔষধ ও টিকা আবিষ্কার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌছেনি যা কার্যকর হতে আরো দেড়-দুই বছর লেগে যাবে। আর কতদিন এই অদৃশ্য ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাইরাস তান্ডবলীলা চালাবে তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারে না। বিশ্বের মহা শক্তিধর, প্রযুক্তি-বিজ্ঞানে উন্নত ও সর্বাধুনিক দেশ ও জাতি নাস্তনাবুদ এই ভাইরাসের কাছে। এর আগ্রাসনে হয়তো আরো অনেক মানুষ মারা যাবে। কিন্তু এক সময় নিয়ন্ত্রণে এলেও যুদ্ধ পরবর্তী রেশ যে আরো ভয়াভহ হবে তা নিশ্চিত। অর্থনীতি কোন্ পর্যায়ে নামে তাও জানা নেই। ব্যবসা-বানিজ্য, শিল্প-কারখানা, আমদানী-রপ্তানী, যাতায়াত-পরিবহন, অফিস-আদালত, শিক্ষা-সংস্কৃতি সব স্তব্ধ, স্থবির। মানুষ এখন বন্দী জীবন-যাপন করছে। এর মধ্যেই আজাব-গুজব, অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ, প্রচার-অপপ্রচার, অভাব-অনটন পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলছে। বিভ্রান্তিমূলক সংবাদ ও গুজব সাধারণ জনগণের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করে। বেতন-চাকরী ছাঁটাই, পেশাজীবি ও শ্রমজীবিদের বেকারত্ব সরকারের জন্য বাড়তি চাপ এবং খেটে খাওয়া মানুষের খাদ্যাভাব কোন্ পর্যায়ে পৌঁছে তা নিয়ে চিন্তা-দুশ্চিন্তার অন্ত নেই।
জনমনে একটি বড় প্রশ্ন গরীব দেশের তুলনায় উন্নত ও ক্ষমতাধর বা ধনী দেশে কেন কোভিডের তান্ডব! এর কারণ বা যুক্তি খুঁজতে গিয়ে অনেক নূতন নূতন তথ্যের বিষয় এসেছে। তাদের দ্বারা সংঘঠিত কোন জঘন্য অপরাধের কথা, তাদের উশৃংখল জীবন-যাপন, নিজেদের ক্ষমতার মোহে সর্বশক্তিমানকে এবং তাঁর শক্তিকে তোয়াক্কা না করা, গোপন পরিকল্পনায় বিশ্বকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনা ইত্যাদি উঠে আসছে। প্রশ্ন উঠেছে চীনাদের খাদ্যাভ্যাস, ধর্মহীনতা, উইঘুর মুসলিমদের প্রতি নিষ্ঠুর নির্যাতনকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখানোর জন্য এই অদৃশ্য আক্রমণ। আরো প্রশ্ন উঠেছে ইতালীর শহর বোলোগনার একটি ক্যাথলিক গির্জায় হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর অবমাননাকর ব্যঙ চিত্র সংরক্ষণ করা এবং এই শতকের শুরুতে এর বিরুদ্ধে আন্দোলনে ইউরোপের আরো কয়েকটি দেশ এই ব্যঙ চিত্রের প্রতিযোগিতায় নামে। অনেকে এইসব এবং পৃথিবীব্যপী অন্যায়-অত্যাচারের প্রতিশোধ হিসেবে এই অদৃশ্য আক্রমণ বলে মনে করেন। তাই বলা হয়, কোভিড-১৯ বাদুর-সাপ থেকে নয় মনুষ্য সৃষ্ট অর্থাৎ তাদের কর্মফল। পবিত্র ধর্ম গ্রন্থগুলিতে আভাষ দেয়া আছে যে, যুগে যুগে মানুষকে শিক্ষা দেয়ার জন্য এই ধরণের আজাব-মহামারী পৃথিবীতে আসবে। এসব গুজব হোক আর আজাবই হোক মানুষ যে প্রকৃতি থেকেও দূর্বল হতে পারে, প্রকৃতিও যে প্রতিশোধ নিতে পারে, তা উড়িয়ে দেয় যায় না। আর এই প্রকৃতি কার অধীন তাও আমাদের অনুধাবন করা প্রয়োজন।
অধ্যক্ষ ও কলাম লেখক